ফাইল ছবি
গত কয়েক মাসে বাংলাদেশের স্বর্ণবাজারে দাম বাড়া কমা অনির্বচনীয় রূপ নিয়েছে। কখনো প্রতি ভরি (২২ ক্যারেট) সোনার দাম ২ লাখ ১৭ হাজার টাকার ওপর উঠে যাচ্ছে, আবার কয়েক দিন পরই হঠাৎ বিক্রি মূল্য কমিয়ে ১ লাখ ৯০–৯৫ হাজার টাকায় নেমে আসছে। এই ওঠানামা শুধু সাধারণ গ্রাহক বা গয়না-ক্রেতাদের জন্যই নয়, বিনিয়োগকারীদের জন্যও রহস্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্বব্যাপী বাজারে স্বর্ণের দর বেসরকারি নয়। বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকট, রাজনৈতিক উত্তেজনা, মুদ্রাস্ফীতি, বা বৈশ্বিক অর্থনীতির অনিশ্চয়তা-এসবই স্বর্ণকে একটি “নিরাপদ অর্থ” হিসেবে তুলে নিয়ে যায়। ফলে, যখন এমন সংকট দেখা দেয়, আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দর বাড়ে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশেও সেই উঠতি দর প্রতিফলিত হয়।
বাংলাদেশে স্বর্ণের বেশিরভাগ আমদানি হয় বিদেশ থেকে। তাই বিদেশি মুদ্রার সঙ্গে টাকার বিনিময় হার (ডলারের মান) বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে, আমদানির খরচ বাড়ে। আমদানির ভ্যাট, শুল্ক, পরিবহন ও রপ্তানিমূল্য যুক্ত হলে দিনের শেষে দোকানদারের ইউনিট খরচ বাড়ে-আর সেটি গ্রাহকে দিতে হয়।
বাংলাদেশে স্বর্ণের পাইকারি বাজার, রিফাইনিং, গয়না উৎপাদন আর গোল্ড-জুয়েলারি চেইন অনেক অংশে বিদেশি মার্কেটের ওপর নির্ভরশীল। রূপান্তর ও পরিবহন খরচ, রূপের দামের পার্থক্য, মুনাফা-সব মিলিয়ে দেশি বাজার বৈশ্বিক দামের ওঠা-নেমার সঙ্গে সময় নিয়ে সাড়া দেয়। কখনো দাম কমানো হয় ইচ্ছাকৃত মুনাফা কমান বা বিক্রয় বাড়ানোর জন্য।
অস্থির অর্থনৈতিক সময়, মুদ্রাস্ফীতি ও দামের উত্থান-পতনে মানুষ সোনাকে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে দেখেন। তাই বিনিয়োগমূল্য হিসাবে সোনা কেনা বেড়ে যায়। আর যখন এই চাহিদা হ্রাস পায়-উদাহরণস্বরূপ, সুদের হার বাড়লে ব্যাংক বা অন্যান্য বিনিয়োগ আকর্ষণীয় হলে-তখন সোনার চাহিদা কমে যায়, এবং দাম নেমে যেতে পারে।
ক্রেতা হিসেবে খেয়াল রাখতে হবে, আগে কেনা ও পরবর্তীতে বিক্রিতে খুবই সতর্ক হতে হবে। অস্থির দামের সময় দ্রুত গহনা কেনা বা বিক্রি করা মানে হয়তো ভালো দামে কিনতে পারছেন, কিন্তু দাম কমার সময় মুনাফা বা রিটার্ন কম। বিনিয়োগ হিসেবে যারা সোনায় অর্থ রেখেছেন, তাদের জন্য ঝুঁকি স্পষ্ট। এমন সময় পোর্টফোলিওতে বৈচিত্র্য রাখাও জরুরি (যেমন: রিয়েল এস্টেট, স্থাবর সম্পদ, ব্যাংক সঞ্চয়-সব মিশ্র করা)। গয়না হিসেবে কেনার সময় বুঝে-চিন্তে-দিনের দর, ভ্যাট, মুনাফা, ওয়ারিশ সংক্রান্ত কাগজপত্র সব মিলিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
স্বর্ণের দাম বাড়া-কমা একটি অভ্যন্তরীণ এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ডায়নামিক্সের মিশ্র প্রতিফলন। কখনো আন্তর্জাতিক বাজার ও মুদ্রা বিনিময়-ভুলচক্র একত্রে প্রভাব ফেলে, কখনো দেশের বাজারের কাঠামোগত খামতি। তবে বিনিয়োগ, গয়না চাহিদা ও ব্যবসায়ীদের মুনাফার স্বার্থ-এসব কিছুর মধ্যে গতানুগতিক লেনদেন ও স্পেকুলেশনেরও ভূমিকা থাকতে পারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভবিষ্যতে বৈশ্বিক অর্থনীতির অনিশ্চিয়তা, মুদ্রাস্ফীতি এবং টাকার মান অবনতি বজায় থাকলে-বাংলাদেশে স্বর্ণের মূল্য আপাতত ক্রমাগত ওঠানামার মধ্যে থাকবে। অর্থাৎ, “সোনা এখন আর নিরাপদ আশ্রয় নয়, সোনা এখন একটি ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগও।”
বর্তমানে, গহনা হিসেবে প্রতিটি ক্রেতা ও বিনিয়োগকারীকে সচেতন থাকতে হবে-বাজারের তাঁদের চাহিদা এবং দামের গতিপ্রকৃতি পর্যালোচনা করে সুযোগ-ঝুঁকি মেনে সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি।
এসএইচ







































