• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
৮ উপজেলায় ‘ভয়াল রূপ’

৫০ বছরেও এত পানি দেখেনি সিলেট-সুনামগঞ্জের মানুষ


নিজস্ব প্রতিবেদক জুন ১৭, ২০২২, ০৩:১৯ পিএম
৫০ বছরেও এত পানি দেখেনি সিলেট-সুনামগঞ্জের মানুষ

সিলেট: সিলেট ও সুনামগঞ্জের ৮ উপজেলায় বন্যা ভয়াল রূপ নিয়েছে। সিলেট জেলার ৫টি এবং সুনামগঞ্জের তিনটি উপজেলা পুরোপুরি প্লাবিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন দুই জেলার জেলা প্রশাসকেরা। পানিতে ভেসে যাচ্ছে অনেক কাঁচা ঘর-বাড়ি। মানুষজন ছুটছেন আশ্রয় কেন্দ্রের সন্ধানে। নৌকা সংকটে ব্যাহত হচ্ছে বানভাসি লোকজনকে উদ্ধার কার্যক্রম। বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ রাখা হয়েছে। জেলা সদরের সাথে এসব উপজেলার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।

ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বৃষ্টিপাতে সৃষ্ট পাহাড়ি ঢলে এই অঞ্চলে বলতে গেলে প্রায় প্রতি বছরই বন্যা হয়। তবে এত পানি বিগত ৫০ বছরেও দেখেনি সেখানকার মানুষ।

এমন পরিস্থিতিতে শুক্রবার (১৭ জুন) বন্যার্তদের উদ্ধারে সেনাবাহিনী নামানো হয়েছে।

জানা গেছে, সিলেটের সিলেট সদর, কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর ও কানাইঘাট ও সিলেট সদর উপজেলা পুরোপুরি প্লাবিত হয়েছে। পানি প্রবেশ করেছে নগরীর নিচু এলাকায়ও। এছাড়া, সুনামগঞ্জের ছাতক, দোয়ারাবাজার উপজেলা ও সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম বন্যায় পুরোপুরি প্লাবিত। এসব উপজেলা সদরে রীতিমতো নৌকা চলাচল করছে। লোকজন ছুটছেন আশ্রয় কেন্দ্রের সন্ধানে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড(পাউবো)-এর বুলেটিনে জানানো হয়, সুরমা নদী সিলেট পয়েন্টে বিপদসীমার ৪৪ সেন্টিমিটার, কানাইঘাটে সুরমা ৯৫ সেন্টিমিটার, ফেঞ্চুগঞ্জে কুশিয়ারা বিপদসীমার ৩৪ সেন্টিমিটার এবং সারি নদী বিপদসীমার ৫৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

সিলেটের জেলা প্রশাসক মো: মজিবর রহমান দ্বিতীয় দফা বন্যা পরিস্থিতিকে ‘ভয়াবহ সংকট’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, বন্যায় জেলার ৫টি উপজেলা পুরোপুরি প্লাবিত। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৩টায় জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির জরুরী বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তিনি সকলকে ধৈর্য্য সহকারে পরিস্থিতি মোকাবেলার পরামর্শ দেন।

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো: জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, বন্যায় ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলা পুরোপুরি প্লাবিত হয়েছে। সুনামগঞ্জ পৌর এলাকার কিছু অংশ ছাড়া সুনামগঞ্জ জেলা শহর পুরোপুরি পানির নিচে। এছাড়া, বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুরের নিচু এলাকাও বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। বন্যার্ত লোকজন আশ্রয় কেন্দ্রের সন্ধানে ছুটছেন। সুনামগঞ্জে এ পর্যন্ত ৩২০ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ৯ লক্ষ টাকা বিতরণ করা হয়েছে বলে জানান জেলা প্রশাসক।

সিলেটের জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম জানান, সিলেট জেলায় এ পর্যন্ত ৪৩২ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। ৫টি উপজেলা পুরোপুরি প্লাবিত হয়েছে। জেলার বাকি এলাকা আংশিক প্লাবিত হয়েছে।

সুনামগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিক গতকাল বৃহস্পতিবার সুনামগঞ্জের ছাতক, দোয়ারাবজার ও সুনামগঞ্জ জেলা সদরসহ বন্যা কবলিত বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখেছেন। রাতে তিনি জানান, ‘পরিস্থিতি খুবই খারাপ। মানুষ খুব বিপদে আছে।’ রাস্তা ডুবে যাওয়ায় সড়কপথে সরাসরি সিলেট আসতে পারেননি। রাতে বিকল্প পথে তিনি জগন্নাথপুর হয়ে সিলেটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন বলে জানান এ এমপি।

কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় ১৯৮৮, ১৯৯৮ ও ২০০৪ সালে ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল। চলমান বন্যা অতীত রেকর্ড ছাপিয়ে গেছে। হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে। ঘর ছেড়ে নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নিয়েছেন তারা। উপজেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আশ্রয় শিবিরে পরিণত করা হয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্র অথবা নিরাপদ স্থানে যাওয়ার জন্য কোন নৌকা না পেয়ে অনেকেই আটকা পড়েছেন। খাবার ও আশ্রয়ের জন্য তারা সহায়তার জন্য তাকিয়ে আছেন। বিদ্যুৎবিহীন, মোবাইল ব্যবহার করা যাচ্ছে না।

জানা গেছে, বৃহস্পতিবার (১৬ জুন) দুপুরে ধলাই নদীর পানি বিপৎসীমার ২৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানিয়েছে পাউবো।

বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত তলিয়ে গেছে উপজেলার কাঁচা-পাকা সকল রাস্তাঘাট। বিভিন্ন এলাকায় পানির তোড়ে ভেঙে পড়েছে রাস্তা ও বাঁধ।

সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ-ভোলাগঞ্জ বঙ্গবন্ধু মহাসড়কের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। ছাতকের সাথে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। উপজেলার সর্বত্র গোখাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। পানি উঠে যাওয়ায় স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসায় শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। দুর্গত এলাকায় বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে।

সিলেট জেলা বারের আইনজীবী ও কোম্পানীগঞ্জের মাজেরগাঁও গ্রামের বাসিন্দা আজমল আলী জানান, বন্যার পানিতে দয়ারবাজার-নয়াবাজার রাস্তা ভেঙ্গে গেছে। এ কারণে মাঝেরগাঁও, চরার বাজার ও ভাটরাইসহ অন্যান্য গ্রামে পানির চাপ বেড়েছে।

এদিকে, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বাসাসহ সরকারি সকল বাসভবনের নিচতলায় পানি প্রবেশ করেছে। উপজেলা ভূমি অফিস, থানা কম্পাউন্ড, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেক্স, এলজিইডি অফিস, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসসহ সরকারি-বেসরকারী সকল অফিসে কোমর সমান পানি।

উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ জহিরুল হক বলেন, পানি ঢুকে পড়ায় উপজেলার সকল স্কুলে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।

পল্লী বিদ্যুতের ডিজিএম মৃণাল কান্তি চৌধুরী বলেন, পুরো উপজেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বিচ্ছিন্ন রাখা হয়েছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রায়হান পারভেজ রনি বলেন, আগের বন্যায় ফসলের যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে। নতুন করে শাকসবজিসহ ১০০ হেক্টর ফসলি জমি পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার লুসিকান্ত হাজং বলেন, বন্যাদুর্গত লোকজন নির্ধারিত ৩৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন। বহু মানুষ স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। মানবিক সহায়তা হিসেবে ২৪ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আরও চাহিদা পাঠানো হয়েছে। বিতরণের জন্য শুকনো খাবার প্রস্তুত করা হয়েছে। ৩৬টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে।

গোয়াইনঘাটে পানিবন্দী মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছেন। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতেও উঠে যাচ্ছে পানি। উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়ে পড়েছে । উপজেলার ৯৮ ভাগ ঘর বাড়িতে পানি উঠেছে। কয়েক লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী রয়েছেন। বিভিন্ন ইউনিয়নে ৪০ টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সারি-গোয়ািনঘাট সড়ক, গোয়াইনঘাট-সালুটিকর সড়কসহ জেলা শহরের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। নদনদী দিয়ে বিপদ সীমার উপরে পানি প্রবাহিত হওয়ায় উপজেলাবাসীর মাঝে অজানা আতংক বিরাজ করছে। বিশেষ করে দিন মজুর ও নিম্ন আয়ের মানুষ পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অনেকের ঘরে খাবার নেই। আবার অনেকের ঘরে খাবার থাকলেও চুলা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় রান্না করে খাবার খেতে পারছেন না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হাট বাজার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় ব্যবসা বাণিজ্য ও পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। 

গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তাহমিলুর রহমান জানান, বিপদসীমার উপরে সারি ও ডাউকি নদীর পানি প্রবাহিত হচ্ছে। ৪০টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে।

জৈন্তাপুরে বন্যায় উপজেলার ৪টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পড়েছে। কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। বহু বসতবাড়ি রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে গেছে। সারী ও বড় নয়াগং নদীর পানি বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ী ঢলে নিজপাট, দরবস্ত, জৈন্তাপুর ও চারিকাটা ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলের রাস্তাঘাট স্কুল কলেজ পানিতে তলিয়ে গেছে। উপজেলার আসামপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ,ইমরান আহমদ মহিলা ডিগ্রি কলেজ বিরাইমারা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়,ডুলটিরপাড়া সহ আর অনেক স্কুলে পানিতে তলিয়ে গেছে।

নীচ এলাকার অনেকের বসতবাড়িতে পানি প্রবেশ করেছে। মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটে যাচ্ছেন। টানা বৃষ্টি পাতের ফলে জৈন্তাপুর উপজেলার জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।

উপজেলার নিচু এলাকার জনসাধারণকে সর্তক থাকতে বলা হয়েছে। উপজেলা প্রশাসন থেকে বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। বন্যায় স্কুলের অর্ধ বার্ষিকী পরীক্ষা স্থগিত সহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঘোষণা করা হয়েছে। 
জৈন্তাপুর, নিজপাট ইউনিয়নের বেশির ভাগ গ্রামে পানি প্রবেশ করায় জনসাধারণ কে নৌকা দিয়ে যাতায়াত করতে হচ্ছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আল বশিরুল ইসলাম জানান, সেখানে একটি জরুরী কন্ট্রোল রুম চালু করা হয়েছে। উপজেলায় ২৪ টি আশ্রয়ন কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। প্রশাসন পক্ষ থেকে ৬টি ইউনিয়নে ২৪ মেট্রিকটিন চালু বরাদ্ধ প্রদান করা হয়েছে।

এদিকে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কামাল আহমদ, উপজেলা নির্বাহী অফিসার আল বশিরুল ইসলাম, উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন সহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিগণ বন্যা প্লাবিত এলাকা পরিদর্শন করে অসহায় মানুষকে শুকনো খাবার দিয়ে সহযোগিতা করছেন। প্রশাসন থেকে ৫ শত প্যাকেট শুকনো খাবার দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ জৈন্তাপুর উপজেলাকে বন্যা দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবী জানিয়েছেন।

কানাইঘাটের বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। সরকারিভাবে উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন ও পৌরসভার বন্যা কবলিত এলাকার জন্য ৪০ মেট্রিক টন চাল ও ৫০ হাজার টাকার শুকনো খাবার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে বলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুমন্ত ব্যানার্জি জানিয়েছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে সরকারি ত্রাণ সামগ্রী স্ব স্ব ইউনিয়নে পাঠানোর পর বন্যার্তদের মাঝে বিতরণ করা হচ্ছে বলে তিনি জানান।

উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল মুমিন চৌধুরী ও নির্বাহী কর্মকর্তা কানাইঘাট সদর ইউনিয়ন ও লক্ষীপ্রসাদ পশ্চিম ইউনিয়নে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম বন্যা দুর্গত এলাকায় বানভাসি মানুষের মাঝে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করেছেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন, উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান খাদিজা বেগম, সদর ইউপি চেয়ারম্যান আফসার উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, লক্ষীপ্রসাদ পশ্চিম ইউপি চেয়ারম্যান মাও. জামাল উদ্দিন, মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম।

গত বুধবার থেকে কানাইঘাট উপজেলায় বন্যার পানি বাড়তে থাকে। সুরমা নদীর ভাঙ্গণ কবলিত বিভিন্ন ডাইক দিয়ে প্রবলবেগে পানি প্রবেশ করছে। কয়েক শতাধিক বাড়ি ঘরে বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। লক্ষীপ্রসাদ পশ্চিম, লক্ষীপ্রসাদ পূর্ব, ৫নং বড়চতুল, কানাইঘাট পৌরসভা ও সদর ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রামীণ রাস্তা-ঘাট পানির নিচে তলিয়ে গেছে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। কানাইঘাট-চতুল-দরবস্ত ও কানাইঘাট-সুরইঘাট সড়কের বিভিন্ন এলাকা বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সিলেট নগরীর সাথে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।

