• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

কিশোর গ্যাংয়ের দখলে কুমিল্লা শহর


মঈন নাসের খাঁন, কুমিল্লা মার্চ ১৮, ২০২৩, ১২:০৬ পিএম
কিশোর গ্যাংয়ের দখলে কুমিল্লা শহর

কিশোর গ্যাংয়ের লোগো

কুমিল্লা: কুমিল্লা নগরীতে বর্তমানে কমপক্ষে ২০টি কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। এই শহরে রীতিমতো তাণ্ডব চালাচ্ছে তারা। দুই বছরে তাদের হাতে খুন হয়েছেন কমপক্ষে আট জন। 

সম্প্রতি নগরীর ধর্মসাগরপাড় এলাকায় রবিউল হাসান শাহাদাত (১৫) নামে এক কিশোরকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার পর এসব গ্যাং নিয়ে মানুষের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। শহরটিকে অনিরাপদ মনে করছেন বাসিন্দারা। এই নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও চলছে সমালোচনা। 

এই হত্যাকাণ্ডের পর নানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে নিয়ে জানা গেছে, রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতারাই মূলত এসব গ্যাং পরিচালনা করে থাকেন। এর জন্য প্রথমে বেপরোয়া কিশোরদের বিভিন্নভাবে একত্রিত করেন তারা। এরপর নিজেকে ‘বড় ভাই’ হিসেবে দেখিয়ে তাদের জড়িয়ে দেন বিভিন্ন অপরাধে। পরে সেই অপরাধ থেকে নিজেই তাদের উদ্ধার করে বনে যান দয়ার অবতার। এরপর নিজেদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে তাদের দিয়ে গড়ে তোলান গ্যাং। কোনও কোনও নেতার একাধিক গ্যাংও আছে বলে জানা গেছে।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, কুমিল্লা নগরীতে ২০টি আলোচিত কিশোর গ্যাং রয়েছে। যারা শহরে প্রতিনিয়ত ত্রাসের রাজত্ব করে যাচ্ছে। এতে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে স্থানীয় বাসিন্দাদের মনে।

সর্বশেষ ১৯ আগস্ট বিকালে নগরীর আওয়ার লেডি অব ফাতেমা গার্লস স্কুল এলাকায় প্রকাশ্যে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে খুন করা হয় কিশোর শাহাদাতকে। ভয়ংকর এই হত্যাকাণ্ডের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে যোগাযোগমাধ্যমে। ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবস্থান নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। কারণ ধর্মসাগর পাড় থেকে কুমিল্লা জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয় ৪, জেলা শিল্পকলা অ্যাকাডেমি ২, জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ৪, কুমিল্লা জেলা ও দায়রা জজ আদালত ১০ মিনিটের দূরত্ব।

ঘটনাস্থলের সামনেই কুমিল্লা কাস্টমস অফিস ও আওয়ার লেডি অব ফাতেমা গার্লস স্কুল। জনমনে প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ এসব সরকারি ভবন ও জনবহুল স্থানে একজন কিশোর কীভাবে প্রকাশ্য দিবালোকে খুন হলো?

জানা গেছে, নগর উদ্যানের আশপাশে, ফৌজদারি চত্বর, মোগলটুলী, তালপুকুরপাড়, ঠাকুরপাড়া, মদিনা মসজিদ সড়ক, কেন্দ্রীয় ঈদগাহ এলাকা, চর্থা, থিরাপুকুরপাড়, অশোকতলা, ধর্মপুর, চাঁনপুর, বাখরাবাদ, কান্দিরপাড়, পুলিশ লাইন্স এলাকা, শাসনগাছা, নোয়াপাড়া চৌমুহনী, পুরাতন চৌয়ারা এলাকায় নিয়মিত শো-ডাউন করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। 

অনেক সময় স্কুল-কলেজ পড়ুয়া মেয়েদের ইভটিজিং,ছেলেদের মারধর, কিশোর-কিশোরীদের একত্রে দেখলে নির্যাতন, প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে ঘোরাঘুরি, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, চুরি, ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপকর্মে কিশোর গ্যাং সদস্যদের জড়াতে দেখা যায়। এসব ঘটনা দেখেও প্রাণ ভয়ে চোখ-মুখ বন্ধ রাখেন স্থানীয়রা। মামলা হয় না বলে তদন্তে নামে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

কুমিল্লার ধর্মসাগর পাড়সহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এসব এলাকায় পূর্বের মতো জনসমাগম নেই। আর দেয়ালে দেয়ালে বড় অক্ষরে লেখা কিশোর গ্যাংয়ের নাম। অনেক গ্যাংয়ের নামের লোগো আছে- এই লোগো দিয়েই নিজেদের পরিচয় বহন করে। আবার অনেকে মেসেঞ্জার গ্রুপ থেকেই একত্রিত হয়।

