• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

পাতে ফিরছে হারিয়ে যাওয়া মাছ


নিজস্ব প্রতিবেদক অক্টোবর ২০, ২০২১, ০৪:৪২ পিএম
পাতে ফিরছে হারিয়ে যাওয়া মাছ

ঢাকা : নানা কারণে দেশীয় অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত হওয়া বিদেশি মাছের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। তবে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত চেষ্টায় বাঙালির পাতে আবার ফিরতে শুরু করেছে দেশীয় প্রজাতির মাছ। বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে বিলুপ্তপ্রায় ৩১ প্রজাতির মাছ ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন।

প্রজনন ও সংরক্ষণ করে বদ্ধ জলাশয়ে চাষ করে দেশীয় জাতের উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। লাইভ জিন ব্যাংকের মাধ্যমে দেশীয় সব প্রজাতির মাছ সংরক্ষণের কার্যক্রম চলছে।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট সূত্রে জানা যায়, গত এক যুগে দেশীয় ছোট মাছের উৎপাদন প্রায় ৪ গুণ বেড়েছে। কিন্তু সেই অবস্থার বদল ঘটিয়েছেন দেশের মৎস্য চাষিরা।

২০০৮-২০০৯ সালে চাষের মাধ্যমে দেশি মাছের উৎপাদন ছিল ৬৭ হাজার টন। জানা যায়, দেশে মোট উৎপাদনের মাত্র ১৬ শতাংশ (৬ লাখ ৪০ হাজার টন) হচ্ছে সামুদ্রিক মাছ। বাকি ৩৭ লাখ ৪৪ হাজার টন অর্থাৎ ৮৪ শতাংশ মিঠা পানির মাছ। মৎস্য উৎপাদনে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ চাহিদা পূরণ হচ্ছে ছোট মাছ দিয়ে। ২০০৯ সালে পুকুরে দেশীয় ছোট মাছের উৎপাদন ছিল ৬৭ হাজার ৩৪০ টন-যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২৪১ লাখ টনে উন্নীত হয়। ২০১৯-২০২০ সাল নাগাদ তা প্রায় চার গুণ বেড়ে ২ লাখ ৫০ হাজার টন হয়েছে। ফলে বাজারে এখন দেশি মাছের ছড়াছড়ি।

ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) তথ্যমতে, বাংলাদেশে মিঠাপানির ২৬০ প্রজাতির মাছের মধ্যে ৬৪ প্রজাতির মাছ বিলুপ্তপ্রায়। বিলুপ্তপ্রায় জাতগুলো বাছাই করে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে সেই জাতগুলোর পোনা উৎপাদন করা হচ্ছে। ময়মনসিংহে প্রধান কার্যালয় ছাড়াও বগুড়ার সান্তাহার, নীলফামারীর সৈয়দপুর, যশোরসহ বিভিন্ন স্থানে বিলুপ্তপ্রায় মাছ সংরক্ষণে কাজ চলছে।

মৎস্য ইন্সটিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, বিলুপ্তপ্রায় মাছের মধ্যে বর্তমানে পাবদা, গুলশা, গুজি আইড়, রাজপুঁটি, চিতল, মেনি, টেংরা, ভাগনা, খলিশা, কালীবাউশ, কই, বাটা, ফলি, বালাচাটা, শিং, মহাশোল, গুতুম, মাগুর, বৈড়ালি, কুঁচিয়া, গজার, সরপুঁটি ও গনিয়াসহ প্রায় ২৪ প্রজাতির মাছের অস্তিত্ব ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। এসব মাছ বাজারেও পাওয়া যাচ্ছে। যদিও ক্রেতারা বলছেন, দেশীয় মাছ ফিরে এলেও পূর্বের সেই স্বাদ নেই। দামও অনেক বেশি। তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, এ মাছের স্বাদ কম নয়; বরং আগের তুলনায় বেশি স্বাদ। আকারেও বড়।

এছাড়া বালাচাটা মাছের কৃত্রিম প্রজনন কৌশল উদ্ভাবন হয়েছে। বালাচাটা মাছ অঞ্চলভেদে মুখরোচ, পাহাড়ি গুতুম, গঙ্গা সাগর, ঘর পইয়া, পুইয়া, বাঘা, বাঘা গুতুম, তেলকুপি ইত্যাদি নামে পরিচিত। পাহাড়ি ঝর্ণা ও অগভীর স্বচ্ছ জলাশয় এদের বেশি প্রিয়। প্রজাতিটিকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে ২০১৯ সালে দেশে প্রথমবারের মতো এর কৃত্রিম প্রজনন, নার্সারি ব্যবস্থাপনা ও চাষ কৌশল উদ্ভাবন করা হয়। গুতুম মাছের কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদনে ব্যাপক সফলতা এসেছে। এছাড়া খলিশা মাছের পোনা উৎপাদন ব্যাপক হারে বাড়ছে। সুস্বাদু খলিশা মাছের পোনা প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে ২০১৬ সাল হতে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, স্বাদুপানি উপকেন্দ্র সৈয়দপুর হতে গবেষণা পরিচালনা করে ২০১৮ সালে মাছটির কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদন কলাকৌশল উদ্ভাবনে সাফল্য লাভ করে। আনুপাতে ছোট্ট এ খলিশা মাছের ডিম ধারণ ক্ষমতা ৫ হাজার থেকে ১৪ হাজার পর্যন্ত। জাইত পুঁটি মাছের পোনা উৎপাদনে ব্যাপক সফলতা এসেছে। ইনস্টিটিউটের স্বাদুপানি কেন্দ্রে ২০২০ সালে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে এ পুঁটি মাছের পোনা উৎপাদনে সফলতা অর্জিত হয়। গজার মাছের পোনা উৎপাদনেও সফলতা এসেছে।

