ময়মনসিংহ: বাংলাদেশের কৃষি খাত বর্তমানে খাদ্য উৎপাদনের চাপে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের মারাত্মক হুমকির মুখে রয়েছে। প্রতিবছর ব্যবহৃত বিপুল পরিমাণ কীটনাশকের অনেকগুলোই নিষিদ্ধ ও অত্যন্ত ক্ষতিকর হলেও এগুলো সহজেই বাজারে পাওয়া যায়।
ফলে কৃষকরা নিয়ম না মেনে অতিরিক্ত বা একাধিক কীটনাশক মিশিয়ে ব্যবহার করছেন, যার ফলে খাদ্যে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ জমা হচ্ছে এবং মানবদেহে নানা রোগের ঝুঁকি বাড়ছে। শুধু মানুষ নয়, এই বিষক্রিয়ার প্রভাব পড়ছে মাটি, পানি এবং প্রাণিজ সম্পদের ওপরও, যা দেশের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতের জন্য মারাত্মক হুমকি তৈরি করছে।
এ পরিস্থিতি, কীটনাশকের ক্ষতিকর দিক, বিকল্প ব্যবস্থাপনা এবং প্রতিরোধের উপায় নিয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) কৃষি অনুষদের উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও উদ্ভিদবিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ শাহজাহান মঞ্জিল এবং ভেটেরিনারি অনুষদের ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ও প্রাণিবিজ্ঞানী ড. মো. শফিকুল ইসলাম বিস্তারিত মতামত তুলে ধরেছেন।
বালাইনাশকের ধরণ নিয়ে উদ্ভিদবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শাহজাহান মঞ্জিল বলেন, বাংলাদেশে কৃষিতে ছত্রাকনাশক, কীটনাশক ও আগাছানাশক একত্রে বালাইনাশক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে ছত্রাকনাশকের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি-প্রায় ৪৫ থেকে ৪৬ শতাংশ। এরপর রয়েছে কীটনাশক (৩৩ শতাংশ) এবং আগাছানাশক (২০-২১ শতাংশ)। পাশাপাশি কৃমিনাশক, ব্যাকটেরিয়ানাশক ও ইঁদুরনাশকও ব্যবহৃত হয়।
বিষাক্ত বালাইনাশকের কারণে খাদ্যশস্যে রাসায়নিক অবশিষ্টাংশের পরিমাণ নিয়ে তিনি বলেন, দেশের প্রায় ৩০ শতাংশ সবজিতে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ পাওয়া গেছে। বিশেষ করে শসায় ৫০ শতাংশ, টমেটোতে ৪০ শতাংশ, বেগুন ও ফুলকপিতে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ, আর বাঁধাকপিতে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ পরিমাণে এসব অবশিষ্টাংশ পাওয়া গেছে।
পরিবেশে বালাইনাশকের ছড়িয়ে পড়া এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে অধ্যাপক বলেন, বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে এগুলো মাটিতে, ভূগর্ভস্থ পানিতে, পুকুর-নালা বা খালে ছড়িয়ে পড়ছে। কিছু উদ্বায়ী বালাইনাশক বাতাসে মিশে দূর দূরান্তে পৌঁছায়, আবার কিছু রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। দীর্ঘ সময় ধরে স্থায়ী থেকে এসব পদার্থ পরিবেশে দূষণ সৃষ্টি করে। এতে করে মাটির উর্বরতা রক্ষাকারী কেঁচো, মাইট, ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া মারা যায় এবং জলজ প্রাণী, মাছ এমনকি পরাগায়নের জন্য প্রয়োজনীয় মৌমাছিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বাংলাদেশের বর্তমান বালাইনাশক ব্যবস্থাপনা নীতিমালার মূল ঘাটতি নিয়ে তিনি বলেন, নিম্নমানের ও চোরাই বালাইনাশক সহজে বাজারে পাওয়া যায়, মনিটরিং ব্যবস্থা খুবই সীমিত। কৃষকরা সঠিক ডোজ সম্পর্কে জানেন না, ডিলারদের ওপর নির্ভর করেন, এবং অনেকের হাতে স্মার্টফোন থাকলেও সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারেন না। তাই সরকারিভাবে গণমাধ্যমে সচেতনতামূলক কার্যক্রম বাড়ানো জরুরি।
