বিদায় লগ্নে ভারতে সুনীল বন্দনা, বাংলাদেশে আক্ষেপ

  • ক্রীড়া ডেস্ক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: মে ১৮, ২০২৪, ১২:১৫ পিএম

ঢাকা : ভারত তো বটেই, দক্ষিণ এশিয়ার সর্বকালের সেরা ফুটবলারের বিতর্কে ভালোভাবেই আসবে তার নাম। দীর্ঘ ১৯ বছরে ভারতের ফুটবলকে অন্য পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। সেই সুনীল ছেত্রী বুটজোড়া খুলে রাখছেন ৬ জুন।

সম্প্রতি অবসরের ঘোষণা দেওয়া চল্লিশ ছুঁই ছুঁই ছেত্রী গোটা ক্যারিয়ারেই ভুগিয়েছেন বাংলাদেশকে। অনেক ম্যাচে শেষ মুহূর্তে গোল করে বাংলাদেশকে হয় জিততে দেননি, নয়তো হারিয়ে দিয়েছেন। এরপরও সীমানার ওপারের তারকার ভক্ত এপারেও কম নয়। বিপক্ষে খেলা অনেকেই মজে আছেন সুনীল-বন্দনায়। আবার অনেকে এ দেশে সুনীল মানের একজন জন্ম না নেওয়ার আক্ষেপও করেছেন।

কলকাতার যুব ভারতী ক্রীড়াঙ্গনে ৬ জুন বিশ্বকাপ বাছাইয়ে কুয়েতের বিপক্ষে ভারতের হয়ে শেষ ম্যাচটি খেলবেন ১৫০ ম্যাচে ৯৪ গোল করা সুনীল ছেত্রী। আন্তর্জাতিক ফুটবলে সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকায় তিনি চারে। তার ওপরে পর্তুগিজ বিশ্বতারকা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো (১২৮), ইরানের আলী দাইয়ি (১০৮) ও আর্জেন্টাইন মহাতারকা লিওনেল মেসি (১০৬)। ছেত্রী বাংলাদেশের বিপক্ষে অফিশিয়াল-আন অফিশিয়াল মিলিয়ে খেলেছেন সাত ম্যাচ। গোলসংখ্যাও সমান সাত। কেবল দুটি ম্যাচে গোল পাননি। বাকি সব ম্যাচে কেবল গোলই করেননি, তাতে নির্ধারিত হয়েছে ম্যাচের ভাগ্য।

[223548]

বাংলাদেশের বিপক্ষে ছেত্রী প্রথম খেলতে নামেন ২০০৭ সালে নেহরু কাপে। সেই ম্যাচে তার দল জিতলেও গোল পাননি তিনি। গোলের শুরু ২০১৩ কাঠমান্ডু সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে। সেবার ভারতকে হারানো খুব কাছে পৌঁছে গিয়েছিল বাংলাদেশ। ৮২ মিনিটে আতিকুর রহমান মিশুর গোলে লিড নিয়েছিল তারা। তবে বাংলাদেশকে জিততে দেননি সুনীল ছেত্রী। যোগ করা সময়ের পঞ্চম মিনিটে ফ্রি-কিক থেকে অসাধারণ গোলে হৃদয় ভাঙেন। পরের বছর ভারতের গোয়ায় ফিফা প্রীতি ম্যাচেও একইভাবে বাংলাদেশের মুঠো থেকে জয় ছিনিয়ে নেন তিনি। ম্যাচের ১৪ মিনিটে তার গোলে লিড নেয় স্বাগতিক ভারত। তবে ৫১ মিনিটে মিঠুন চৌধুরীর গোলে সমতায় ফিরেছিল বাংলাদেশ। ৬৪ মিনিটে ভারত ডিফেন্ডার অর্ণব ম-লের আত্মঘাতী গোলে লিড নেয় বাংলাদেশ। তবে ছেত্রী ফের যোগ করা সময়ে গোল করে বাংলাদেশকে জয়বঞ্চিত করেন।

২০১৯ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে যুব ভারতীতে বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ১-১ ড্র ম্যাচে ছেত্রী গোল পাননি। ২০২১ সালে দোহায় বিশ্বকাপ বাছাইয়ের ম্যাচটা ড্রয়ের দিকে এগোচ্ছিল। তবে শেষ দিকে জোড়া গোল করে বাংলাদেশকে হতাশ করেন ছেত্রী। ২০২১ সালে মালেতে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের লিগপর্বে তার গোলে এগিয়ে গিয়েছিল ভারত। তবে ৭৪ মিনিটে ইয়াছিন আরাফাতের গোলে বাংলাদেশ ম্যাচটা শেষ করে সমতায়। ছেত্রী বাংলাদেশকে শেষবার ভুগিয়েছেন গত বছর সেপ্টেম্বরে এশিয়ান গেমসের ম্যাচে। বাংলাদেশ অলিম্পিক দলের বিপক্ষে ৮৫ মিনিটে পেনাল্টি থেকে গোল করে দলকে জেতান তিনি।

