ঢাকা: আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য বিএনপি ইতিমধ্যে ২৩৭ আসনে তাদের প্রার্থীদের মনোনয়ন চূড়ান্ত করেছে। এর মধ্যে কয়েকটি আসনে প্রার্থীদের মনোনয়ন স্থগিতও করেছে। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে দলীয় অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা তত প্রকাশ পাচ্ছে।
দীর্ঘ ১৫ বছর মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় নেতারা আশায় ছিলেন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তারা দলীয় মনোনয়ন পাবেন। তবে এক আসনে একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশি থাকায় সবার মন রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না দলটির। এক্ষেত্রে মনোনয়ন প্রত্যাশিরা দলীয় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে মনোনয়ন পুনর্বিবেচনার আবেদন করেছেন।
এক্ষেত্রে বিএনপি চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড) আসনে আলোচিত নেতা, দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আসলাম চৌধুরীকে বাদ দিয়ে মনোনয়ন দিয়েছে তুলনামূলক নতুন মুখ চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক কাজী সালাউদ্দিনকে। মনোনয়ন ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করেন। টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ হয় দুপুরজুড়ে। স্থানীয় অঙ্গসংগঠনের নেতারা জরুরি সভা ডাকেন। বিক্ষোভকারীরা অভিযোগ করেন, ‘রাজপথে আন্দোলনের নেতা’ হিসেবে পরিচিত আসলামকে উপেক্ষা করে একজন অপ্রকাশ্য নেতাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। তারা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে মনোনয়ন ‘পুনর্বিবেচনার’ দাবি জানান।
আসলাম চৌধুরী মনোনয়ন না পাওয়ায় স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন—নির্বাচন যখনই হোক, আমি অংশ নেবো। সীতাকুণ্ডের জনগণ তার সঙ্গে আছে। মনোনয়ন নয়, শেষ ফলটাই গুরুত্বপূর্ণ—এমন বার্তা দিয়েই তিনি মাঠে সক্রিয়।
নাটোর–১ আসনে বিএনপি চেয়ারপারসনের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা কমিটির বিশেষ সহকারী, মিডিয়া সেল সদস্য ফারজানা শারমিন পুতুলকে চূড়ান্ত প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন কেন্দ্রীয় বিএনপির সহ-দপ্তর সম্পাদক অ্যাডভোকেট তাইফুল ইসলাম টিপু।
একইভাবে মৌলভীবাজার–২ (কুলাউড়া) আসনে বিএনপি মনোনয়ন দিয়েছে কুলাউড়া উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি শওকতুল ইসলাম শকুকে। এ আসনে দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি এবং মৌলভীবাজার জেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট আবেদ রাজা মনোনয়নবঞ্চিত হয়েছেন। প্রার্থী ঘোষণার পর তার সমর্থকরা এলাকায় মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা, পথসভা ও দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি করে বিক্ষোভ দেখান।
মাদারীপুর-১ আসনে মনোনয়ন পান জামান কামাল নুরুউদ্দিন মোল্লা। তিনি ঢাকা-১৭ আসনেও প্রচারণা চালাচ্ছিলেন। এই আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক সাজ্জাদ হোসেন সিদ্দিকী লাভলু। প্রার্থী ঘোষণার পরপরই প্রতিবাদে লাভলুর কর্মী-সমর্থকরা ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের শিবচর উপজেলার পাঁচ্চরে সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে অবরোধ করেন।
সাতক্ষীরা-৩ (আশাশুনি-কালিগঞ্জ) আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য, সাবেক সংসদ সদস্য কাজী আলাউদ্দিন। তিনি আগে সাতক্ষীরা-৪ আসনে জাতীয় পার্টি (নাজিউর) থেকে নির্বাচিত ছিলেন।
এ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশি ছিলেন ডা. শহিদুল আলম। তিনি মনোনয়ন না পাওয়ায় টানা বিক্ষোভ ও সমাবেশ করেছেন তার কর্মী-সমর্থকরা।
সাতক্ষীরা-২ (সদর) আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন আলিপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির বহিষ্কৃত সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আব্দুর রউফ। প্রার্থী ঘোষণার পরদিন রাতেই ক্ষুব্ধ হয়ে ‘মশাল মিছিল’ করেন আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী চেয়ারম্যান আব্দুল আলিমের সমর্থকেরা।
বিএনপির প্রাথমিক মনোনয়ন ঘোষণার পর সারাদেশে বিভিন্ন জেলায় অর্ধশতাধিক আসনে মনোনয়নবঞ্চিত নেতার সমর্থকরা বিক্ষোভ, মানববন্ধন, স্মারকলিপি, অবস্থান, অনশন ও শোভাযাত্রাসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছেন। যেসব আসনে মনোনয়নবঞ্চিতরা বিক্ষোভ ও মানববন্ধর করেছেন তাদের মধ্যে ঢাকা বিভাগ: মানিকগঞ্জ–০১, ঢাকা–১২, মাদারীপুর–০১ ও ০২, মুন্সিগঞ্জ–০১, গাজীপুর–০৬ এবং গোপালগঞ্জ–০২ আসনের মনোনয়ন নিয়ে অসন্তোষ ও তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। এসব এলাকায় বিক্ষোভ, দলীয় কার্যালয় ঘেরাও এবং মনোনয়ন পুনর্বিবেচনার দাবিতে স্মারকলিপি দেওয়া হয়।
চট্টগ্রাম বিভাগ: চট্টগ্রাম–০২, ০৪ ও ১৬, কুমিল্লা–০৫, ০৬, ০৯ ও ১০, ব্রাহ্মণবাড়িয়া–০৫, নোয়াখালী–০২ ও ০৫, ফেনী–০২ এবং চাঁদপুর–০৪ আসনে মনোনয়নবঞ্চিতদের কর্মসূচি সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে। কোথাও সড়ক অবরোধ, কোথাও বিক্ষোভ মিছিল—কিছু এলাকায় দলীয় কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচিও হয়।
সিলেট, রংপুর ও ময়মনসিংহ বিভাগ: সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার–০২, রংপুরের দিনাজপুর–০২ ও কুড়িগ্রাম–০৩ এবং ময়মনসিংহের ময়মনসিংহ–০৩, ০৬, ০৯ ও শেরপুর–০১ ও ০২ আসনেও বঞ্চিত নেতাদের সমর্থকেরা বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন।
খুলনা বিভাগ: খুলনা বিভাগের কুষ্টিয়া–০২, ০৩ ও ০৪, সাতক্ষীরা–০২, ০৩, ঝিনাইদাহ–০৩, মেহেরপুর–০১ ও ০২ এবং মাগুরা–০২ আসনে দলীয় নেতাকর্মীদের তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। জেলা কার্যালয়ের সামনে ধরনা ও মিছিলসহ বিভিন্ন ধরনের প্রতিবাদ কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়।
রাজশাহী বিভাগ: রাজশাহী বিভাগের রাজশাহী–০১, ০৩ ও ০৫, নওগাঁ–০১, ০৩ ও ০৪, জয়পুরহাট–০২, নাটোর–০১, পাবনা–০৪ এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ–০২ আসনেও একইভাবে দলীয় অসন্তোষ বিস্তার লাভ করে। নেতাকর্মীরা দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে মনোনয়ন পুনর্বিবেচনার দাবি জানান।
পিএস