• ঢাকা
  • রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

এবারো ডুবছে হাওরের জমি


কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি এপ্রিল ৪, ২০২২, ০১:১৪ পিএম
এবারো ডুবছে হাওরের জমি

কিশোরগঞ্জ : পাহাড়ি ঢলের পানিতে ভেসে যাচ্ছে কৃষকের স্বপ্ন। যে ফসলের ওপর নির্ভর করে সন্তানের পড়াশুনা, চিকিৎসা আর পরিবারের খরচ, সেই ফসল ডুবে যাচ্ছে চোখের সামনেই। এমন চিত্র কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার বিভিন্ন হাওরে।

গত শনিবার বিকাল থেকেই ঢলের পানি এসে ঢুকছে বিভিন্ন হাওরে। নদীর তীরবর্তী চরগুলো তলিয়ে যাচ্ছে দেখতে দেখতে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেলা ছাড়া কিছুই করতে পারছেন না কৃষকেরা। কাঁচি হাতে নিয়ে জমির ফসল কাটবে-সেই উপায়ও নেই কারণ বেশিরভাগ জমির ধান এখনো কাঁচা।

তবে এখন পর্যন্ত কী পরিমাণ জমি তলিয়ে গেছে তথ্য নেই কৃষি অফিসে। তারা বলছেন, মূল হাওরগুলোতে এখনো পানি ঢুকেনি। নদীর তীরবর্তী চরগুলোই ডুবেছে।

ইটনা উপজেলার ছিলনী গ্রামের কৃষক মাফিক মিয়া। বাহিরচর হাওরে জমি করেছিলেন ৪০ শতাংশ। গতকাল শনিবার বিকাল থেকেই পানি ঢুকতে শুরু করেছে তার জমিতে। শনিবার সকালেও তার জমির অবস্থা ভালো দেখেছিলেন।

মাফিক মিয়া জানান, পরিবারের খরচ চালাতে সারা বছর ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে পৈতৃক জমিটাতে তিনি শ্রম দিতেন। সারা বছরের খোরাক হতো এতে। কিন্তু এইবারের ফসল আর ঘরে উঠল না।

মাফিক বলেন, ‘এ যেন মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। এক তো সব জিনিসের দাম বাড়তি। হারাইলাম জমির ফসলও। অহন বছরটা ক্যামনে চলমু?’ একই এলাকার কৃষক মন্নান মিয়া পাঙ্গাশিয়া হাওরে জমি করেছিলেন চার একর। অন্যের জমিজমা নিয়েছেন টাকার বিনিময়ে। ঢলের পানিতে তার ৪ একরই পানিতে তলিয়ে যাওয়ার পথে।

মান্নান জানান, সকালে যদি পানি না বাড়ে তবে কিছুটা জমি তিনি কাটতে পারবেন। আর যদি রাতারাতি পানি বেড়ে যায় তাহলে সব হারাবেন।

মান্নান বলেন, খুব টেনশনে আছি। সকালে যতটুকু পারি কাটমু। এজন্য বেশ কয়েকজনকে বলেও রেখেছি।

বড়হাটি এলাকার কৃষক মুসাহিদ মিয়া। তিনিও অন্যের জমি চাষ করেছেন টাকার বিনিময়ে। মূল হাওরের জমি জমা রাখতে গেলে বেশি টাকা লাগে। সামর্থ্য না থাকায় তাই অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকার জমি চাষ করেছিলেন তিনি। এসব জমিতে পরিশ্রম একটু বেশি লাগলেও ফসল ভালো হয়।

তিনি বলেন, সারা বছর শ্রম দিয়ে জমিতে ফসল ফলিয়েছি। আর এখন চোখের সামনে ডুবে যাচ্ছে। চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করতে পারছি না।

মুসাহিদ আরো বলেন, দুই বছর করোনার কারণে বাড়ির বাইরে কোথাও গিয়ে কিছু করতে পারিনি। কৃষি জমিই আমাদের একমাত্র সম্বল। কিন্তু অকাল বন্যার সেই সম্বলও ডুবে যাচ্ছে। আমরা এইবার শেষ। এখন নিজেই ক্যামনে চলমু আর পরিবারই বা ক্যামনে চালাইমু?

