• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

আলু নিয়ে কিছু ভাবনা


এস এম মুকুল সেপ্টেম্বর ৮, ২০২১, ০৪:১৪ পিএম
আলু নিয়ে কিছু ভাবনা

ঢাকা : পৃথিবীর অনেক দেশেই আলু প্রধান খাদ্য হিসেবে ব্যবহার হয়। আমাদের দেশে ভাতের বিকল্প হিসেবে আলু খেতে বলা হলেও তা খুব একটা জনপ্রিয়তা পায় না। বিভিন্ন গবেষণা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাংলাদেশে আলু উৎপাদনে নীরব বিপ্লব ঘটেছে। উৎপাদন বেড়েছে ২৬ গুণ। মাথাপিছু আলু খাওয়ার পরিমাণ বেড়েছে ১০ গুণ। বাংলাদেশের মানুষ বছরে মাথাপিছু ২৩ কেজি আলু খায়। ভারতের চেয়ে আট কেজি বেশি। একসময়কার গরিবের খাবারখ্যাত আলু এখন বিত্তশালীদের মেন্যুতেও নিত্যদিনের সবজি। দুঃখ লাগে যখন লোকসানের আশঙ্কায় সেই আলু অবিক্রীত অবস্থায় হিমাগারে পড়ে থাকার খবর শোনা যায়। এদিকে নতুন আলু রোপণের মৌসুম এসে গেছে। কিন্তু এই বিপুল পরিমাণ আলু এখনই বিক্রি করতে না পারলে তা খাবার অনুপযোগী হয়ে পড়বে।

আমরা জানি, খাবার তালিকায় ভাতের পরেই আলুর স্থান। আলু বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম খাদ্যশস্য। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সর্বশেষ পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, আলু উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। আবার ইন্টারন্যাশনাল

পটেটো কাউন্সিলের তথ্যমতে, বাংলাদেশ পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম আলু উৎপাদনকারী দেশ এবং এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলে বাংলাদেশের স্থান তৃতীয়। বিশ্বের অনেক দেশেই রুটি বা ভাতের বদলে আলু খাওয়ার প্রচলন আছে। তবে আমাদের দেশে আলু এখনো পরিপূরক বা সহায়ক খাবার। আলু ভাতের চেয়ে পুষ্টিকর। শর্করার জোগান দেওয়ার পাশাপাশি আলু নানা ধরনের ভিটামিন ও খনিজ লবণের চাহিদা মেটায়। পাশাপাশি খাদ্যে আঁশ থাকায় আলু হজমে সহায়ক এবং রক্তে শর্করার হার ঠিক রাখে।

আলুতে রয়েছে পানি, শর্করা, আমিষ, স্নেহ, আঁশ, ক্যালসিয়াম, লোহা, ভিটামিন-সি ও ভিটামিন বি-১, বি কমপ্লেক্স, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, জিংক, ফসফরাস। ভিটামিন-সি থাকায় শর্করার চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি আলু শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। আলু রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে, মানসিক চাপ কমিয়ে মস্তিষ্ক কর্মক্ষম রাখে, রোগ প্রতিরোধ করে, হজমে সহায়ক, ত্বক ভালো রাখে, রোদে পোড়া ভাব দূর করতে সহায়তা করে আলুর রস। তবে অতিরিক্ত আলু খেলে ওজন বেড়ে যেতে পারে। সবশেষে বলব-ভাতের বিকল্প হিসেবে আলুর বিভিন্ন ব্যবহার জনপ্রিয় করে তোলাই হচ্ছে সময়ের দাবি।

ব্যবহার বৈচিত্র্যেও আলু তুলনাহীন। সিদ্ধ আলুতে মোট খনিজ পদার্থ থাকে সমপরিমাণ রুটি বা ভাতের চেয়ে অনেক বেশি। খোসাসহ আলু সিদ্ধ করে খাওয়া হলে ভিটামিন ‘সি’ অপচয় কম হয়। সিদ্ধ আলু, আলু ভাত, আলু রুটি, আলু খিচুড়ি, আলু দিয়ে চাপাতি, চপ, চটপটি, লুচি, শিঙাড়া, আলুরদম, আলু সবজি, আলু পায়েস, আলুর হালুয়া ইত্যাদি নানাবিধ উপাদেয় খাদ্য তৈরি করা যায়। মৌসুমের সময় দামে সস্তায় ৩-৪ মাস আলু খেয়ে চালের চাহিদার ওপর চাপ কমানো যেতে পারে।