কিশোর গ্যাংয়ের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রত্যেক গ্যাংয়েরই মেসেঞ্জার গ্রুপ আছে। জুতা ও পরিধেয় পোশাকের মিল আছে। মিল আছে তাদের চুলের কাট, দাড়ি ও গোঁফের স্টাইলেও। অনেক গ্যাংয়ের সদস্যদের আড্ডার অবস্থানও নির্ধারিত। অনেকের কথা বলার ধরনেও মিল আছে। এ ছাড়া একই মডেলের মোবাইল ও ব্যাক কাভার ব্যবহার করেন তারা।

এসব গ্যাংয়ের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর ‘ঈগল গ্যাং’। এটির সদস্য ৯ শতাধিক। নগরীর বিভিন্ন দেয়ালে এই গ্যাংয়ের লোগো ও নাম আঁকা রয়েছে। তাদের নামের ওপর কোনও ব্যানার-পোস্টার লাগালে আক্রমণ করে বসে। এই গ্রুপের স্লোগান ‘বার্থ টু ফ্লাই’ (উড়ার জন্যই জন্ম)।

শহরের উল্লেখযোগ্য বাকি কিশোর গ্যাংগুলো হলো- রয়েল বেঙ্গল, সিজলিন, জে অ্যান্ড জে, বিগ ব্রাদার, টুইস্ট, ব্ল্যাক স্টার, ডার্ক, ঈগল, আরজিএস, র‍্যাক্স, এক্স, এলআরএন, সিএমসি, মডার্ন, রক স্টার, ডিস্কো বয়েজ, বস প্রভৃতি। এসব গ্যাংয়ের বেশিরভাগ সদস্যের বয়স ১২-১৮ বছর। গাঁজা, ইয়াবা, ধূমপানসহ সব ধরনের নেশায় তারা আসক্ত। 

একটির সঙ্গে আরেকটি গ্যাংয়ের দ্বন্দ্বও রয়েছে। কার চেয়ে কে শক্তিশালী- এই দ্বন্দ্বে তারা নানা ধরনের সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে। তাছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক গ্যাংগুলো নিরীহ শিক্ষার্থীদের নানাভাবে হয়রানি করছে।

কুমিল্লা জেলা পুলিশের বিভিন্ন শাখা থেকে জানা গেছে, ২০২০ সাল থেকে এক বছরে এসব কিশোর গ্যাং সদস্যদের হাতে খুন হন শিক্ষার্থীসহ অন্তত আট জন। গত ৪ মে টিকটক গ্রুপের মধ্যে বিরোধের জেরে শুভ নামের কিশোরকে বুকে ও পেটে  ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়। কুমিল্লা শহরতলীর গোমতী নদীর পালপাড়া ব্রিজ এলাকায় এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। 

এ ছাড়াও নগরীর মোগলটুলী এলাকার শিক্ষার্থী আজনাইন আদিল, মডার্ন স্কুলের ছাত্র মুমতাহিন হাসান মিরন, অটোরিকশা চালক শাহজাহান, নগরীর দিশাবন্দ এলাকার শিক্ষার্থী সাজ্জাতুল ইসলাম অনিক, কুমিল্লা অজিত গুহ কলেজের ছাত্র অন্তু, ব্রিটানিয়া ইউনিভার্সিটির বিবিএ প্রথম বর্ষের ছাত্র শাহজাদা ইসলামসহ বেশকিছু কিশোর ও শিক্ষার্থী এসব গ্যাংয়ের বলি হন।

এর আগে, ২০২০ সালের ২৮ মে নওশাদ কবির মজুমদার নাহিদ নামে কুমিল্লা জিলা স্কুলের দশম শ্রেণির এক ছাত্রকে মারধর করে ও ছুরি দিয়ে হাত-পায়ের রগ কেটে গুরুতর আহত করেছে গ্যাং গ্রুপ ‘আরজিএস’। তুচ্ছ ঘটনায় ওই গ্যাংয়ের জাহিদ খান নামের এক কিশোর তার সঙ্গীদের নিয়ে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় ঈদগাহের পাশে ঘটনাটি ঘটায়। গত ১২ আগস্ট ধর্মসাগর পাড়ের পিজ্জা কালজুন নামক একটি রেস্তোরাঁ ভাঙচুর করে একটি গ্যাং। 