বিশ্বনাথে বৃষ্টি আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে ফের বন্যায় প্লাবিত হয়েছে উপজেলা লামাকাজী, খাজাঞ্চী, অংলকারী ও রামপাশা ইউনিয়ন। চার ইউনিয়নের মধ্যে বিশেষ করে লামাকাজী ও খাজাঞ্চী ইউনিয়নের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে লামাকাজী ও খাজাঞ্চী ইউনিয়নের সকল রাস্তাঘাট ও ফসলি জমি। প্লাবিত হয়েছে অনেক বাড়িঘর, হাটবাজার, গুচ্ছগ্রাম, ধর্মীয় উপসনালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পানিবন্দী পরিবারের মানুষ চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। অনেক ঘরে পানি প্রবেশ করায় খাবার রান্না করা তো দূরের কথা, পরিবারের সদস্যদের বিশ্রামের জায়গা নেই। এই ভয়াবহ অবস্থায় মানুষ দুর্বিষহ জীবন যাপন করছেন।

পানিবন্দী মানুষের আশ্রয়ের জন্য লামাকাজী ইউনিয়নে দিঘলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাহতাবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মির্জারগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, খাজাঞ্চী ইউনিয়নে বাওনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বন্ধুয়া সরকারি প্রাথমিক প্রাথমিক বিদ্যালয়, নোয়াগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, গোমরাগুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও তালিবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রামপাশা ইউনিয়নে আমতৈল সরকারি প্রাথমিক প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ভাটিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রস্তুত করা হয়েছে। উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক জরুরী সেবা গ্রহণে এসব আশ্রয় কেন্দ্রে ইতিমধ্যে পানিবন্দী অনেক মানুষ আশ্রয় নিলেও তা পর্যাপ্ত নয়। এছাড়া, এই আশ্রয় কেন্দ্রের বাইরে লামাকাজী ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স, আকিলপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দিঘলী স্বাস্থ্য কেন্দ্র, সৎপুর কামিল মাদ্রাসারা, লামাকাজী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, খাজাঞ্চী ইউনিয়নের আলহাজ্ব লজ্জাতুন নেছা দ্বি-পাক্ষিক উচ্চ বিদ্যালয় ও রহিমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বন্যা কবলিত অনেক মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন।

লামাকাজী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কবির হোসেন ধলা মিয়া বলেন, আমার ইউনিয়নের সকল মানুষ পানিবন্দী। মানবেতর জীবন যাপন করছেন অনেক মানুষ। ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রেসহ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছেন অনেক পরিবার। বৃহস্পতিবার সরকারের পক্ষ হতে বন্যার্তদেও মাঝে ৩ টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। এই ইউনিয়নকে বন্যা দুর্গত এলাকা ঘোষণা করে পর্যাপ্ত ত্রাণ প্রদান করতে সরকারের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্রতি দাবি জানান চেয়ারম্যান কবির হোসেন ধলা মিয়া।

খাজাঞ্চী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আরশ আলী গণি বলেন, আমরা ৫০ বছরের মধ্যে এত বড় বন্যা কখনো দেখিনি। রেল স্টেশনে পানি দেখা দূরের কথা, আজ রেল স্টেশনটিও পানিতে তলিয়ে গেছে। আমার ইউনিয়নের প্রাইমারি স্কুলগুলো নিচু,তারপরও পানিবন্দী মানুষকে উচু বিদ্যালয়গুলোতে আশ্রয় নেয়ার জন্য বলা হয়েছে।

অলংকারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নাজমুল ইসলাম রুহেল বলেন, ইউনিয়নের বেশীরভাগ মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছেন। বৃষ্টি ছাড়াও পানি হু হু করে বাড়ছে। মানুষকে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য বলেছি।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও পৌর প্রশাসক নুসরাত জাহান বলেন, আমি বন্যা কবলিত এলাকাগুলো পরিদর্শন করেছি। লামাকাজী ও খাজাঞ্চী ইউনিয়নের অবস্থা ভয়াবহ। পানিবন্দী মানুষকে ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্সসহ প্রত্যেকটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নেয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

