বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন থেকে সরকার পতন: এক বছরে বৈষম্য কতটা কমলো?

  • নিউজ ডেস্ক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: আগস্ট ৪, ২০২৫, ১২:১৪ পিএম
ছবি: বিবিসি

"আমার সোনার বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই"—এই স্লোগানকে সামনে রেখে গত বছরের জুলাই মাসে শুরু হয়েছিল ঐতিহাসিক কোটা সংস্কার আন্দোলন। ঘটনাক্রমে তা রূপ নেয় সরকার পতনের গণআন্দোলনে। পাঁচ আগস্ট শেখ হাসিনার সাড়ে পনেরো বছরের শাসনের ইতি টেনে শপথ নেয় অন্তর্বর্তীকালীন একটি নতুন সরকার, যার প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।

এক বছর পেরিয়ে এলেও বদলায়নি প্রশাসনিক কাঠামোর সেই পুরনো চিত্র। বরং কখনও কখনও উঠে এসেছে গুরুতর ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি এবং প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ—সরাসরি আন্দোলন সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধেই।


৮ আগস্ট ২০২৪, গণঅভ্যুত্থানের তিন দিন পর, যানজটে আটকে থাকা অধ্যাপক ইউনূসের ছবি ভাইরাল হয় সামাজিক মাধ্যমে। ভিআইপি প্রটোকল উপেক্ষা করে সাধারণ মানুষের মতো জ্যামে বসে থাকা তার এই ছবি তৎকালীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি জনআস্থা বাড়িয়ে দেয়।

সেসময় মনে করা হচ্ছিল, এ থেকেই শুরু হবে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন। কিন্তু আজ, এক বছর পরে, সাধারণ মানুষ আবারও সেই পুরনো ভিআইপি সংস্কৃতি, আমলাতান্ত্রিক দাপট, এবং সেবাখাতে অকার্যকর ব্যবস্থাপনার মুখোমুখি।

চলমান অভিযোগ অনুযায়ী, পাসপোর্ট অফিস, বিআরটিএ, কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি ও হয়রানি আগের মতোই চলছে। সাত লাখের বেশি ড্রাইভিং লাইসেন্স আটকে আছে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে। সচিবালয়ে এখনো দেখা যায় ব্যক্তিগত বাহন ও প্রটোকল ব্যবহারকারী উপদেষ্টা ও কর্মকর্তাদের আনাগোনা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাহা মির্জা বলেন, "অভ্যুত্থানের পর আমলারা বদলে গেছেন তেমনটা না। যে নিপীড়নমূলক আমলাতন্ত্র তৈরি হয়েছিল, তারাই এখনও পদে বহাল।"

বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস বলেন, "নতুন সরকারের মধ্যে ইনএফিসিয়েন্সি ছিল। তারা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে পারেনি। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছে।"


বিশ্লেষকদের মতে, সবচেয়ে হতাশাজনক হলো, আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী কিছু তরুণ-তরুণীর বিরুদ্ধেই আজ ক্ষমতার অপব্যবহার ও অনৈতিক আচরণের অভিযোগ উঠছে। অভিযোগ উঠেছে, জুলাই আন্দোলনকে ‘মানিমেকিং মেশিন’ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

গত ২৮ জুলাই, প্ল্যাটফর্মের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা নিজের ফেসবুক পোস্টে অভিযোগ করেন, আন্দোলন থেকে তৈরি হওয়া পদগুলো বাণিজ্যের মাধ্যম হয়ে উঠেছে।

এর কয়েকদিন আগে গুলশানে চাঁদাবাজির অভিযোগে আটক হন সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুর রাজ্জাক ওরফে রিয়াদ। তার এনসিপি আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের ঘনিষ্ঠ বলেও দাবি করেছেন অনেকেই।

আন্দোলনের সহ-সমন্বয়ক হাসিবুর ইসলাম নাসিফ অভিযোগ করেন, "জুলাই আন্দোলনের ভেতরেই সবচেয়ে আগে বৈষম্য তৈরি হয়েছিল। রাষ্ট্র তখন আমাদের সফরের খরচ দিয়েছে—যেটা একেবারেই অনৈতিক এবং অবৈধ।"


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইসরাত জাহান ইমু বলেন, "প্রত্যেকটা জায়গায় জুলাইকে ব্যবহার করা হচ্ছে, কিন্তু জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি। আন্দোলনটা বেঁচে থাকার লড়াই থেকে বেচার মাধ্যম হয়ে গেছে।"

নারীর প্রতি বৈষম্যের বিষয়টিও সামনে এসেছে নতুনভাবে। আন্দোলনের অন্যতম মুখ মাইশা মালিহা বলেন, "যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল, তারাই ফিরে এসেছে ফুলের মালা পরে। কোনো শাস্তি হয়নি।"


অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে থাকা এনসিপি (ন্যাশনাল চেঞ্জ পার্টি)-র একাধিক নেতার বিরুদ্ধে ওঠেছে দুর্নীতি ও প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ। উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের বাবার বিরুদ্ধে কুমিল্লায় ক্ষমতা অপব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। পাঠ্যবই ছাপায় কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয় এনসিপি নেতা গাজী সালাউদ্দিন তানভীরকে।

অধ্যাপক ফেরদৌস বলেন, "তারা শেখার সুযোগ পেয়েছে পুরনো রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকেই। ফলে পরিবর্তন আনতে গিয়ে নিজেরাই সেই ব্যবস্থার অংশ হয়ে গেছেন।"


রাজনীতি বিশ্লেষক মাহা মির্জা বলেন, "অন্তর্বর্তী সরকারের যেসব দায়িত্ব ছিল, তারা তা ঠিকভাবে পালন করতে পারেনি। সরকার ও সমাজের মধ্যে যে বিচ্ছিন্নতা, তা দূর করতে না পারায় এই সুযোগগুলো নষ্ট হয়েছে।"

এক বছর আগে লাখো মানুষের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে শুরু হওয়া একটি আন্দোলন আজ নিজেই প্রশ্নের মুখে। পুরনো ব্যবস্থার স্থায়িত্ব, নতুন নেতৃত্বের অদক্ষতা এবং নৈতিক বিচ্যুতি—সব মিলিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, আদৌ কি 'আমার সোনার বাংলায়' বৈষম্যের ঠাঁই নেই?

সূত্র: বিবিসি

ওএফ