• ঢাকা
  • রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

নদী ও নারীর কথা


সাধন সরকার আগস্ট ১০, ২০২১, ০২:০৩ পিএম
নদী ও নারীর কথা

ঢাকা : বিশ্বকবি লিখেছেন, ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা। অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।’ প্রকৃতির পালাবদলের মধ্য দিয়ে নতুন রূপ পরিগ্রহ করে বৈশাখ আমাদের সামনে হাজির হয়। জানান দেয় তার সজীবতা, স্বাচ্ছন্দ্য, শুদ্ধতা। অনেক আগে শুধু গ্রামেগঞ্জে নববর্ষ পালিত হয়ে থাকলেও দিনে দিনে শহরাঞ্চলসহ সারা দেশে বিস্তৃত লাভ করেছে। নববর্ষ প্রত্যেক বাঙালির হূদয়ে নতুন প্রেরণা নিয়ে হাজির হয়। ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে বাঙালির অন্যতম প্রধান উৎসব বাংলা নববর্ষ। প্রতি বছর বৈশাখের প্রথম দিন তথা বাংলা নববর্ষ প্রত্যেক বাঙালির জীবনে নতুন আশা-আকাঙ্ক্ষা-প্রেরণা-প্রত্যয়-স্বপ্ন নিয়ে হাজির হয়। নববর্ষের দিনটিতে আনন্দে মেতে ওঠে পুরো দেশ। ফেলে আসা দিনগুলোর জীর্ণতা ও পুরাতন সবকিছু  পেছনে ফেলে নব উদ্যমে এগিয়ে যাওয়ার অমিত শক্তি জোগায় নববর্ষ। নববর্ষের সর্বজনীনতা দিনে দিনে এটাকে বাঙালির প্রাণের উৎসবে রূপ নিয়েছে। এর মধ্য দিয়েই পরস্ফুিট হয় বাঙালির আত্মপরিচয় ও স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য। নববর্ষ বাঙালির শুদ্ধির সাধনারও প্রতীক।

নববর্ষ আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরে। নববর্ষ দিনে দিনে গড়ে ওঠা বাঙালি সংস্কৃতি ও মূল্যবোধকে ধারণ করে নবজাগরণের পথে এগিয়ে যাওয়ার দীক্ষা দেয়। নববর্ষ শুধু সকল কূপমণ্ডূকতা, অন্যায়, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও অবিচার থেকে দূরে থাকতে শিক্ষা দেয় না, পাশাপাশি এসবের বিরুদ্ধে বজ্রকণ্ঠে প্রতিবাদের মশাল জ্বালাতেও জাগ্রত করে। কিন্তু আমরা কি আমাদের মূল্যবোধ, সততা ও সব ধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে শামিল হচ্ছি? দেশে অনিয়মের বিরুদ্ধে নিয়ম প্রতিষ্ঠা করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নববর্ষের কথা বললাম এই জন্য যে, এই নববর্ষের মতো বাঙালির জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বাংলার নদনদী। নদী ও নারী আজ সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে কিছু অমানুষের দ্বারা। দখল-দূষণকারীদের দ্বারা নদী আর ধর্ষক-নিপীড়কদের দ্বারা নারীর অস্তিত্ব আজ বিপন্ন। প্রশ্ন জাগে, কেন আমরা নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে ব্যর্থ হচ্ছি? কেন আমরা দেশের সম্পদ ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারছি না। নারী ও শিশু নিগ্রহ, নির্যাতন ও ধর্ষণকারীরা আজ সমাজে সবার সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে! নারী ও শিশুরা আজ নিজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও হয়রানির শিকার হচ্ছে! নিজের পরিবারেও নারীরা নিগ্রহের শিকার হচ্ছে। রাস্তাঘাটে, গণপরিবহনে নারীরা আজ নানাভাবে হয়রানির সম্মুখীন।  অনেক নারী নির্যাতন সহ্য না করতে পেরে হয়তো বিক্ষিপ্তভাবে প্রতিবাদ করছেন, কেউবা আবার মুখ বুজে সহ্য করে চলেছেন। আবার অনেক শিক্ষার্থী নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত্যুর পথে নিজেকে সঁপে দিচ্ছেন।

নারীর প্রতি সব ধরনের নির্যাতন বন্ধে দুই উপায়ে সাধারণত কাজ করা যায়-১. বিদ্যমান আইনের প্রয়োগ যথাযথভাবে করে, ২. সমাজে নারীর প্রতি সম্মান ও সচেতনতা সৃষ্টি, দৃষ্টিভঙ্গির বদল ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্য কমানোর মাধ্যমে। নারী নির্যাতনকারীরা সঠিক শিক্ষাটা হয়তো পায়ইনি, আবার পেলেও পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে দিশেহারা হয়ে বিপথে চলে গেছে। নির্যাতনকারীরা পারিবারিক মূল্যবোধ থেকেও অনেক দূরে সরে গেছে। অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা আর গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে অনেকে নারীর প্রতি বিশৃঙ্খল আচরণ করছেন। বিচারহীনতার সংস্কৃতি একটার পর একটার অপরাধ করতে নির্যাতনকারীদের উসকে দিচ্ছে। অপরাধ করে পার পাওয়া যাবে না; এ নীতির সর্বদা প্রয়োগ দেখাতে হবে। অনেক নির্যাতনকারী অবৈধ ক্ষমতাবলে, প্রভাব খাটিয়ে টাকার জোরে পার পেয়ে যাচ্ছেন! এ প্রথার অবসান ঘটিয়ে আইনকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দিতে হবে। প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারী নির্যাতন বন্ধে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সমন্বয়ে কমিটি গঠন করলে ভালো কাজ দেবে বলে মনে করি।

