• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ভুলে ভরা বাংলাদেশ ব্যাংকের বিজ্ঞপ্তি, আস্থা বিএসইসিতেই


নিজস্ব প্রতিবেদক ডিসেম্বর ৩, ২০২১, ০১:০১ পিএম
ভুলে ভরা বাংলাদেশ ব্যাংকের বিজ্ঞপ্তি, আস্থা বিএসইসিতেই

ঢাকা: বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এ্ক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) বৈঠকের পর সংস্থাটির পক্ষ থেকে দেয়া বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিজ্ঞপ্তি নিয়ে অস্থিরতা চলছে। তবে এ ইস্যুতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বিএসইসিতেই।

গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বিএসইসির মধ্য শেয়ারবাজারের সমসাময়িক বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে বৈঠক হয়। ওই বৈঠকের পর বিএসইসির পক্ষ থেকে দেয়া বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে একটি বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যেখানে বিএসইসির বরাত দিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত খবরটি সঠিক নয় বলে দাবি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে শেয়ারবাজার বিশ্লেষকদের মতে ওই বিজ্ঞপ্তিটি ছিলো ভুলে ভরা।

শেয়ারবাজার বিশ্লেষকরা বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই বিজ্ঞপ্তিতে অন্তত ৯টি ভুল রয়েছ বলে মনে করছেন। তাতে আরো অস্থির হয়ে পড়েছে বাজার। তবে বিনিয়োগকারীরা আস্থা রাখছে বিএসইসির উপর। যার প্রমাণ বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই বিজ্ঞপ্তির পর সর্বশেষ কার্যদিবস বৃহস্পতিবারই (২ ডিসেম্বর) স্পষ্ট দেখা গেছে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের বিজ্ঞপ্তিতে শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টদের চোখে প্রথম ভুল হলো দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠক গণমাধ্যমে প্রকাশ করা। এটা সমীচীন হয়নি। দ্বিতীয় ভুল হলো ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, শেয়ারবাজারকে প্রভাবিত করে এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে ( এনবিআর ) শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির সঙ্গে আলোচনা করতে হবে।

তবে গণমাধ্যমে পাঠানো এই বিজ্ঞপ্তির বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির সঙ্গে কোনো আলোচনা করেছে বলে জানা যায়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বিজ্ঞপ্তি।

এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিজ্ঞপ্তির প্রথম প্যারার চতুর্থ লাইনে ‘সৃষ্ট জটিলতা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। যা সমীচীন নয়। কেননা ইন্টারন্যাশনাল একাউন্টিং স্টান্ডার্ড ( আইএএস ) এ বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া রয়েছে। তাতে বলা হয়েছে ফ্রি রিজার্ভ থাকলে যে কোনো লভ্যাংশ দেওয়া যেতে পারে। সংশ্লিষ্ট বছরে লোকসান হওয়া সত্ত্বেও লভ্যাংশ দেওয়া যাবে। এটা ছিলো তৃতীয় ভুল।

চতুর্থ ভুলটি করেছে দ্বিতীয় প্যারার চতুর্থ লাইনে। সেখানে উল্লেখিত ‘আইনসম্মত নয়’ বলে বাংলদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে পাঠানো ওই বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে, যেটি সঠিক নয়। কেননা ১৯৬৯ সালের অর্ডিন্যান্সের টু সি সি ধারা অনুযায়ী শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট যে কোনো আইন প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন করতে পারবে। যা অন্য কোনো আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলেও টু সি সি ই প্রয়োগ হবে। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘আইনসম্মত নয়’ এ কথাটি সঠিক হয়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই চিঠির তৃতীয় প্যারার তৃতীয় লাইনে লেখা হয়েছে বিএসইসিকে ‘স্পষ্টীকরণ’ করা হয়। একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে আরেকটি নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে এধরণের ভাষা প্রয়োগ বিএসইসির কর্মকর্তাদের অজ্ঞতাকে ইঙ্গিত করে। যা ছিল শিষ্টাচার বহির্ভূত শব্দ। বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন এটাও একটা ভুল বার্তা দেয় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে। যা ছিল পঞ্চম ভুল।

মঙ্গলবার (৩০ নভেম্বর) অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বিএসইসিকে ডেকে নেওয়া হয়। মিটিং শেষে যৌথ প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে বিষয়টি গণমাধ্যমকে জানানো যেতো। কিন্তু বিএসইসির কমিশনার সামছুদ্দিন আহমেদ একা গণমাধ্যমের সামনে কথা বলেন। তিনি বলেছেন আলোচনা হচ্ছে , আলোচনা হবে। সমাধান আসবে। এর পাল্টা ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এ ধরণের একটি চিঠি দিয়েছে। তাতে বাজারে ভুল বার্তা গেছে। ষষ্ঠ ভুল ছিলো এটি। যার কারণে বাজার আরো অস্থির হয়ে উঠেছে।

দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওপরেও ছিলো অর্থ মন্ত্রণালয়। কোনো কারণে মতপার্থক্য দেখা দিলে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসি অর্থ মন্ত্রণালয়ের শরণাপন্ন হতে পারতো। তাহলে স্পর্শকাতর শেয়ারবাজার ভুল বার্তা থেকে রক্ষা পেতে পারতো। শেয়ারবাজার সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তিটি সরাসরি মিডিয়াকে দেওয়া হয়েছে। যার কোনো অনুলিপি বা কপি বিএসইসি বা অর্থ মন্ত্রণালয়কে দেওয়া হয়নি। এটি ছিলো প্রক্রিয়াগত ত্রুটি। এটি ছিলো সপ্তম ভুল।

চিঠির ভাষা প্রয়োগে অপেশাদারিত্বের ছাপ স্পষ্ট। যেখানে শিষ্টাচারের ঘাটতি প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। চতুর্থ প্যারার শেষ লাইনে লেখা হয়েছে বিএসইসির বরাত দিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের যে কথা বলা হয়েছে তা সঠিক নয়। একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রতি আরেকটি নিয়ন্ত্রক সংস্থার আস্থার ঘাটতি বা সমন্বয়হীনতা বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি ছায়েদুর রহমান এ বিষয়ে গণমাধ্যমে জানিয়েছেন, বিএসইসির কমিশনার সামছুদ্দিন আহমেদ সেদিন ( ৩০ নভেম্বরের) মিটিং থেকে বেরিয়ে বলেছেন আলোচনা হয়েছে, আরো হবে। একটা সমাধান বেরিয়ে আসবে। তাতে এধরণের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া কি ঠিক হলো? এটা আমাদের হতাশ করেছে। এটা নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর অভ্যান্তরীন বিষয়। এটা এভাবে পাবলিক হওয়া ঠিক হলো না। পরষ্পরের বিরুদ্ধে এভাবে প্রচারণা শ্রদ্ধাবোধের অভাবকে প্রকট করে তোলে। যার যার আইন অনুযায়ী কাজ করবে । বাইরে বলে বেড়ানোর বিষয় নয়। এতে বিনিয়োগকারীরা আস্থাহীন হয়ে পড়েন। এধরণের চিঠির ভুলের প্রভাব বাজারকে আরো অস্থির করে তোলে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ব্রোকারেজ এসোসিয়েশনের(ডিবিএ) সভাপতি শরীফ আনোয়ার হোসেন বলেন, ওই বিজ্ঞপ্তিটা পড়েছি। তাতে মনে হয়েছে ভাষার সৌন্দর্য ছিল না। পারস্পরিক সৌজন্য বোধের ব্যাপক ঘাটতি ছিলো।

শেয়ারবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, শেয়ারবাজারের সেকেন্ডারি মার্কেটে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগসীমা ২৫ শতাংশ থাকার যে নিয়ম রয়েছে তার সুস্পষ্ট ব্যাখা দরকার। শেয়ার ক্রয়কালীন দর ধরে বিনিয়োগসীমা ধরা হবে না বাজারদর ধরে তা নির্ধারণ হবে তা স্পষ্ট করা উচিত। এ বিষয়ে গ্লোবাল স্টান্ডার্ড রয়েছে। সেটা অনুসরণ করা যেতে পারে। এটা যদি পার্লামেন্টের আইন দ্বারা নির্ধারিত হয়ে থাকে তবে আইন সংশোধন করতে হবে। যদি বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী নির্ধারণ করা হয়ে থাকে তবে পরিবর্তন বা ব্যাখা দেওয়া উচিত। দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার টাগ অব ওয়ার দরকার কি। অর্থ মন্ত্রণালয় তো রয়েছে। এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ই সিদ্ধান্ত নিতে পারে। অবশ্য আগামী ৭ ডিসেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ের বৈঠক হবে বলে খবর বেরিয়েছে। তাতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সঞ্চার হয়েছে এবং এ কারণে বৃহস্পতিবারের বাজার ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে বলে মন্তব্য করেন আবু আহমেদ।

এ বিষয়ে চেষ্টা করা হলেও বিজ্ঞপ্তি প্রদানকারী বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র ও মহাব্যবস্থাপক আবুল কালামের কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

এরকম পরিস্থিতিতে বাজার যদিও অস্থির আচরণ করেছে তবে দিন শেষে বিনিয়োগকারীরা বিএসইসির প্রতি আস্থা দেখিয়েছেন। প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে মোট ৩৬৪টি কোম্পানির ৩৩ কোটি ৪৯ কোটি ৬২ হাজার ৫০৫টি শেয়ার ও মিউচুয়াল লেনদেন হয়েছে। মোট লেনদেনের পরিমাণ ছিলো ১ হাজার ২৪৫ কোটি ১৯ লাখ ৫৯ হাজার ৯৯০ টাকা। আগের দিনের চেয়ে ৮৯.২০ পয়েন্ট বেড়েছে ডিএসইসি ব্রড ইনডেক্স ডিএসইএক্স। তাতে সূচক দাড়িয়েছে ৬৯৩৬.২০ পয়েন্টে। লেনদেন হওয়া কোম্পানির মধ্যে দাম বেড়েছে ২০৮টির। কমেছে ১১৮টির। অপরিবর্তিত রয়েছে ৪৮টির।

সোনালীনিউজ/এমএইচ

Wordbridge School
Link copied!