ছবি: পিআইডি
প্রায় আট মাসের আলোচনার পর দেশের রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের অংশগ্রহণে তৈরি হলো রাষ্ট্রসংস্কারের নতুন নথি—‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’।
শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) বিকেলে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় এক ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানে এই সনদে স্বাক্ষর করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্যরা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিরা।
জুলাই সনদকে বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক ঐকমত্য ও রাষ্ট্র সংস্কারের ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে দেখা হচ্ছে। এতে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, প্রশাসন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন ব্যবস্থায় কাঠামোগত পরিবর্তনের অঙ্গীকার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত বছরের আগস্টে রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। সেই ধারাবাহিকতায় গঠন করা হয় ছয়টি পৃথক সংস্কার কমিশন-সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন, পুলিশ ও বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন।
এই কমিশনগুলোর প্রস্তাব নিয়ে তিন ধাপে রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার মাধ্যমে গড়ে ওঠে জুলাই সনদের কাঠামো। প্রথম পর্বে ৩৩টি ও দ্বিতীয় পর্বে ৩০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সময়ে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবে ঐকমত্যে পৌঁছানো হয়।
গত ১৬ আগস্ট রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে সনদের খসড়া পাঠানো হয়। ত্রুটি সংশোধনের পর চূড়ান্ত খসড়া পুনরায় পাঠানো হয় ২০ আগস্ট। দলগুলোর মতামত পর্যালোচনা করে ১৪ অক্টোবর কমিশন চূড়ান্ত কপি রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে তুলে দেয়।
রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রক্রিয়া রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে এগিয়ে নিতে ২০২৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি গঠিত হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এর সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস, সহসভাপতি সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. আলী রীয়াজ।
কমিশন মোট ৬৬টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে পর্যায়ক্রমে আলোচনা করে। দুটি ধাপে অনুষ্ঠিত ৬৭টি বৈঠকে দলগুলোর মতামত ও প্রস্তাব সংযোজন করে চূড়ান্ত করা হয় জুলাই জাতীয় সনদ।
জুলাই জাতীয় সনদের ভূমিকা অংশে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রাম, স্বাধীনতার পর গণতন্ত্রের ব্যর্থতা, প্রশাসনিক দুর্নীতি, বিচারবিভাগ ও নির্বাচনি ব্যবস্থার অকার্যকারিতা এবং সাম্প্রতিক ফ্যাসিবাদবিরোধী গণআন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এই সনদ রচিত হয়েছে।
দলগুলো একমত হয়েছে যে, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের সফল গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে রাষ্ট্রীয় পরিবর্তনের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে, সেটিকে টেকসই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রূপ দিতে এই সনদ হবে দিকনির্দেশক দলিল।
সনদের শেষ অংশে উল্লেখ করা হয়েছে, “আমরা অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দল ও জোটের প্রতিনিধিরা বিদ্যমান শাসনব্যবস্থায় কাঠামোগত, আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের বিষয়ে ঐকমত্যে উপনীত হয়েছি এবং এই সনদকে ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ নামে ঘোষণা করছি।”
এতে আরও বলা হয়েছে, ২০০৯ সালের পরবর্তী সময়ের ফ্যাসিবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের শহীদ, আহত ও কারাবন্দীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হলো; তাদের আত্মত্যাগই এই সনদের ভিত্তি।
স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “জুলাই সনদ বাংলাদেশের ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা। এটি কেবল একটি নথি নয়-এটি আমাদের প্রতিশ্রুতি, যে আমরা আর অতীতের ভুলে ফিরব না।”
তিনি আরও বলেন, “জনগণের ঐক্য, রাজনৈতিক সহনশীলতা ও ন্যায়ভিত্তিক শাসনই এই সনদের আত্মা।”
এসএইচ







































