• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সরকারি কর্মচারীদের গ্রেড উন্নতি এবং বাস্তবতা


সোনালীনিউজ ডেস্ক জানুয়ারি ৯, ২০২২, ১১:৫২ এএম
সরকারি কর্মচারীদের গ্রেড উন্নতি এবং বাস্তবতা

ঢাকা: টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড না থাকায় বর্তমান বেতন কাঠামোয় ঠকছেন ১৪ লাখের বেশি কর্মচারী। তারা সবাই দশম থেকে ২০তম গ্রেডভুক্ত। নিম্ন আয়ের এসব কর্মচারীকে সান্ত্বনা দেওয়া হয়েছিল তাদের বেতন বৃদ্ধির জন্য টাইম স্কেল প্রয়োজন হবে না। নির্দিষ্ট সময় অন্তর গ্রেড পরিবর্তনেই তারা বেশি সুবিধা পাবেন।

কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, অধিকাংশের গ্রেড পরিবর্তনের পর বেতন কমেছে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তারা টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড ফের চালুর দাবি জানিয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে সরকারের অবস্থান জানার জন্য জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য যে পরিমাণ বেতন বাড়ানো হয়েছে তা আর কোনো সরকারের সময় হয়নি। বর্তমান সরকার কাজটি করেছে। এরপরও যেসব অসংগতির কথা বলা হচ্ছে সেগুলোর যৌক্তিকতা বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে।

তৃতীয় শ্রেণির সরকারি কর্মচারী সমিতির মহাসচিব ছালজার হোসেন এ বিষয়ে বলেন, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকারের সময় বেতনবৈষম্য ছিল না। এখন দেশ অনেক উন্নত হয়েছে, অর্থনৈতিক অবস্থাও ভালো। তাহলে বৈষম্য হবে কেন। তিনি বলেন, আমাদের দাবি টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বহাল করা হোক। সেই সঙ্গে যেন নতুন কমিশন গঠন করে দশটি গ্রেডে বেতন কাঠামো ঘোষণা করা হয়।

বিদ্যমান সরকারি চাকরিতে দশম থেকে বিশতম গ্রেডপ্রাপ্ত (নিম্ন গ্রেড) কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি। তারা বলছেন, বিদ্যমান পে-স্কেলে যে পদ্ধতিতে তাদের গ্রেড উন্নতির কথা বলা হয়েছে তাতে কার্যত কোনো লাভ হয় না। গ্রেড উন্নতির আগেই ইনক্রিমেন্ট হয়ে বেতন বেড়ে যায়। ফলে নতুন গ্রেডে যাওয়ার পর যে বেতন দাঁড়ায় তা বিদ্যমান বেতনের চেয়ে কম। এ পদ্ধতিকে শুভংকরের ফাঁকি বলছেন সংশ্লিষ্টরা। সরকারি চাকরিতে বর্তমানে অনুমোদনপ্রাপ্ত পদের সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ, এর মধ্যে নিম্ন আয়ের পদ ১৮ লাখের বেশি থাকলেও বর্তমানে কর্মরত রয়েছে ১৪ লাখ।

সচিবালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ নূরুজ্জামাল সেপ্টেম্বরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বরাবর এক আবেদন করেন। এতে ‘তিনটি বিশেষ ইনক্রিমেন্ট’ এবং ‘নবম পে কমিশন’ গঠনের অনুরোধ জানান। এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত অক্টোবরে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত দাবি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে অবগতির জন্য পাঠানো হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে এসব দাবি অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। 

মোহাম্মদ নূরুজ্জামাল বলেন, আমাদের যৌক্তিক দাবি সরকারের কাছে তুলে ধরেছি। আশা করি, সরকারের শীর্ষ নীতিনির্ধারকরা আমাদের দাবির যৌক্তিকতা অনুধাবন করবেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাতিল করার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ২য়, ৩য় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা। এ শ্রেণির বেশির ভাগ দপ্তরে পদোন্নতির সুযোগ কম। যেসব দপ্তরে পদোন্নতির সুযোগ আছে, সেখানেও পদোন্নতিতে দেরি হয়। টাইম স্কেল হলো নির্দিষ্ট সময় পর পদোন্নতির সুযোগ না থাকা চাকুরেদের যৌক্তিকভাবে আর্থিক সুবিধা বাড়ানোর প্রক্রিয়া। সিলেকশন গ্রেডও প্রায় একই ধরণের সুবিধা। অভিযোগকারীরা বলছেন, চলমান পেস্কেলে মূল লাভ হয়েছে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের। প্রায় প্রতিবছর তাদের শূন্যপদ ছাড়াই পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে। পদোন্নতির কারণে তাদের টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেডের প্রয়োজন হয় না। 

