• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়ে জর্জরিত ডায়মন্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স


আবদুল হাকিম মে ৩০, ২০২৩, ০৬:৪১ পিএম
অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়ে জর্জরিত ডায়মন্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স

ঢাকা: অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়, ১০০ টাকা প্রিমিয়াম সংগ্রহে ৯৪.৭৩ টাকা খরচ, জীবন বীমা তহবিল ও যথাযথ সম্পদ সংরক্ষণ, শেয়ারবাজারে তালিকাভূক্তির শর্ত ভঙ্গ, নবায়ন প্রিমিয়ামের হার কমসহ নানা কারণে ধীরে ধীরে দূর্বল হয়ে পড়ছে নতুন প্রজন্মের জীবন বীমা কোম্পানি ডায়মন্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিডেট।

প্রতি বছর কোম্পানিটির নতুন বীমা পলিসির সিংহভাগ তামাদি হয়ে যাচ্ছে। জীবন বীমা তহবিল ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। এতে ভবিষ্যতে বীমা কোম্পানিটি গ্রাহকদের দাবি পরিশোধে ব্যর্থ হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে কোম্পানিটি অস্তিত্ব সংকটে পড়তে পারে বলে মনে করছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)।

গতবছর আইডিআরএ’র নির্বাহী পরিচালক হারুন-অর-রশিদের সার্বিক তত্ববধানে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সংস্থাটির পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলমকে কমিটির প্রধান এবং মুহাম্মদ শামছুল আলমকে সদস্য করে এই তদন্ত কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। আইডিআরএ’র প্রতিবেদনে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৭-২০২১ সাল পর্যন্ত ডায়মন্ড লাইফের অনুমোদিত ব্যবস্থাপনা ব্যয় ছিল ৫০ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। কিন্তু মোট ব্যয় হয়েছে ৬২ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। অর্থাৎ অতিরিক্ত ব্যয় করেছে ১২ কোটি টাকা বা ২৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ। কোম্পানিটি সবমিলিয়ে গড়ে পাঁচ বছরে ব্যবস্থাপনা ব্যয় বাবদ অনুমোদিত সীমার প্রায় ২৪ দশমিক ২৭ শতাংশ বেশি খরচ করেছে।

তদন্ত দল বলছে, ডায়মন্ড লাইফ ১০০ টাকা প্রিমিয়াম সংগ্রহ করতে গড়ে ৯৪ টাকা ৭৩ পয়সা ব্যয় করেছে। এর ফলে কোম্পানিটি জীবন বীমা তহবিল তৈরি করতে ব্যর্থ হচ্ছে এবং সম্পদও বাড়ছে না। কোম্পানিটির ২০১৭ সালে অনুমোদিত ব্যবস্থাপনা ব্যয় ছিল দুই কোটি ৩৯ লাখ টাকা। ওই বছর কোম্পানিটি অতিরিক্ত ২১ দশমিক ৩২ শতাংশ ব্যয় করেছে। ২০১৮ সালে অনুমোদিত ব্যবস্থাপনা ব্যয় যা ছিল, তার অতিরিক্ত ৪৫ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ ব্যয় করে। তবে ২০১৯-২১ সাল পর্যন্ত অনুমোদিত সীমার অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয় কিছুটা কমিয়ে আনতে সক্ষম হলেও তা সীমার অতিরিক্তই রয়ে গেছে। ২০২১ সালে অতিরিক্ত ব্যয়ের হার দাঁড়িয়েছে ১৪ দশমিক ৯১ শতাংশ।

২০১৪ সালে ডায়মন্ড লাইফের প্রতিষ্ঠার পর ২০২১ সাল পর্যন্ত কোম্পানিটির সর্বমোট সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা। কিন্তু ২০১৭ সালে সম্পদ ছিল ৫ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। এরপর থেকে সম্পদ ধারাবাহিকভাবে কমছে। কোম্পানি ২০১৭ সালে বিনিয়োগ করেছে ১২ কোটি ২০ লাখ টাকা, যা ২০২১ সালে দাঁড়িয়েছে ১২ কোটি ৮৪ লাখ টাকায়। বিনিয়োগ বৃদ্ধির হার খুবই ধীরগতির। প্রতি বছর বিনিয়োগ বেড়েছে মাত্র ১ দশমিক ৩০ শতাংশ হারে। এসব বিনিয়োগ থেকে রিটার্ন এসেছে গড়ে ৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ।