বিজ্ঞানীরা জানান, বাংলাদেশে মিঠাপানির হ্যাচারি রয়েছে ৯৩০টি। বিলুপ্তপ্রায় মাছের পোনা সারা দেশে ব্যাপক হারে উৎপাদনের জন্য ইনস্টিটিউটে হ্যাচারি মালিক ও চাষিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। উৎপাদিত পোনাগুলোও স্বল্পমূল্যে সরবরাহ করা হচ্ছে। ইনস্টিটিউটের প্রযুক্তি ব্যবহার করে দেশীয় প্রজাতির মাছের পোনা উৎপাদন করছে হ্যাচারি মালিকরা। পরে ব্যবহার করা হচ্ছে চাষাবাদে। কর্মসংস্থান হয়েছে লক্ষাধিক লোকের। দেশীয় মাছের জিন সংরক্ষণ, প্রজননের কৌশল উদ্ভাবন এবং চাষাবাদ পদ্ধতির কারণে সফলতা এসেছে।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. জুলফিকার আলী বলেন, দেশীয় প্রজাতির মাছগুলোতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহ ও আয়োডিনের মতো প্রয়োজনীয় খনিজ পদার্থ রয়েছে। এগুলো শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে এবং রক্তশূন্যতা, গলগণ্ড, অন্ধত্ব প্রভৃতি রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে।

ময়মনসিংহে ইনস্টিটিউটের স্বাদুপানি কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শাহা আলী বলেন, ‘পাবদা মাছ দুই বছর আগেও ১ হাজার ৩০০ টাকা কেজি দরে বাজারে বিক্রি হয়েছে। কিন্তু এখন ৫০০ টাকার কমেই পাওয়া যায়। বাজারে এখন শিং মাছের দাম ৪০০ টাকা, ট্যাংরা মাছের দামও ৪০০ টাকা। এসব মাছ ছাড়াও সাম্প্রতিককালে বাজারে বিপন্ন প্রজাতির মেনি, চিতল, ফলি, কই ইত্যাদি মাছের প্রাপ্যতা যেমন বেড়েছে, দামও নেমে এসেছে সহনশীল পর্যায়ে। এ ছাড়া গবেষণায় উৎপাদিত মাছের পোনা চাষে হ্যাচারি মালিকসহ চাষিরাও লাভবান হচ্ছেন।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ গণমাধ্যমকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অভ্যন্তরীণ উন্মুক্ত জলাশয় সংকুচিত হয়ে যাওয়ায় দেশীয় মাছের প্রজনন ও বিচরণক্ষেত্র ইতোমধ্যে অনেক বিনষ্ট হয়েছে। প্রাকৃতিক জলাধার যেমন হাওড়, খাল-বিল ও নদনদীতে এসব মাছের প্রাপ্যতা হ্রাস পেয়েছে। ফলে দেশীয় মাছ সংরক্ষণের জন্য ময়মনসিংহে ইনস্টিটিউটের সদরদপ্তরে লাইভ জিন ব্যাংক স্থাপন করা হয়েছে।

তিনি বলেন, সারা দেশে যত ছোট মাছ আছে, সেগুলো সংগ্রহ করে এই লাইভ জিন ব্যাংকে রাখা হচ্ছে। যদি প্রকৃতি থেকে কোনো মাছ হারিয়ে যায়, তাহলে সংরক্ষণে থাকা মাছটিকে গবেষণা করে আবারো ওই মাছের পোনা উৎপাদন করা হবে। ফলে বিলুপ্ত হওয়া মাছ সারা দেশে চাষের মাধ্যমে ছড়িয়ে যাবে।

তিনি আরো বলেন, চাষের আওতায় আসা বিলুপ্তপ্রায় ১৯ প্রজাতির দেশীয় মাছ ছাড়া উৎপাদিত আরো ১২টি মাছের পোনা নিয়ে গবেষণা চলছে। দ্রুত সেই মাছগুলোকেও চাষের আওতায় আনা হবে।

মহাপরিচালক বলেন, একটি মাছ নিয়ে ১ থেকে ৫ বছর পর্যন্ত সময় ধরে গবেষণা করতে হয়। মোটা বাইন নামে একটি পিচ্ছিল দেশীয় মাছ নিয়ে প্রায় তিন বছর যাবৎ গবেষণা চলছে। হরমোন প্রয়োগ করে পোনা উৎপাদনে সফলতা পাওয়া যাচ্ছে না। তবে গবেষণা চলছে। আগামী বছরের জুন-জুলাইয়ের মধ্যে বিলুপ্তির আশঙ্কায় থাকা দেশীয় আট থেকে ১০ প্রজাতির মাছের পোনা উৎপাদনে সফলতার সম্ভাবনা রয়েছে।

বর্তমানে ময়মনসিংহ স্বাদুপানি কেন্দ্র ছাড়াও বগুড়ার সান্তাহার, নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর ও যশোর উপকেন্দ্রে বিলুপ্তপ্রায় মাছ সংরক্ষণে গবেষণা চলছে। দেশীয় মাছ সংরক্ষণ গবেষণায় বিশেষ অবদানের জন্যে ২০২০ সালে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট একুশে পদক অর্জন করে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!