ইটনা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা উজ্জ্বল সাহা বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে আসা তথ্যমতে উপজেলার বাদলা হাওর, সদর ইউনিয়নের এরশাদনগর, আলালের বন, ধনপুর, বেতেগাসহ এলংজুরী ইউনিয়নের বিভিন্ন হাওরে পানি ঢুকেছে।’ এই কর্মকর্তা দাবি করেছেন, যে জমিগুলোতে পানি প্রবেশ করেছে বা যেগুলো ডুবেছে সেই জমিগুলো মূল হাওরের জমি না। এইগুলো নদীর তীরবর্তী বা বিভিন্ন খালে চাষ করা হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘গত একদিনে মেঘালয়, আসামের বিভিন্ন জায়গায় ২৬৭ মিলিমিটার পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে। সেই বৃষ্টির পানি এসে হাওরে ঢুকছে। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, আগামী একদিনে বৃষ্টির সম্ভাবনা নাই। তারপরও যে পরিমাণ পানি ঢুকেছে তাতেই আমরা আতঙ্কে আছি। আগামী ২৪ ঘণ্টা পরে যদি আবারো বৃষ্টি হয় তবে বিভিন্ন হাওরের অনেক জমিই তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।’

কিশোরগঞ্জের কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. ছাইফুল আলম বলেন, এখন পর্যন্ত কি পরিমাণ জমি পানিতে তলিয়েছে তার সঠিক তথ্য আমার কাছে এখনো আসেনি। আজ বিকাল থেকে বিভিন্ন হাওরে পানি ঢুকতে শুরু করেছে। আগামীকাল আমরা সরেজমিনে গিয়ে সঠিক তথ্য জানাতে পারবো।

এদিকে, নেত্রকোনার খালিয়াজুরী উপজেলার হাওরাঞ্চলে পাহাড়ি ঢলের পানি ঢুকতে শুরু করেছে। গেল তিনদিনে নিম্নাঞ্চলের কয়েকটি হাওরের অন্তত ৫শ একর জমি তলিয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় কৃষকরা। এ কারণে একমাত্র বোরো ফসলের ওপর নির্ভরশীল কৃষক পরিবারগুলোতে আহাজারি শুরু হয়েছে। ধান পাকার আগেই ফসল তলিয়ে যাবার আশঙ্কা করছেন তারা।

খালিয়াজুরীর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) এএইচএম আরিফুল ইসলাম ও স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তারা ৩৭০ একর বোরো জমি প্লাবিত হওয়ার কথা স্বীকার করেছেন।

খালিয়াজুরীর পুরানহাটি, বানিয়াহাটি, লক্ষ্মীপুর, পাঁচহাট ও জগন্নাথপুর গ্রামের কয়েকজন কৃষক জানান, বৃহস্পতিবার সকাল থেকে খালিয়াজুরীর ওপর দিয়ে প্রবাহমান ধনু, সুরমাসহ বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বাড়তে শুরু করে। গত শনিবারের মধ্যেই নদীগুলোর পাড় উপচে যায়।

গতকাল রোববার দুপুর নাগাদ খালিয়াজুরী সদর ইউনিয়নের কীর্তনখোলা, লক্ষ্মীপুর, চুনাই হাওর, বাইদ্যারচর, কাটকাইলের কান্দা, টাকটার, মনিজান, লেবরিয়া, হেমনগর, চাকুয়া ইউনিয়নের গঙ্গাবদর, নয়াখাল ও গাজীপুর ইউনিয়নের বাগানী, বৈলং এবং ডাকাতখালী হাওরের নিম্নাঞ্চলের প্রায় ৫ শ একর বোরো জমি তলিয়ে যায়।

এসব এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদ্যোগে নির্মিত বেশকিছু ফসল রক্ষা বাঁধ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলে জানান তারা।

পুরানহাটি গ্রামের কৃষক মনির হোসেন বলেন, ‘গেল তিনদিনে আমার অন্তত ২০ একর জমির ধান তলিয়ে গেছে। এসব জমিতে কেবলমাত্র চাল গজাচ্ছিল (মিল্কিং স্টেজ)। পাকতে আরো অন্তত ১৫-২০দিন লাগতো। লক্ষ্মীপুর গ্রামের আনোয়ার হোসেন, আব্দুর রউফ, ফুল মিয়া ও পাঁচহাট গ্রামের মিজাজুল মিয়া জানান, তাদেরও অন্তত ১৫ একর জমির ফসল তলিয়েছে।