এদিকে প্রতিষ্ঠার প্রায় ৯ বছর পার হলেও ডায়মন্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের জীবন বীমা তহবিল এখন ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। ২০১৭ সালে কোম্পানিটির জীবন বীমা তহবিলের পরিমাণ ছিল ঋণাত্মক ৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা, যা ২০২১ সালে দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ৭২ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত কোম্পানি কোনো জীবন বীমা তহবিল দেখাতে পারেনি।

ডায়মন্ড লাইফের নবায়ন প্রিমিয়ামের ক্ষেত্রে দেখা যায়, ২০১৭ সালে প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আদায় হয়েছে ১১ কোটি ২২ লাখ টাকা। ২০১৮ সালের প্রিমিয়াম নবায়ন হয়েছে ১ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ মাত্র ১৩ দশমিক ৯৯ শতাংশ নবায়ন হয়েছে। আর বাকি পলিসিগুলো তামাদি হয়ে গেছে। একইভাবে ২০২০ সালে আদায়কৃত প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম ৯ কোটি ৬৫ লাখ টাকার মধ্যে ২০২১ সালে ১৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ নবায়ন হয়েছে। টাকার অঙ্কে এটি ১ কোটি ৮১ লাখ টাকা। ২০১৭-২০২১ সাল পর্যন্ত গড়ে প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম নবায়নের হার ছিল মাত্র ১৬ দশমিক ৫৩ শতাংশ, যা হতাশাজনক বলে মনে করছে আইডিআরএর তদন্ত দল।

২০১৭ সালে কোম্পানির নতুন ইস্যুকৃত ও পুনরায় সচল পলিসির সংখ্যা ছিল ৯ হাজার ১২৬টি, এর মধ্যে তামাদি হয়েছে ২ হাজার ৮৬৮টি অর্থাৎ ৩১.৪৩ শতাংশ পলিসি তামাদি হয়েছে। ২০১৮ সালের তামাদি পলিসির হার আরও বৃদ্ধি পায়। এই ধারা ২০২১ সাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। ২০১৮ সাল থেকে পলিসি তামাদি হওয়ার প্রবণতা ৫০ শতাংশ বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। গড়ে প্রতি বছর কোম্পানির পলিসি তামাদি হয়েছে ৫২ দশমিক ১৫ শতাংশ। তামাদি পলিসির সংখ্যা কমাতে কোম্পানিটি সফল হতে পারছে না।

প্রতিষ্ঠার দশ বছর পর থেকে কোম্পানিটি পলিসির মূল দায় পরিশোধ শুরু হবে। তাই ডায়মন্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সকে ২০২৪ সালে গ্রাহকের দায় পরিশোধে আর্থিকভাবে সক্ষম হতে হবে। কিন্তু কোম্পানির কোনো জীবন বীমা তহবিল নেই। ২০১৭ সালে কোম্পানির জীবন বীমা তহবিল ছিল ঋণাত্মক ৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা, সম্পদ ছিল ৫ কোটি ৭৬ লাখ টাকা ও দায় ছিল এক কোটি ৪৯ লাখ টাকা। ২০২১ সালে জীবন বীমা তহবিল দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ৭০ লাখ টাকা আর সম্পদ রয়েছে তিন কোটি ৭০ লাখ টাকার। সেখানে দায় রয়েছে ২ কোটি ৩০ লাখ টাকা। গ্রস প্রিমিয়াম ও অন্যান্য আয়ের চেয়ে মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়ের কারণে কোম্পানি অদ্যাবধি জীবন বীমা তহবিল সংরক্ষণ করতে পারেনি।

