• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

হারিয়ে যাওয়া মেলা


লিয়াকত হোসেন খোকন জানুয়ারি ২৪, ২০২১, ০১:২৭ পিএম
হারিয়ে যাওয়া মেলা

ঢাকা : মেলার দুটি দিক থাকে- সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক। মেলার সাংস্কৃতিক পরিসরে উঠে আসে বাউল গান, ভাসান, ভাদু, টুসু, আলকাপ, পটগান প্রভৃতি। এসব দেখে ও শুনে মানুষের মন থেকে সহজে দূর করা সম্ভব সাম্প্রদায়িক চিন্তা-ভাবনা। বাঙালি জীবনের সংস্কৃতির ধারাকে বহমান রাখে মেলা। শিল্পীরা সুযোগ পায় নিজেদের মেলে ধরার আর তাই বহমান থাকেও লোকসংস্কৃতি। আজকাল মেলাটেলা কমে যাওয়ার কারণে চারদিকে জঙ্গি-সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, ইয়াবা-ফেনসিডিলে আসক্ত, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর উত্থানসহ বিভিন্ন ধরনের অপকর্ম বাড়ছে। একদা বাংলাদেশে বারো মাসে তেরো পার্বণ ছিল, অতীতে বারো মাসজুড়ে ছিল হরেক রকমের মেলাটেলা— যেজন্য কারো মনে বিচরণ করতে পারেনি সাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনা। সব বাঙালি ছিল ঐক্যবদ্ধ- সবাই অপরাধকে একবাক্যে ঘৃণা করত। সে কারণে অতীতে বাংলাদেশে কখনো জঙ্গিটঙ্গির উত্থান ঘটেনি। সব ধর্মের মানুষ তখন কি আনন্দে দিন কাটাত। প্রায়ই অনুষ্ঠিত হতো বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান তা দেখে প্রতিটি মানুষের হূদয় ছিল সবার তরে। তখন ছিল সব ধর্মের মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির বন্ধন।  কিন্তু আজকের দিনে জঙ্গি হামলা হলে একশ্রেণির লোক চুপচাপ থাকে। কোনো কথা বলে না, অথচ কোথাও কেউ এক আধটু ধর্ম নিয়ে মন্তব্য করলে তখন এরা গর্জে ওঠে— ঢাকার বায়তুল মোকাররম এলাকা স্লোগানে-স্লোগানে, প্রতিবাদে-প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠে।

অথচ জঙ্গি হামলা হলে এই গোষ্ঠী কোনো প্রতিবাদ করে না। এর রহস্য কী! আবার কখনো কখনো এই গোষ্ঠীর কথাবার্তা, হুমকি-ধমকি কিন্তু দ্বিজাতি তত্ত্বের মতো। কিন্তু ১৯৭১ সালে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম সব ধর্মের মানুষেরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের চার মূলনীতি হলো— ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র। এ কথা ভুলিয়ে দেয়ার জন্য ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে একুশ বছর পর্যন্ত যারা ক্ষমতায় ছিল, তারা পুনরায় সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর উত্থান ঘটিয়ে দিয়ে বাংলাদেশকে করে তুলেছিল দ্বিজাতি তত্ত্বের সেই বিষাক্ত বিষ। বর্তমানে আমরা সেই বিষাক্ত বিষের হঠাৎ হঠাৎ উত্থান দেখি। এসব সাম্প্রদায়িকতা; দ্বিজাতি তত্ত্বের চিন্তা-ভাবনা চির নির্মূল করতে হলে বারো মাস ধরে ৬৪ জেলাসহ প্রতিটি উপজেলায় ও গ্রামে গ্রামে মেলা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন চাই। আর সেখানে থাকবে নৃত্য, গান, যাত্রাপালা, নাটক, থিয়েটার, বাজি ফাটানোর উৎসব ইত্যাদি। একসময় বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য মেলা ছিল— বগুড়ার গাবতলীর সন্ন্যাসী মেলা বা পোড়াদহ মেলা, মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার উভাজানি গ্রামের রাধা চক্করের মেলা, বরিশালের বিপিনচাঁদ ঠাকুরের মেলা, তাড়াইলের মাঘীপূর্ণিমার মেলা, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের বাতিসার মেলা, বিক্রমপুরের রামপালের মেলা, নেত্রকোনার চণ্ডীগড় মেলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাতমোড়ার মেলা, পিরোজপুরের খারবাক মেলা, রংপুরের সিন্দুরমতি মেলা, ধামরাইয়ের রথের মেলা, পটিয়ার ঠেগড়মুনির মেলা, পাবনার বোঁথরের চড়ক মেলা, সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জের বারুণী মেলা, ইছামতী নদীতীরের পোড়াদহ মেলা, সুন্দরবনের দুবলার রাসমেলা, কুষ্টিয়ার লালন মেলা ও দোলপূর্ণিমা, সাতক্ষীরার গুরপুকুরের মেলা, মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ ও আদমপুরের রাসলীলার মেলা, সোনারগাঁওয়ের বটতলার বৌ মেলা, রাজশাহীর পুঠিয়ার রথের মেলা আরও কত কী! এসব মেলায় নাচের দল ১০ কি ১২ জন রাধা, কৃষ্ণ, শিব, পার্বতী, নারদসহ সাধু পাগল সেজে সারাদিন নাচগান পরিবেশন করত আর সারা রাত চলত নিমাই সন্ন্যাস পালা নয়তো অন্য কোনো পালাগান। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় মেলা কমে যাওয়ার কারণে উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। তাই এ অবস্থায় বাংলাদেশজুড়ে আমরা চাই বিভিন্ন ধরনের মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের নিয়মিত আয়োজন।

সেই সঙ্গে হারিয়ে যাওয়া মেলাগুলো পুনরায় চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ করা তবেই বাংলাদেশের বাঙালিরা ফিরে পাবে বাঙালির গৌরবের মেলাগুলো। দ্বিতীয়ত চারদিকে মেলা আবার সরব হয়ে উঠলে মানুষের রুটি রোজগারের ক্ষেত্র গড়ে উঠবে মেলার মাধ্যমে। তাঁতি, কুমোর, ছুতোর, বাদ্যশিল্পী, বুননশিল্পীরা স্থানীয় স্তরে তাদের পণ্য বেচার সুযোগ পাবে মেলার মাধ্যমে। আর মানুষও মুখিয়ে থাকবে এসব কেনার জন্য- সর্বশ্রেণির মানুষ মেলামুখী হয়ে উঠলে সাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনা চিরতরে বিলুপ্ত হতে বাধ্য।

লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

 

Wordbridge School
Link copied!