ছাতকে ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে ছাতকের সর্বত্রই বন্যা দেখা দিয়েছে। ১ মাসের ব্যবধানে আবারও ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছেন এ অঞ্চলের মানুষ। বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে অনেক ঘর বাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মন্দির,মৎস্য খামার, গ্রামীণ রাস্তা-ঘাট ও হাট- বাজার। ছাতক শহর ৪ ফুট পানির নিচে। উপজেলার সর্বত্রই এখন বন্যার পানি থৈ-থৈ করছে। সুরমা, পিয়াইন,চেলা, বটেরখাল, বোকা নদী সহ সকল নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত ও নদ- নদীর পানি প্রবল বেগে প্রবাহিত হচ্ছে। পাউবো সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার বিকেলে ছাতক পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি বিপদ সীমার ২৩৫ সেঃমিঃ উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ছাতক শহরে রিক্সা, গাড়ির পরিবর্তে নৌকা চলাচল করছে। ইতোমধ্যে উপজেলার ১৩ টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভার ৪ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে প্রায় ২০ হাজার মানুষ ইতোমধ্যে আশ্রয় নিয়েছে। উপজেলা সদরের সাথে ১৩ টি ইউনিয়নের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ছাতক – সিলেট সড়কের ছাতক – গোবিন্দগঞ্জ অংশটি পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সিলেট সহ সারা দেশের সাথে ছাতকের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। শহরের অলি-গলি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্যার পানিতে নিমজ্জিত। ছাতক- আমবাড়ি – সুনামগঞ্জ, ছাতক- দোয়ারা, ছাতক- জাউয়াবাজার, নোয়ারাই -বালিউরা, নরশিংপুর, চৌমুহনীবাজার, লক্ষীবাউর সড়ক, কৈতক-হায়দরপুর, জালালপুর লামারসুলগঞ্জ, জাউয়া-বড়কাপন, মুক্তিরগাও,গোবিন্দগঞ্জ-লাকেশ্বর বাজার,বুরাইয়া,দোলার বাজার, কালারুকা, হাসনাবাদ, কান্দিগাও,হাদা, মাদ্রাসা বাজারসড়কসহ গ্রামীণ সব ক’টি সড়ক বন্যার পানিতে তলিয়ে গিয়ে উপজেলা সদরের সাথে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে সড়ক যোগাযোগ। গ্রামীণ হাট বাজার ছাড়াও ছাতক শহরের নোয়ারাই বাজার, ফকির টিলা,পেপার মিল,কুমনা,বৌলা,তাতিকোনা, রহমতবাগ,মন্ডলীভোগ, ছোরাব নগর,চরেরবন্দ এলাকার শত- শত বাসা-অফিস ও দোকানে বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। বন্যায় প্লাবিত হয়েছে গোবিন্দগঞ্জ, দোলারবাজার, ধারণ বাজার, জাউয়াবাজার, আলীগঞ্জ বাজার, পীরপুর বাজার, কপলাবাজার, বুরাইয়াবাজার, জাহিদপুর বাজার, কামারগাঁও বাজার,হাজীর বাজার,মাদ্রাসা বাজার, হাদা বাজার,লক্ষীবাউর বাজার, হাসনাবাদ বাজার , কালারুকা বাজার,আমেরতল বাজার সহ সকল গ্রামীণ হাট। অনেকই দোকান ও বাসাবাড়ির মালামাল সরিয়ে নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছেন। উজানের প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের কারণে এখানে সুরমা, চেলা ও পিয়াইন নদীতে ব্যাপক হারে পানিবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ শহরের সকল চুনশিল্প কারখানা ও ক্রাশার মিল বন্ধ রয়েছে । সুরমা নদীতে নৌকা- কার্গো লোডিং আন লোডিংও বন্ধ রাখা হয়েছে। ফলে শত-শত শ্রমিক এখানে বেকার। একাধারে ভারী বর্ষণের কারণে জন জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। 