হিমাগারে অবিক্রীত আলু ত্রাণ হিসেবে কাজে লাগানো যেতে পারে। বন্যায় ত্রাণ হিসেবে, করোনায় দুস্থ ও অসহায়দেও খাদ্যসহায়তা কর্মসূচিতে এমনকি বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ হিসেবে আলু দেয়া যেতে পারে। সরকারের বিভিন্ন ত্রাণ কর্মসূচি, বিভিন্ন বাহিনী ও বিভিন্ন সংস্থার রেশনের মধ্যে আলুকে সংযুক্ত করলে এই বিপুল পরিমাণ আলু বিক্রির খাত তৈরি হবে। স্কুল ফিডিং কর্মসূচিতে আলু অন্তভুক্ত করা যায়। আলু দিয়ে বিকল্প খাদ্য তৈরির বিষয়ে প্রচার করা যায়। এসব বহুমুখী উদ্যোগ নিলে ন্যায্য দাম পেয়ে একদিকে কৃষকের প্রাণ বাঁচবে, উৎপাদিত আলু ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচলে কৃষকের দুশ্চিন্তা দূর হবে। বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণে জানা গেছে, দেশের সব হিমাগারে যে পরিমাণ আলু আছে তার আর্থিক মূল্য প্রায় ৫০০ কোটি টাকা দাঁড়াবে। অপরদিকে রপ্তানিকারকদের কাছে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত পরিবহন না থাকায় আলু রপ্তানি অলাভজনক এবং ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ছন্দে বা মৃদুমন্দে যেভাবেই বলি না কেন, এই বিপুল পরিমাণ আলু যেভাবেই হোক কাজে লাগাতে হবে।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আশির দশকে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) বিজ্ঞানীরা নেদারল্যান্ডসের জাতগুলোকে উন্নত করে দেশের আবহাওয়া উপযোগী করা শুরু করেন। দেশের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত তিন মাসে ফলন হয় এমন আলুর জাত উৎপাদন বাড়াতে সহায়তা করেন। বর্তমানে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি এলাকা ছাড়া দেশের সব স্থানেই আলুর চাষ হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি আলু ফলে মুন্সীগঞ্জ, বগুড়া ও রংপুর জেলায়। অভিযোগ রয়েছে, আলুর উৎপাদন বাড়লেও উদ্বৃত্তের সবই বিদেশে রপ্তাানি হয় না। সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেক মৌসুমেই কৃষক কম দাম পেয়ে থাকেন। এ ছাড়া সংরক্ষণের পর্যাপ্ত সুযোগের অভাবে উৎপাদিত আলুর একটি অংশ নষ্ট হয়ে যায়। ফলে কৃষককে গুনতে হয় মোটা অঙ্কের লোকসান। কৃষি বিভাগের তথ্যে দেখা গেছে, গত প্রায় তিন যুগে আলুর উৎপাদন অন্তত দশগুণ বেড়েছে। ১৯৮০ সালে উৎপাদিত হয় নয় লাখ টন। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় এক কোটি লাখ টন। যাই হোক না কেন, আলু এখন আশার আলো দেখাচ্ছে। কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে আলুর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। যদিও কৃষককে গুনতে হচ্ছে লোকসানের গ্লানি।

আলু বাঙালির ভাজি-ভরতার গণ্ডি পেরিয়েছে অনেক আগেই। আলু থেকেই তৈরি হচ্ছে পটেটো স্যান্ডউইচ, চিপস, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, মিষ্টিসহ মুখরোচক রকমারি খাবার। আলুবিষয়ক তথ্যবিশ্লেষণ করে জানা যায়, বাংলাদেশের আলুর আদি জাত হচ্ছে মিষ্টি আলু। আর গোল আলুর আদি জাত দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরুতে। পরবর্তী সময়ে তা পর্তুগিজ ব্যবসায়ী ও নাবিকদের হাত ধরে ইউরোপে আলুর চাষ শুরু হয়। বাংলাদেশে ২০০ বছর আগে পর্তুগিজ ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জ জেলায় আলুর আবাদ শুরু হয়।

বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকট নিরসনকল্পে মানুষের খাদ্য হিসেবে আলুর কদর বেড়ে যায়। গোল আলু ও মিষ্টি আলু দুটোই যুদ্ধোত্তর পৃথিবীর খাদ্য সংকট মোকাবিলায় বিশেষ ভূমিকা রাখে। গত এক যুগে দেশীয় বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত নতুন প্রজাতির ৬০টি জাত থেকেই দেশের ৭৫ শতাংশ আলুর উৎপাদন হয়েছে। চাহিদা ও উৎপাদন উভয়ই বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশেই আলু প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা স্থাপিত হয়েছে। তা থেকেই উৎপাদিত চিপস ও ফ্রেঞ্চ ফ্রাই বিদেশেও রপ্তাানি হচ্ছে। রপ্তাানি হচ্ছে ভিয়েতনাম, রাশিয়া, কাতার, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ প্রায় ৩০ দেশে।

বাংলাদেশে আলু চাষে আধুনিকপ্রণ, উৎপাদন ও বালাই দমনে প্রযুক্তির ব্যবহার আর সংরক্ষণ ব্যবস্থায় উন্নত কলাকৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে আলুবিপ্লব ঘটাতে পটেটো ক্লাস্টারের গঠনের পরিকল্পনা নিয়েছে হল্যান্ডের কিছু প্রতিষ্ঠান। অনুসন্ধানে জানা যায়, সারা বিশ্বে যে পরিমাণ আলুবীজ রপ্তাানি হয়, তার প্রায় ৭০ ভাগই উৎপাদন করে নেদারল্যান্ডস। আর এই আলু চাষ ও গবেষণার মূল কেন্দ্র হলো নেদারল্যান্ডসের এমেলর্ড। নেদারল্যান্ডস আলু চাষ বা উদ্ভাবনে জগদ্বিখ্যাত এটা যেমন সত্য, তেমনি বাংলাদেশ পরিমাণগত দিক থেকে আলু উৎপাদনে নেদারল্যান্ডসের ওপরে। আলু উৎপাদনের এই অগ্রগতিতে, আলুর গুণগত মান আর প্রক্রিয়াকরণের সাফল্যে পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশের জন্য নেদারল্যান্ডস হতে পারে অন্যতম সহযোগী। কৃষিবীজ বিভাগ এ পর্যন্ত আলুর ৭১ জাতের বীজ অবমুক্ত করেছে। তবে আশাবাদের খবরটি হচ্ছে পাঁচ বছরে আলু রপ্তাানি অন্তত দশগুণ বেড়েছে। অধিক ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যে ফসলের উন্নত জাত ও প্রযুক্তিসহ নানা খামার যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন করেছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএআরআই) মেশিনারিজ বিভাগ।

আলু তোলার যন্ত্র পটেটো হারভেস্টার উদ্ভাবন করেছেন কৃষি বিজ্ঞানীরা। সারা দেশে আলু তোলায় এই যন্ত্র ব্যবহার করলে প্রতি বছর দেশের কৃষকদের সাশ্রয় হবে প্রায় পাঁচশ কোটি টাকা। এই যন্ত্র ব্যবহার করে কৃষকরা কম পরিশ্রমে, কম খরচে ও কম সময়ে মাটির নিচ থেকে অধিক আলু তুলতে পারবেন।

ত্রাণ কার্যক্রমে আলু বিতরণের নির্দেশ : ত্রাণ কার্যক্রমে চাল, গম, আটা ও অন্যান্য সামগ্রীর সঙ্গে আলু বিতরণের নির্দেশ দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। বিষয়টি নিশ্চিতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, এনজিওবিষয়ক ব্যুরো এবং শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব নাছিমা খানম স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, দেশে আলু উৎপাদন উত্তরোত্তর বাড়ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে আলু উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১১৩.৭১ লাখ টন। বর্তমানে আলুর পর্যাপ্ত মজুত আছে। উৎপাদিত আলুর যথাযথ ও বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত প্রয়োজন। এ জন্য বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবিলায় এমনকি হতদরিদ্রের মাঝে চাল, গম, আটা এবং অন্যান্য ত্রাণসামগ্রী বিতরণের পাশাপাশি আলুও বিতরণ করা যেতে পারে। ‘এতে একদিকে যেমন আলুর বহুমুখী ব্যবহার বাড়বে অন্যদিকে ভোক্তাপর্যায়ে আলুর চাহিদা পূরণ হবে এবং কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের বাজারজাত নিশ্চিত হবে।’