নদীও আমাদের সংস্কৃতি-সভ্যতার অংশ। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ হিসেবে বিশ্বে পরিচিত। একসময় এদেশে ৭০০টিরও বেশি নদনদী ছিল। কিন্তু এখন নদনদীর সংখ্যা কমে ২৩০টিতে চলে এসেছে! যদিও নদনদীর প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন বইতে বিভিন্ন রকম তথ্য পাওয়া যায়! নদী দখল আর দূষণ দীর্ঘদিন ধরে এদেশে চলে আসছে। স্বাধীনতার পর থেকে এদেশে নদনদী দখল-দূষণের সূত্রপাত হয়। ধীরে ধীরে নদনদীর দখল-দূষণ ত্বরান্বিত হয়েছে! প্রাকৃতিক সম্পদ নদীর সাথে এদেশের কৃষিতে সেচ ব্যবস্থা, যোগাযোগ, মাছ আহরণ, অর্থনীতি সর্বোপরি জীবন-জীবিকা জড়িত। পলি পড়ে ভরাট হয়ে আর দখল-দূষণের কবলে পড়ে অনেক নদী ইতোমধ্যে মরে গেছে, অনেক নদী মৃতপ্রায় নদীতে পরিণত হয়েছে। এক শ্রেণির মানুষ ক্ষমতার প্রভাব ও শক্তি খাটিয়ে নদী দখল-দূষণ আর ভরাট করে চলেছেন। নদীর বুক ফাটা চিৎকার নদীখেকোদের পাষাণ হূদয় টলাতে পারছে না! নদীরও যে জীবন আছে একথা আমরা বিশ্বাসই করি না কিংবা করতে চাই না। দেশের অধিকাংশ নদ-নদী আজ অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। কঙ্কালসার দেহ নিয়ে নদনদীগুলো যেন ধুঁকছে। দেখে মনে হয় নদনদী দখল করা এদেশে সবচেয়ে সহজ কাজ। মনে হয় নদীর কোনো মা-বাপ (কর্তৃপক্ষ) নেই। বিভিন্ন সময় ভরাট হয়ে যাওয়া নদনদী খননে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়, তবে সেই অর্থ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন আছে। কর্তৃপক্ষের চেষ্টা সত্ত্বেও তদারকি ও সঠিক পরিকল্পনার অভাবে নদনদীগুলো প্রাণ ফিরে পাচ্ছে না। এদেশের নদনদীগুলো বাঁচানো না গেলে অদূর ভবিষ্যতে এর জন্য চরম মূল্য দিতে হবে। নদনদী না বাঁচলে বাংলাদেশও বাঁচবে না। সরকার নদনদীর দখল-দূষণ ও ভরাট বন্ধে যে উদ্যোগ  গ্রহণ করেছে তা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। ক্যাপিটাল ড্রেজিং করে নদনদীর প্রাণ সঞ্চার করতে হবে।  নদীখেকোদের কোনো ছাড় নয়। প্রতিটি নদনদীকে আপন ধারায় চলতে দিতে হবে। প্রতিটি নদীর সীমানা নির্ধারণ করে নদীগুলোকে রক্ষা করতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় যদি মহান জাতীয় সংসদের ৩৫০ জন সংসদ সদস্য এক-একটি নদী রক্ষার দায়িত্ব নেন। নিজ নিজ এলাকার সংসদ সদস্যরা যদি নিজের এলাকার নদী রক্ষার দায়িত্ব নেন তাহলে নদনদীগুলো আর কেউ দখল-ভরাট করতে পারবে না। নদী ও নারী ভালো থাকা মানেই দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হওয়া।

প্রতিটি বাংলা নববর্ষ আমাদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি রক্ষার কথা বলে। এগিয়ে যাওয়ার কথা বলে। বৈশাখ উদযাপনের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ ইউনেস্কো কর্তৃক Intangible Heritage হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এই অর্জনের জায়গাটা বছরের পর বছর প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ধরে রাখতে হবে। পাশাপাশি আর যেন একটি নদীও দখল-দূষণ আর ভরাটের কবলে না পড়ে। আর যেন একজন নারীও নির্যাতনের শিকার না হয়—এ প্রত্যাশা সবার।     

লেখক : প্রাবন্ধিক
[email protected]

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!