খালিয়াজুরী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) এএইচ এম আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের প্রাথমিক হিসাবে এখন পর্যন্ত ৩৭০ একর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। তবে বিকেল নাগাদ এই হিসাবে একটু তারতম্য হতে পারে।’

কৃষি কর্মকর্তা জসীম উদ্দিন বলেন, পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে এখানে ব্যাপক ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে।

এবারের বোরো মৌসুমে খালিয়াজুরীর ৮৯টি হাওরে মোট ২১ হাজার ১২০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, পুরোদমে ধান কাটা-মাড়াই শুরু হতে আরো অন্তত ১৫ দিন দরকার।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী এম এল সৈকত জানান, ভারতের চেরাপুঞ্জিতে বৃহস্পতিবার ১৯১ মিলিমিটার ও শুক্রবার ৩৫৭ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে সুনামগঞ্জের যাদুকাটা ও সুরমার পানিপ্রবাহ বেড়ে খালিয়াজুরীর ধনু নদীর পানি উপচে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, ধনু নদীর পানি বৃদ্ধি আমাদের আশঙ্কার কারণ। খালিয়াজুরী পয়েন্টে এ নদীর বিপৎসীমা ৪ দশমিক ১৯ সেন্টিমিটার। কিন্তু রোববার সকাল নাগাদ ৩ দশমিক ৭১ সেন্টিমিটার পানি ছিল। অর্থাৎ পানি এখন ১ সেন্টিমিটার নিচে আছে।

এ কর্মকর্তা আরো বলেন, এখন পর্যন্ত কোনো ফসল রক্ষা বাঁধ ভাঙেনি। বাঁধগুলো আরো শক্ত ও মজবুত রাখার জন্য আমরা ১২ হাজার বস্তা জিওব্যাগ এবং পর্যাপ্ত বাঁশ সংগ্রহ করে বাঁধে স্থাপন করছি।

পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী এম এল সৈকত, খালিয়াজুরীর উপজেলা নির্বাহী অফিসার এএইচএম আরিফুল ইসলাম, কৃষি কর্মকর্তা জসীম উদ্দিন রোববার দুপুরে এ রিপোর্ট লেখার সময় হাওরের বিভিন্ন বাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্টগুলো পরিদর্শন করছিলেন। এ সময় তারা সংশ্লিষ্ট বিভাগকে প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দেন এবং বাঁধ রক্ষায় কৃষকদেরও প্রস্তুত থাকতে বলেন।

এর আগে শনিবার জেলা প্রশাসক কাজি আবদুর রহমানও খালিয়াজুরীর হাওর এলাকা পরিদর্শন করেন।

পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী এম এল সৈকত বলেন, খালিয়াজুরীর ১৮১ কিলোমিটারসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলার হাওরাঞ্চলে মোট ৩০০ কিলোমিটার ডুবন্ত ফসল রক্ষা বাঁধ রয়েছে। প্রতিবছরের মতো এবারো ৩৩ কোটি ১২ লাখ টাকা ব্যয়ে বাঁধগুলো নির্মাণ করা হয়েছে।

তিনি বলেন, ফসল রক্ষা বাঁধগুলো যে উচ্চতায় নির্মাণ করার কথা, আমরা সে অনুযায়ীই নির্মাণ করেছি।

উজান থেকে ভাটির দিকে পাহাড়ি ঢলের পানি নেমে আসতে দেখে মোহনগঞ্জ, কলমাকান্দা এবং মদন উপজেলার হাওরাঞ্চলেও কৃষকদের মাঝে দুশ্চিন্তা ছড়িয়ে পড়ছে।

২০১৭ সালে একই সময়ে উজান থেকে নেমে আসা ঢলের কারণে সৃষ্ট আগাম বন্যায় নেত্রকোনার খালয়াজুরী, মোহনগঞ্জ, মদন ও কলমাকান্দা উপজেলার শতভাগ ফসল তলিয়ে গিয়েছিল।

এতে নিঃস্ব হয়ে পড়েছিলেন হাজার হাজার কৃষক। এখনো অনেকে সে ধকল কাটিয়ে উঠতে পারেননি। চার বছর পর আবার একই আশঙ্কা তাদের গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!