কোম্পানির প্রত্যক্ষ ব্যয়ের মধ্যে ২০১৭ সালে মোট কমিশন ও উন্নয়ন কর্মকর্তাদের বেতন প্রদান করেছে ৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা, প্রিমিয়াম আদায় করেছে ১৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। এখানে কোম্পানির অতিরিক্ত কমিশন ব্যয় করেও কাঙ্কিক্ষত পলিসি বা নবায়ন আনতে ব্যর্থ হচ্ছে। কোম্পানির আর্থিক অবস্থা নাজুক হওয়ার পরেও কোম্পানির ২২টি গাড়ি রয়েছে যার জন্য ২০২১ সালে ৩৪ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে।

এদিকে, ডায়মন্ড লাইফের তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে শুনানি শেষে বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ ৮টি নির্দেশনা দিয়েছে। নির্দেশনাগুলো হলো- দ্বিতীয়বর্ষে পলিসি নবায়নের হার ৭০ শতাংশে উন্নীত করতে হবে, তামাদি পলিসির সংখ্যা বা হার কমাতে হবে, গাড়ি সংক্রান্ত ব্যয় কমাতে হবে, ৩০ শতাংশ ব্যবস্থাপনা ব্যয় কমাতে হবে (কমিশন বাদে), কোম্পানির ব্যবস্থাপনা ব্যয় কমিয়ে লাইফ ফান্ড বাড়াতে হবে, গ্রস প্রিমিয়াম আয় বাড়াতে হবে, দ্রুত বিমা দাবি পরিশোধ করে বিমা দাবি পরিশোধের হার বাড়াতে হবে, বিনিয়োগ রিটার্নের হার বাজার সুদের হারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে।

এ বিষয়ে আইডিআরএ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারী বলেন, আমরা বেশ কয়েকটি কোম্পানির বিরুদ্ধে তদন্ত করে সমস্যা পেয়েছি। ইতিমধ্যে কয়েকটি কোম্পানির শুনানি হয়েছে এবং ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আমরা কোম্পানিগুলোকে নিয়মের মধ্যে আনার চেষ্টা করছি। কোম্পানির ব্যয় কমানো, প্রিমিয়ামের নবায়ন বৃদ্ধি, লাইফ ফান্ড ও সম্পদ সংরক্ষণের বিষয়ে কাজ করছি। অনেকগুলো কোম্পানি আছে যারা প্রথম বছর প্রিমিয়াম গ্রহণের পর দ্বিতীয় বছর আর পলিসি সচল রাখতে পারছে না। প্রথম বছরের প্রিমিয়ামের বেশিরভাগই কমিশনসহ নানা কারণে খরচ হয়ে যায়। এজন্য কেন সমস্যা হচ্ছে তার বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা নিচ্ছি। এরপর প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছি।

ডায়মন্ড লাইফের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পিপলু বিশ্বাস সোনালী নিউজকে বলেন, নতুন কোম্পানি হিসেবে আমাদের কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। শুরুর দিকে যারা ছিলেন তাদের অধিকাংশই এখন নেই। অনেক এজেন্ট কোম্পানি ছাড়ার পর বড় সংখ্যক পলিসি তামাদি হয়ে গেছে। এসব কারণে কিছুটা সমস্যা হয়েছে। তবে আমরা ওভারকাম করতে প্রাণান্তকর চেষ্টা করছি। আশা করছি, আগামী বছরের মধ্যে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা ব্যয় থেকে শুরু করে প্রিমিয়াম সংগ্রহের ব্যয় কমে আসবে।

তিনি বলেন, এই মূহুর্তে আমরা গ্রাহক সেবায় বেশি মনোযোগ দিচ্ছি। আইডিআরএ একটি শুনানি হয়েছে যেখানে আমাদেরকে কিছু নির্দেশনা দিয়েছে। আমরা সে আলোকে কাজ করছি।

সোনালীনিউজ/এএইচ/আইএ

Wordbridge School
Link copied!