এরপর আর দেখা হয়নি। সেটাই আক্ষেপ হয়ে থাকল জামাল ভূঁইয়ার কাছে। নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে ভারত অধিনায়ককে সম্মান জানিয়েছেন বাংলাদেশ অধিনায়ক, ‘আপনার (ছেত্রী) বিপক্ষে কিছু অসাধারণ লড়াইয়ের কথা মনে পড়ছে। আমরা সব সময় বক্সের ভেতরে আপনি কতটা চালাক, তা নিয়ে কথা বলতাম। নিজ দেশের ফুটবলে আপনার দেশে অভিভূত হয়েছি। ভেবেছিলাম ভারতের হয়ে আপনার ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচটা বাংলাদেশের বিপক্ষে হবে।’

[223544]

ছেত্রীর বিপক্ষে দুটি ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে সাবেক স্ট্রাইকার জাহিদ হাসান এমিলির। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই এমিলির সরল স্বীকারোক্তি, ‘সত্যি বললে, আমি ওর খেলার বড় ভক্ত ছিলাম। আমরা প্রায় সমসাময়িক। অথচ দেখেন ও এখনো অসাধারণ ফুটবল খেলছে। এটাই প্রমাণ করে, ও নিজেকে দীর্ঘ সময় কতটা ফিট রেখেছে। ও চাইলে আরও দুই-তিন বছর নির্বিঘেœ খেলতে পারত ভারতের হয়ে। স্ট্রাইকার হিসেবে যেসব রেকর্ড থাকা উচিত, সবই তার সঙ্গে আছে। আমরা অনেকগুলো ম্যাচে ভারত নয়, হেরেছি ছেত্রীর কাছে।

আমার চোখে ও দক্ষিণ এশিয়ার সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়।’ এরপর আক্ষেপ নিয়ে এমিলি বললেন, ‘ও একাই ভারতীয় ফুটবল বদলে দিয়েছে। ওর মাপের একজন খেলোয়াড় আমরা কখনো পাইনি। ওর মতো একজন পেলে আমাদের ফুটবলও বদলে যেত।’

বাংলাদেশের সাবেক কোচ মারুফুল হক ছেত্রীকে কাছ থেকে খেলতে দেখেছেন। ২০১৫ সালে সাফে তিনি ছিলেন বাংলাদেশের কোচ। তবে গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিতে হওয়ায় সেবার ভারতের বিপক্ষে খেলেনি বাংলাদেশ। ফলে ছেত্রীকে থামানোর ছকটা কষতে হয়নি তাকে। তবে একটা বিশেষ ভাবনা তার মাথায় ছিল সব সময়, ‘টেকটিক্যালি ও টেকনিক্যালি ছেত্রী অনেক শক্তিশালী। ও কম উচ্চতা নিয়েই বড় বড় দলের, বড় বড় ডিফেন্ডারকে পরাস্ত করে গোল করেছে নিয়মিত। আমার কাছে সবচেয়ে ভালো লেগেছে ওর অগ্রজ্ঞান দেখে। ও জানত বক্সের কোথায় পজিশন নিতে হবে, রিবাউন্ড বলগুলো কোথায় আসবে, ক্রস কোথায় আসবে। এটা বড় স্ট্রাইকারদের সহজাত বৈশিষ্ট্য। ভারতীয় ফুটবলে ও একজন বিরল প্রতিভা। ও অ্যাটাকিং থার্ডে চতুর একজন স্ট্রাইকার। ওর চাতুরতায় ডিফেন্ডাররা প্রলুব্ধ হলেই সর্বনাশ হয়ে যায়।’ ছেত্রী মানের একজন স্ট্রাইকার এ দেশে না পাওয়ার কারণ হিসেবে মারুফ মনে করেন, ‘ভারতে তৃণমূল পর্যায়ে অনেক কাজ হয়। কাজ হয় বলেই ওর শূন্যতা পূরণে খুব বেশি অপেক্ষা হয়তো ভারতকে করতে হবে না। আর আমাদের দেশে হয় না বলেই আমরা পিছিয়ে থাকি।’

সুনীল ছেত্রীর বিদায়ে ভারতের ফুটবলে একটা যুগের অবসান ঘটবে। ঠিক যেমনটা ঘটেছিল ভারতীয় ক্রিকেটে শচিন টেন্ডুলকারের বিদায়ে। পাশের দেশের নক্ষত্রদের রাজসিক বিদায় দেখে আক্ষেপই কেবল সঙ্গী হয় এ দেশের মানুষের।

এমটিআই