এর দুদিন পর আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ধর্মসাগর পাড়ে দুই গ্রুপের সংঘর্ষ হয়। এত এক যুবককে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে আহত করার অভিযোগ ওঠে। শুক্রবার শাহাদাত হত্যার ঘটনাটি ঘটে। এ ঘটনার পরদিন নিহতের মা শাহানারা বেগম বাদী হয়ে ৩০ জনের নাম উল্লেখ করে কুমিল্লার কোতোয়ালি থানায় হত্যা মামলা করেছেন। মামলায় ‘রতন গ্রুপের’ লিডার রতনসহ ছয় জনকে গ্রেফতার করে। একই মামলায় কোতোয়ালি মডেল থানার পুলিশ গ্রেফতার করে ৯ জনকে। ডিবি গ্রেফতার করে দুজনকে। এ হত্যাকাণ্ডে মোট ১৭ জনকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

ধর্মসাগর পাড় এলাকার একটি বাসায় দীর্ঘদিন ভাড়া থাকেন কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের এক চিকিৎসক। নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, ‘যেদিন শাহাদাত খুন হয় সেদিন আমার ছুটি ছিল। আমার শিশু সন্তানকে নিয়ে বের হলাম পার্কে যাওয়ার জন্য। সামনেই ঘটনাটি দেখলাম। আমার ছেলে আমাকে বারবার জিজ্ঞেস করেছে বাবা ছেলেটাকে মারছে কেন? আমি তার চোখে হাত দিয়ে আবার বাসার দিকে ফিরে এসেছি। এখন আর বের হই না। সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যতদিন নিরাপদ বোধ না করবো ততদিন আর বের হবো না।’

আওয়ার লেডি অব ফাতেমা গার্লস স্কুলের অষ্টম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী বলে, ‘আমাকে বাবা স্কুলে দিয়ে আসেন এবং নিয়ে জান। আমার অনেক বন্ধু একা যাওয়া-আসা করে। তাদের কাছ থেকে প্রায়ই শুনি ছোট ছোট ছেলেরা তাদের বিরক্ত করে। বন্ধুদের সঙ্গে কোন ছেলে বন্ধুকে দেখলে তাদেরও মারধর করে।’

কুমিল্লা জিলা স্কুলের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে এসব ঘটনা স্বাভাবিক মনে হয়। ছেলেরা আসে, বিরক্ত করে আবার চলে যায়। আমাদের টিফিন টাকা-পয়সা, টিফিন বক্স, হাতের স্কেল, ওয়াটার পটসহ যা পারে নিয়ে যায়। আমার সঙ্গে মা বা আন্টি আসে। তাদের সামনেও এমন করে বসে। তাদের চিনি না। আবার অনেকে আমাদের সঙ্গেরই। তাই বিচারও দেওয়ার সুযোগ নেই। তাছাড়া স্কুল-কলেজের শিক্ষকরাও জানেন এসব বিষয়ে। গ্যাংগুলোর অনেক সদস্যের স্কুলব্যাগে ধারালো ছুরি থাকে। আমরা কিছু বললে আক্রমণ করে বসে।’

সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) সাবেক সভাপতি বদরুল হুদা জেনু বলেন, ‘সম্পূর্ণ দোষটা পুলিশকে দেওয়া ঠিক হবে না। এখানে দোষটা আমাদের সম্মিলিত। কারণ, সারাদিন এই ধর্মসাগর পাড়ে ছেলেগুলো বসে থাকে। তাদের পরিবার কেন তাদের বাধা দেয় না। তাই পারিবারিক সচেতনতা প্রয়োজন। তবে পুলিশের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। কারণ এই ঘটনা একরকম পুলিশের চোখের সামনেই। এই এলাকাটায় রাতে অন্ধকার থাকে। সিটি করপোরেশনকে অনুরোধ, যেন এদিকে কয়েকটা লাইট স্থাপন করে। আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিও আহ্বান যেন কুমিল্লার মানুষের নিরাপত্তা জোরদারে আরও সোচ্চার থাকে।’

তিনি আরও বলেন, ‘কিশোর গ্যাংয়ের ছেলেগুলো ছোট। সবার আগে দেখতে হবে তাদের কেউ ব্যবহার করছে কি-না। যতটুকু জানতে পেরেছি, রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় এসব ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছে তারা। তাই রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তিদের দিকেও নজর রাখা প্রয়োজন।

র‌্যাব-১১ কুমিল্লার উপ-পরিচালক মেজর মো সাকিব হোসেন বলেন, ‘র‌্যাব আগেও এসব গ্যাং ও গ্রুপের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেছে। আমরা এই সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি প্রতিকারের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি।’ 

কুমিল্লা জেলা পুলিশ সুপার আবদুল মান্নান বলেন, আমরা আগে সব কিশোর গ্যাং ডিটেক্ট (চিহ্নিত) করবো। এরপর তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো যেন তারা বেপরোয়া না হয়ে ওঠে। আমরা এসব ঘটনা সম্পূর্ণ বন্ধের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি।

সোনালীনিউজ/এমকে/এসআই

Wordbridge School
Link copied!