উত্তর খুরমা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিল্লাল আহমদ, নোয়ারাই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান দেওয়ান পীর আব্দুল খালিক রাজা,ইসলাম পুর ইউপি চেয়ারম্যান সুফি আলম সুহেল,জাউয়াবাজার ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল হক ও চরমহল্লা ইউপি চেয়ারম্যান আবুল হাসনাত জানিয়েছেন, ইউনিয়নে অনেক মৎস্য খামার, ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ।বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে সকল হাটবাজার। শত-শত বসত ঘরে বন্যার পানি ঢুকেছে। আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছেন অনেক মানুষ। ইউনিয়নের সকল মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছেন। 

ছাতক উপজেলা নির্বাহী অফিসার মামুনুর রহমান বন্যা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ও প্রায় ৪ লক্ষ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে উল্লেখ করে জানান, উপজেলার সবকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বন্যা দুর্গতদের আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে খুলে দেয়া হয়েছে। বন্যার্তদের ত্রাণ সহায়তা দেয়া হচ্ছে।

ছাতক-দোয়ারাবাজার নির্বাচনী এলাকার সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিক জানান, সরকার সব সময় বন্যা কবলিত অসহায় মানুষের পাশে আছে। চলমান বন্যায় ছাতক-দোয়ারাবাজারের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত এসব মানুষকে সার্বিক সহায়তা দেয়া হবে। সরকারিভাবে পর্যাপ্ত সহায়তার ব্যবস্থা রয়েছে।

সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার চারটি বিদ্যালয়ের পাঠদান গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে বন্ধ করা হয়েছে। বিদ্যালয়গুলো হলো স্বজনশ্রী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়,রসুলগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়,কবিরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বাংলাবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

জগন্নাথপুর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মানিক চন্দ্র দাস বলেন, বন্যার কারণে বিদ্যালয়গুলোর পাঠদানের পরিবেশ না থাকায় চারটি বিদ্যালয়ের পাঠদান অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে। পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনায় বিদ্যালয়গুলো আরও বন্ধ থাকতে পারে।

বিশ্বম্ভরপুর থেকে স্বপন কুমার বর্মন জানান, বিশ্বম্ভরপুরে পাহাড়ী অস্বাভাবিক ঢলে ও অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের ফলে ভয়াবহ বন্যায় ৫০ হাজারের অধিক মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের নিরলসভাবে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। উপজেলা সদর, ফতেপুর ইউনিয়নে রায়পুর বাহাদুরপুর, গোপালপুর, চান্দারগাঁও, কাটাখালী, চাতলপাড়, ঘাগটিয়া, পলাশ ইউনিয়নের প্যারিনগর, পদ্মনগর, ধরেরপাড়, কৃষ্ণনগর, মুক্তিখলা, মল্লিকপুর, নতুনপাড়া, রংপুর, রনবিদ্যা, বাদাঘাট (দ:) ইউনিয়নের শ্রীধরপুর, সোনাপুর, বাঘমারা, দূর্গাপুর, ব্রজনাথপুরসহ বিভিন্ন গ্রামে হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে। 

উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো: সাদি উর রহিম জাদিদ বন্যাকবলিত এ সমস্ত গ্রামগুলোতে মানুষের মাঝে বৃষ্টিতে ভিজে নৌকাযোগে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ত্রাণ বিতরণ করেন। উপজেলা নির্বাহী অফিসার সার্বক্ষণিক বন্যাকবলিত মানুষের খোঁজ খবর রাখছেন । উপজেলা সদরে বন্যাজনিত খবরা খবরের জন্য কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। প্রস্তুত রাখা হয়েছে বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র। এ পর্যন্ত প্যারীনগর, ধরেরপাড় উপজেলা সদরসহ কয়েকটি বন্যাআশ্রয় কেন্দ্রে লোকজন আশ্রয় নিয়েছেন।

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিস সূত্রে জানা যায়, এ পর্যন্ত ৬০ মে.টন চাল, ২০০ প্যাকেট শুকনো খাবার, নগদ ২ লক্ষ টাকা এবং গো খাদ্যের জন্য ২৬ হাজার টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে।

বন্যায় বিশ্বম্ভরপুর টু সুনামগঞ্জ সড়ক ও জনপথ রাস্তা পানিতে নিমজ্জিত হওয়ায় যান চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে।

সোনালীনিউজ/আইএ

Wordbridge School
Link copied!