ঢাকা : মানুষ অজানাকে জানতে চায়। নতুন নতুন জিনিসের সাথে পরিচিত হতে চায়। আর এ অজানাকে জানার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো ভ্রমণ করা। পুস্তক পাঠ করে হয়তো জ্ঞান অর্জন করা যায়; কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হলে ভ্রমণের বিকল্প নেই। সেন্ট অগাস্টিন বলেছেন, ‘পৃথিবী একটা বই আর যারা ভ্রমণ করে না তারা বইটি পড়তে পারে না।’ প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের মধ্যে ঘুরে বেড়ানোর একটা প্রবণতা লক্ষ করা যায়। নিজেদের জ্ঞানের ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে মানুষ ছুটে বেড়ায় দেশ থেকে দেশান্তরে। তাই তো বিশ্ববিখ্যাত পরিব্রাজক ইবনে বতুতা, ফা-হিয়েন, হিউয়েন সাংয়ের মতো মনীষী ভ্রমণকেই নিয়েছিলেন জীবনের ব্রত হিসেবে। ভ্রমণের মাধ্যমে একদিকে যেমন চাক্ষুষ জ্ঞান আহরণ করা যায়; তেমনি প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।
দৈনন্দিন জীবনে আমরা আপন কর্মক্ষেত্রে কতশত ব্যস্ততায় ডুবে থাকি। যেন ব্যস্ততার কোনো অন্ত নেই। শহুর জীবনের যান্ত্রিকতার যন্ত্রণা আমাদের শারীরিক ও মানসিক বিভিন্ন সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে, করোনার কারণে গৃহবন্দি সময় কাটাতে কাটাতে অনেকে হাঁপিয়ে উঠেছেন। একঘেয়ে এ জীবনের বিস্বাদ থেকে একটু মুক্ত হয়ে প্রকৃতির সান্নিধ্যে যেতে কার না মন চায়! মানসিক প্রশান্তি ও শারীরিক সুস্থতা মানবজীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। তাই আমাদের উচিত ছুটির অবসরকে কাজে লাগিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরতে যাওয়া। আর আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি পর্যটক ও ভ্রমণপিপাসুদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
বাংলাদেশ যেমনি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি তেমনি এর রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস, ঐতিহ্য ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন এখানে অবস্থিত। সাগরকন্য কুয়াকাটা, বৈচিত্র্যময় প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন, পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার, সিলেটের চা বাগান, চট্টগ্রামের পাহাড়, নিঝুম দ্বীপ, মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত, হাকালুকি হাওর ছাড়াও এখানে রয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত অসংখ্য দর্শনীয় স্থান। ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মধ্যে ষাট গম্বুজ মসজিদ, মহাস্থানগড়, সোমপুর বিহার, লালবাগ কেল্লা, পরীবিবির মাজার, আহছান মঞ্জিল, তারা মসজিদ, ছোট কাটরা, বড় কাটরা, জাতীয় স্মৃতিসৌধ, কার্জন হল, শালবন বিহার, তাজহাট জমিদারবাড়ি, রাজশাহীর বাঘা মসজিদ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া এ দেশের বুকজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে ছোটবড় অসংখ্য নদ-নদী, খাল-বিল ও হাওর-বাঁওড়; যা এ দেশের পর্যটন শিল্পকে করেছে সমৃদ্ধ ও চিত্তাকর্ষক।
বর্তমান বিশ্বে যে কয়টি শিল্প দ্রুত বিকাশমান তার মধ্যে অন্যতম পর্যটনশিল্প। বাংলাদেশেও পর্যটনকে শিল্প হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। অনেকে এটিকে আমাদের দেশের জন্য সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে দেখছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের মোট জিডিপির ১০ শতাংশ পর্যটন খাত থেকে আয় করা সম্ভব, তবে এ খাতে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করার দিকেও নজর দিতে বলছেন তারা। দুঃখের বিষয় হলো, অপরূপ সৌন্দর্যের অধিকরী এ দেশের পর্যটনশিল্পকে আমরা এখনো বিশ্বের বুকে ভালোভাবে তুলে ধরতে পারিনি। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ এ শিল্পে অনেক পিছিয়ে আছে; যা আমাদের জন্য যথেষ্ট হতাশার কারণ। আমাদের পর্যটনশিল্পকে দেশের বাইরে যতটুকু প্রচার করা হয় তা নিতান্তই সামান্য। বিদেশিদের কাছে বাংলাদেশের কথা আসলেই অনুন্নত যোগাযোগব্যবস্থা, সুযোগ-সুবিধাহীন, দারিদ্র্যপীড়িত একটি দেশের চিত্রই ফুটে ওঠে। অন্যদিকে অবকাঠামোগত অসুবিধা, নিরাপত্তাহীনতা, আবাসন ব্যবস্থার অপ্রতুলতা, প্রশিক্ষিত গাইড ও দোভাষীর অভাব ইত্যাদি বিষয়গুলো আমাদের পর্যটনশিল্প বিকাশে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পর্যটনশিল্পে এসব প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠতে পারলে নিকট ভবিষ্যতে এটি বাংলাদেশেরে অর্থনৈতিক উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। বর্তমান বিশ্বে ১০টি কর্মসংস্থানের মধ্যে ১টি কর্মসংস্থান তৈরি হয় এই খাতে। কাজেই এ শিল্পের বিকাশের ফলে দেশে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। বেকারত্ব দূরীকরণ সম্ভব হবে। পর্যটন এলাকাকে কেন্দ্র করে সেখানকার খেটেখাওয়া মানুষরাও কিছু অর্থ আয় করার সুযোগ পাবে। যার ফলে দারিদ্র্যের হার কমবে। স্থানীয় জনগোষ্ঠীরাও এ খাতে বিনিয়োগ করে উপকৃত হবে।
কিছু সমস্যা থাকলেও আশার কথা হলো, বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প ধীরে ধীরে উন্নতির দিকে এগোচ্ছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) ২০১৯ সালের ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কম্পিটিটিভ রিপোর্ট অনুযায়ী, পর্যটনবান্ধব দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান পাঁচ ধাপ এগিয়ে ১২০তম স্থানে উন্নীত হয়েছে। এর আগের বছরে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২৫তম। নিরাপত্তা ও সুরক্ষা খাতেও বাংলাদেশ ১২৩ থেকে ১০৫-এ উন্নীত হয়েছে। ইতোমধ্যে এ শিল্পের উন্নয়নে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারিভাবেও নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মার্কেট, হোটেল-মোটল, রেস্তোরাঁ, ইকোপার্কসহ বিভিন্ন অবকাঠামো গড়ে উঠছে। পর্যটকদের নিরাপত্তা জোরদার করার লক্ষ্যে ট্যুরিস্ট পুলিশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
মোদ্দা কথা হলো, দেশের অর্থনীতিকে চাঙা করার জন্য পর্যটনশিল্পের বিকাশ অপরিহার্য। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে এ শিল্পই হয়ে উঠতে পারে আমাদের অন্যতম হাতিয়ার। তাই এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন এখন সময়ের দাবি।
লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।
আপনার মতামত লিখুন :