বালাইনাশকের বিকল্প হিসেবে বর্তমানে মাঠপর্যায়ে কার্যকর প্রযুক্তি নিয়ে গবেষক শাহজাহান জানান, এই পরিস্থিতিতে বিকল্প হিসেবে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (IPM) পদ্ধতি কার্যকর প্রমাণিত হচ্ছে। জমি প্রস্তুতির সময় ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন এনে এবং জৈব বালাইনাশক বা বায়ো এজেন্ট ব্যবহার করে পোকামাকড় কমানো যায়।
বাংলাদেশে উদ্ভাবিত ‘ট্রাইকোডারমা’ ছত্রাকনাশক হিসেবে উল্লেখযোগ্য, যা সঠিকভাবে ব্যবহার করলে রাসায়নিক বালাইনাশকের ব্যবহার অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব। এছাড়া অণুজীব বালাইনাশক ও প্রাকৃতিক উদ্ভিদ নির্যাসও কার্যকর। একই ফসল বারবার না করে বৈচিত্র্য আনা গেলে রোগবালাইও কমবে।
এদিকে বাকৃবির ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন গবাদিপশু ও মানবদেহে কীটনাশকের প্রভাব।
তিনি বলেন, গবাদি পশু কীটনাশকের সংস্পর্শে আসে প্রধানত দুইভাবে-সরাসরি ও পরোক্ষভাবে। সরাসরি সংস্পর্শ ঘটে যখন পশু খোলা পরিবেশে অবস্থান করে এবং বাতাসের মাধ্যমে ছড়ানো কীটনাশক শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে। পেস্টিসাইডের মাত্রা যদি পশুর সহনশীলতার বাইরে যায়, তাহলে তাদের শরীরে বিভিন্ন বিষক্রিয়াজনিত উপসর্গ দেখা দেয়।
অন্যদিকে, পরোক্ষ সংস্পর্শ ঘটে যখন পশু কীটনাশকযুক্ত ঘাস, খড় বা শস্যবর্জ্য খায়, যেগুলোতে অবশিষ্টাংশ থেকে যায়। দীর্ঘমেয়াদে এসব কীটনাশক শরীরে জমা হয়ে কিডনি ও লিভার নষ্ট করতে পারে, ইমিউন সিস্টেম দুর্বল করে, প্রজনন ক্ষমতা কমিয়ে দেয় এবং দুধ ও মাংস উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ফলস্বরূপ, পশুর উৎপাদন কমে যায়, মাংসের গুণগত মান ও পরিমাণ হ্রাস পায়, দুধ উৎপাদন কমে যায়।
এসব রাসায়নিক পদার্থ মানব শরীরে পৌঁছালে কি ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি বা জুনোটিক রোগ সৃষ্টি হতে পারে এমন প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক বলেন, কীটনাশক শরীরে প্রবেশ করে এসিডিক আকারে চর্বি টিস্যুতে জমা হয় এবং ইমিউন সিস্টেম ধ্বংস করতে শুরু করে। এটি লিভার ও কিডনির কার্যক্ষমতা ব্যাহত করে, ফলে শরীরের বিষাক্ত পদার্থ বের করে দেওয়ার প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এতে রক্ত তৈরি, বোন ম্যারো ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়। স্পার্ম ও ডিম্বাণু তৈরির প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হওয়ায় প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পায়। এছাড়া, মানসিক ভারসাম্যহীনতা, কোষে মিউটেশন এবং ক্যান্সারের ঝুঁকিও অনেক বেড়ে যায়। বলা হয়ে থাকে, অন্যান্য সাধারণ টক্সিক সাবস্ট্যান্সের তুলনায় পেস্টিসাইডের মিউটেশন ক্যাপাসিটি ৫১ থেকে ৯১ গুণ বেশি, যা অত্যন্ত ভয়াবহ।
সবশেষে অধ্যাপক শফিকুল বলেন, গবেষণা বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রাণিসম্পদ এবং জনস্বাস্থ্যকে ঝুঁকি মুক্ত করতে বাংলাদেশ সরকারকে গবেষণায় অতিরিক্ত বরাদ্দ দিয়ে প্রাণিসম্পদ খাতকে আরও গবেষণামুখী করতে হবে।
এআর