বর্তমান পে স্কেলে ২০টি গ্রেড রাখা হয়েছে। কার্যত এই গ্রেডের মধ্যে আগের বৈষম্য রয়ে গেছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। বর্তমান ব্যবস্থায় প্রথম থেকে নবম গ্রেড পর্যন্ত প্রথম শ্রেণি। ১০ গ্রেড দ্বিতীয় শ্রেণি। ১১ থেকে ১৬ পর্যন্ত তৃতীয় শ্রেণি এবং ১৭ থেকে ২০ গ্রেডকে চতুর্থ শ্রেণি হিসাবে মেলানো হয়। প্রথম গ্রেড থেকে নবম গ্রেডের কর্মকর্তাদের মূল বেতনের পার্থক্য ৭৮,০০০-২২,০০০=৫৬,০০০ টাকা। অন্যদিকে ১১ থেকে ২০ গ্রেডের মূল বেতনের পার্থক্য ১৬,০০০-৮,২৫০=৭,৭৫০ টাকা মাত্র। প্রথম থেকে নবম গ্রেড পর্যন্ত মূল বেতনের পর্যায়ক্রমিক পার্থক্য সর্বোচ্চ ১২ হাজার এবং সর্বনিম্ন ১ হাজার। অন্যদিকে ১১ থেকে ২০ গ্রেডের মূল বেতনের সর্বোচ্চ পার্থক্য সাড়ে ৩ হাজার এবং সর্বনিম্ন ২৫০ টাকা।

গ্রেড উন্নতির শুভংকরের ফাঁকি : পে-স্কেলের ৭(১) অনুযায়ী, কোনো কর্মচারী পদোন্নতি ছাড়া একই পদে ১০ বছর পূর্ণ হলে ১১তম বছরে সরাসরি পরবর্তী গ্রেডে পদোন্নতিপ্রাপ্ত হবেন। এখানেই শুভংকরের বড় ফাঁকি ধরা পড়ে। একজন অফিসার উদাহরণ দিয়ে বলেন, বর্তমান পে-স্কেল অনুযায়ী, ১০ গ্রেডের কেউ পদোন্নতি না পেলেও দশ বছর পর মূল বেতন দাঁড়ায় ২৬ হাজার ১২০ টাকা। একই অফিসার যদি ১১তম বছরে পরবর্তী নবম গ্রেডে পদোন্নতি পান তখন তার মূল বেতন দাঁড়ায় ২২ হাজার টাকা। অর্থাৎ পদোন্নতি (গ্রেড পরিবর্তন) ছাড়াই তিনি চার হাজার টাকার বেশি বেতন পাচ্ছেন। তাহলে এ পদোন্নতি বা গ্রেড পরিবর্তনের কারণে সেই অফিসারের কী লাভ হয়।

একইভাবে বিদ্যমান পে-স্কেলের ৭(২) অনুযায়ী, ১০ বছর পূর্তিতে চাকরির উচ্চতর গ্রেডপ্রাপ্তির পরবর্তী ৬ বছরে পদোন্নতিপ্রাপ্ত না হলে ৭ম বছরের চাকরি সন্তোজনক হলে আবারও সরাসরি পরবর্তী ধাপের গ্রেডের বেতন পাবেন। আগের ধারাবাহিকতায় সংশ্লিষ্ট চাকুরের তখন অষ্টম গ্রেড হবে। তখন পদোন্নতি অনুযায়ী মূল বেতন হবে ২৩ হাজার টাকা। অথচ পদোন্নতির আগেই এ চাকুরে মূল বেতন পাচ্ছেন ৩৫ হাজার ৮৮০ টাকা। যদিও যেটা বেশি সেটাই সংশ্লিষ্টরা পান। তারপরও পদোন্নতির কারণে বেতন না বাড়ায় সেই পদোন্নতি সংশ্লিষ্টদের কাছে অর্থ বহন করে না।

সচিবালয়ের নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীরা বলছেন, টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাতিল করে তাদের ধোঁকা দেওয়া হয়েছে। আগের পে স্কেল অনুযায়ী, ১০ম গ্রেড তথা দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তারা সন্তোষজনকভাবে চার বছর চাকরি পূর্ণ হলে সিলেকশন গ্রেড অর্থাৎ নবম গ্রেডে বেতন পেতেন। বর্তমান পে স্কেল অনুযায়ী, দশম গ্রেডের কর্মকর্তারা ১০ বছর পর নবম গ্রেডে বেতন পান। এর ফলে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

এমন পরিস্থিতিতে সরকারি চাকুরেদের নিম্ন গ্রেডপ্রাপ্তরা একাধিক ইনক্রিমেন্ট ও নতুন পে কমিশন গঠনের দাবি করছে সরকারের কাছে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে ইতিবাচক কোনো বার্তা মিলছে না।

জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া বলেন, সরকারি বেতন কাঠামো একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ। যত সতর্কতা নিয়েই পে-স্কেল ঘোষণা হোক, কিছু অসামঞ্জস্য থাকবেই। তিনি বলেন, এ সমস্যার সমাধান হতে পারে স্থায়ী বেতন কমিশন গঠন। যারা সময়ে সময়ে বিভিন্ন অভিযোগের যৌক্তিক সমাধান দেবেন। অন্যথায় মূল্যস্ফীতি অনুযায়ী বেতন নির্ধারণের পদ্ধতি অনেক দেশ অনুসরণ করে, বাংলাদেশেও সেটা চালু করা যেতে পারে। সূত্র : যুগান্তর।

সোনালীনিউজ/এন

Wordbridge School
Link copied!