কাঙ্ক্ষিত সুফল পাচ্ছে না কৃষক ও অর্থনীতি : বাণিজ্যিকভাবে দেশে আলুর বহুমুখী ব্যবহার নেই। রপ্তানির ক্ষেত্রে যে ধরনের আলুর চাহিদা রয়েছে সেটির উৎপাদন এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। ফলে আলুর বাম্পার ফলন এবং চাহিদা মিটিয়ে প্রতিবছর প্রচুর উদ্বৃত্ত থাকলেও এ থেকে কৃষক ও দেশের অর্থনীতি কাঙ্ক্ষিত সুফল পাচ্ছে না। অনুসন্ধানে জানা গেছে গত বছরের এপ্রিল থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত আলুর দাম বাড়লেও এখন আবার কমতির দিকে। এবার কৃষক পর্যায়ে প্রতি মণ আলু বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকা। কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, কৃষকের দুঃখ দূর করতে তারা রপ্তানি ও শিল্পে ব্যবহারযোগ্য এবং আগাম জাতের আলু চাষে জোর দিচ্ছে। এ জন্য ২০১৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছর মেয়াদি ৫৯৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। প্রকল্পের আওতায় নীলফামারীর ডোমারে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) খামারে আগাম জাতের, উচ্চ ফলনশীল, রপ্তানি ও শিল্পে ব্যবহার উপযোগী আলু এবং আলুবীজের চাষ হচ্ছে। এ খামারে ৫১৬ একর জমির মধ্যে আলু চাষের উপযোগী ৩১০ একর। চলতি ২০২০-২১ উৎপাদন বর্ষে ২৫৬ একর জমিতে বীজ আলু উৎপাদন হয়েছে।

এডিবির এক গবেষণায় বলা হয়, শুধু দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় বছরে গড়ে চার কোটি ১০ লাখ ডলারের আলু আমদানি হয়। সেখানে বাংলাদেশ প্রতিবছর গড়ে আলু রপ্তানি করে আয় করে আট লাখ ডলার। মোট উৎপাদনের মাত্র শূন্য দশমিক ৩৬ শতাংশ আলু রপ্তানি হচ্ছে। কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের কন্দাল ফসল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. বিমল চন্দ্র কুণ্ডু বলেন, বাংলাদেশে উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল বিদেশি আলুর জাত আছে প্রায় ৮০টি। তবে বাংলাদেশে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে আলুচাষের প্রবণতা কম।

খাবারের তালিকায় আলু আনলেন যিনি : আলুকে মানুষের এত কাছে আনার কৃতিত্বটা এমন একজন বিজ্ঞানী ইভা একব্লাড। ১৬৫৮ সালে সুইডেনে প্রবেশ ঘটে আলুর। তখন এই সবজি ধনী ব্যক্তিদের খাবারের তালিকার উপকরণ ছাড়া আর কিছুই ছিল না। আলু নিয়ে গবেষণার পর ১৭৪৬ সালে ইভা একব্লাডের আবিষ্কার যেন পরিস্থিতির যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটিয়ে দিল। তিনি দেখালেন, এই আলু থেকে যেমন ময়দা তৈরি করা যায়, তেমনি তৈরি করা যায় অ্যালকোহলও। সে সময় সুইডেনে খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছিল। একব্লাডের গবেষণা দুর্ভিক্ষে বিকল্প খাবার হিসেবে আলু খেতেও শিখিয়েছে মানুষকে। সুইডেনের মানুষের খাদ্যাভ্যাসটাই যেন বদলে গেল। সুইডেনও খাদ্যসংকট কাটিয়ে উঠল। তবে সবকিছুরই নেতিবাচক দিক রয়েছে। একব্লাডের গবেষণায় যখন আলু থেকে বিভিন্ন খাদ্য উপকরণ তৈরির কৌশল শিখে গেল মানুষ, তখন সুইডেনে জমে উঠতে শুরু করল এর ব্যবসাও।

কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, বাংলাদেশে আলুতে পানি থাকে ৮০-৮২ শতাংশ। ইউরোপের দেশগুলোতে আলুতে পানির পরিমাণ সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ। এ ছাড়া ইউরোপের বাজারের সঙ্গে আমাদের আলু তোলার টাইমিং ঠিক নেই। এ জন্য আগাম চাষ বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, আমরা অনেকগুলো জাত এনেছি, যেগুলোতে পানি থাকবে ২০ শতাংশেরও কম। এ জাত জনপ্রিয় করা গেলে আন্তর্জাতিক বাজার আমাদের হাতে থাকবে। রপ্তানিও সহজ হবে।

বিএডিসির ‘মানসম্পন্ন বীজ আলু উৎপাদন ও সংরক্ষণ এবং কৃষক পর্যায়ে বিতরণ জোরদারকরণ’ প্রকল্পের আওতায় ডোমারে ভিত্তি বীজ আলু উৎপাদন হচ্ছে। পাশাপাশি নতুন জাতের উপযোগিতা যাচাইয়ের জন্য ট্রায়াল প্লট স্থাপন ও পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া প্রকল্পের আওতায় সারাদেশে ২৮টি জোনে চুক্তিবদ্ধ চাষির মাধ্যমে কৃষক পর্যায়ে বীজ আলু উৎপাদন হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে বারি উদ্ভাবিত মিউজিকা, সাগিতা, জার্মানি থেকে আনা আগাম জাত সানশাইন, প্রাডা, কুইন অ্যানি, ডোনাটা, সানতানা, লাবেলাসহ বেশকিছু জাত।

কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বর্তমানে সারাদেশে ২৮টি জোনের ৩০টি হিমাগার রয়েছে, যার বর্তমান ধারণক্ষমতা মোট ৪৫ হাজার ৫০০ টন। এ প্রকল্পের মেয়াদে দুই হাজার টন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন চারটি হিমাগার নির্মাণ করা হবে। ফলে বিএডিসির বীজ আলুর সংরক্ষণক্ষমতা উন্নীত হবে ৫৩ হাজার ৫০০ টনে। এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০২৯-৩০ সালের মধ্যে বীজ আলু উৎপাদন ৬০ হাজার টনে উন্নীত করা হবে।

বিএডিসির চেয়ারম্যান সাইদুল ইসলাম বলেন, অতীতে আমরা বিদেশ থেকে বীজ আমদানি করতাম। বর্তমানে বিএডিসি জৈবপ্রযুক্তি তথা টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে বীজ আলুর উৎপাদন প্রক্রিয়া শুরু করে। টিস্যু কালচার এমন একটি পদ্ধতি, যার মাধ্যমে গাছের অতি সূক্ষ্ম মেরিস্ট্রম নিয়ে তা থেকে কৃত্রিমভাবে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে রোগমুক্ত চারা তৈরি হয়। তিনি জানান, গত বছর বিএডিসি আমদানি করা ১৯ জাতের মধ্য থেকে ট্রায়ালের মাধ্যমে রপ্তানিযোগ্য ও শিল্পে ব্যবহারের উপযোগী ১০টি জাত নির্বাচন করে। এ বছর সারা দেশে ৩০০টি প্রদর্শনী প্লট ও মাল্টিলোকেশন টেস্ট পরিচালনা করা হচ্ছে। ২০২০-২১ উৎপাদন বর্ষে বিভিন্ন মানের ৩৭ হাজার ৫০০ টন বীজ আলু এবং পাঁচ হাজার টন রপ্তানি উপযোগী আলুসহ সর্বমোট ৪২ হাজার ৫০০ টন আলু উৎপাদন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। যন্ত্রের ব্যবহার ও কৃষকদের প্রশিক্ষণও চলছে।

লেখক : অর্থনীতি ও সমাজবিশ্লেষক
[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!