• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

খাদ্যে ভেজাল, প্রতারণা এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি


অলোক আচার্য সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২১, ০২:৪৪ পিএম
খাদ্যে ভেজাল, প্রতারণা এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি

ঢাকা : আমাদের শরীরের জন্য অতি প্রয়োজনীয় বস্তুটির নাম হলো খাদ্য। বর্তমানে শুধু খাদ্য শব্দটি ব্যবহার না করে নিরাপদ খাদ্য শব্দটির ওপর গুরুত্বারোপই করা উচিত। কারণ আমরা প্রতি বেলায় যে খাদ্য গ্রহণ করছি তা কতটা নিরাপদ বা ভেজালমুক্ত তা নিয়ে সংশয়, সন্দেহ রয়েছে। প্রতিনিয়তই ভেজাল খাদ্যের ফিরিস্তি দেখলে বা শুনলে কোনো খাদ্যই আর নিরাপদ বলে মনে হয় না। আমাদের শরীরে খাদ্যের সাথে প্রবেশ করছে বিষাক্ত উপাদান আর সেই বিষাক্ত উপাদান থেকে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হচ্ছে এবং বিভিন্ন ধরনের রোগ তৈরি করছে। আমরা জেনেশুনেই এবং স্বজ্ঞানে এই ভেজাল খাদ্য গ্রহণ করছি। অথবা বলা যায় আমরা গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছি। নিরাপদ খাদ্য পাওয়া আমাদের অধিকার। অসাধু ব্যবসায়ীদের দাপটে সেই অধিকার প্রতিদিন খর্ব হচ্ছে। আর সেই বাধ্যবাধকতার সুযোগেই অসাধু ব্যবসায়ীরা পণ্যে ভেজাল দিয়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছেন। এই করোনা মহামারীর মধ্যেও অসাধু ব্যবসায়ীদের এই খাদ্যে ভেজাল দেওয়ার প্রবণতা কমেনি, বরং আরো ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।

সম্প্রতি সরকারি প্রতিষ্ঠান জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরীক্ষাগারের প্রতিবেদনের তথ্যে দেখা গেছে, বাজারের কোনো পণ্যে ৬৬ শতাংশ, কোনোটিতে ৪৩ শতাংশ আবার কোনোটিতে ২৫ থেকে ২৮ শতাংশ ভেজাল। এমনকি দেশের প্রধান খাদ্যপণ্য চালেও ভেজাল মিলেছে প্রায় ৯ শতাংশ। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ভেজালের তালিকায় মিষ্টি জাতীয় পণ্য এগিয়ে আছে। আবার প্রতিদিনের খাদ্য চাল, ডাল, আটা, লবণ, সয়াবিন তেল, হলুদ ও মরিচেও রয়েছে ভেজাল। শিশুখাদ্যও ভেজালের আওতামুক্ত নয়। জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট সারা দেশ থেকে সংগ্রহ করে শতাধিক প্রকারের পণ্যের ১ হাজার ৫৮টি নমুনা পরীক্ষা করে। ‘খাদ্যে ভেজাল’ আমাদের এই দুর্ভোগ বছরের পর বছরজুড়ে চলে আসছে। একজন ব্যবসায়ী আমাদের কাছে নিরাপদ খাদ্যপণ্য সরবরাহ করবেন এটাই ছিল স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু এই স্বাভাবিক বিষয় এতটা অস্বাভাবিক হয়েছে যে আজকাল খাদ্য কিনে বিশ্বাসই হয় না যে এতে কোনো ভেজাল নেই। আমাদের চোখের অলক্ষে যে খাদ্য তৈরি হচ্ছে সেগুলোতে মাঝেমধ্যেই লোভী মানুষের যে ভয়ংকর কারসাজি দেখতে পাই তাতে বিশ্বাস করাও যায় না। এমন কোনো খাদ্য হয়তো আজ খুঁজে পাওয়া যাবে না যে, সেখানে কিছু লোভী মানুষ তাদের কারসাজি করছে না। নিরাপদ খাদ্য পাওয়াটা আজ আমাদের জন্য সত্যি খুব দরকার হলেও তা চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। একমাত্র বাড়িতে যখন কোনো কিছু তৈরি করে খাওয়া হচ্ছে অথবা ছাদে নিজের উৎপাদিত সবজি খেতে পারছি সেটাই যা একটু নিশ্চয়তা দেয়। বাকি সব খাদ্যেই সন্দেহ থাকছে। কোন খাদ্য নিরাপদ আর কোন খাদ্য ভেজাল দেওয়া তা চেনার উপায় নেই। আমরা তা পারিও না। আবার অনেকটা মেনেও নিয়েছি। আমরা জানি আমার সন্তান কি খাচ্ছে, কিন্তু আমরা এতটাই অসহায় যে জানার পরও কিছু বলার থাকছে না। কারণ সবাই তো তাই খাচ্ছে। তাহলে আমারই বা অসুবিধা কেন?

১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে খাদ্যে ভেজাল দেওয়া এবং ভেজাল খাদ্য বিক্রির সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। একই আইনে ১৪ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। ২০১৫ সালে সালে গঠন করা হয় ‘নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ’। নিরাপদ খাদ্যের বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে ২০১৮ সাল থেকে ফেব্রুয়ারির দুই তারিখকে ‘নিরাপদ খাদ্য দিবস’ হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করে আসছে। একজন ভোক্তা হিসেবেও আমাদের নিরাপদ খাদ্য পাওয়ার অধিকার রয়েছে। একজন ভোক্তা হিসেবে আমাদের আরো বেশি সচেতন এবং অধিকার সচেতন হতে হবে। খাদ্যে ভেজাল দিয়ে তিলে তিলে মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে যারা তারা কেন সুখে শান্তিতে জীবনযাপন করবে। প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও কোনো না কোনো খাদ্যপণ্য ভেজাল বলে শনাক্ত হচ্ছে। যারা খাদ্যপণ্যে ভেজাল দিয়ে বিক্রি করে বড়লোক বনে যাচ্ছেন, ভেজাল আসলে তাদের নিজেদের মধ্যে। মানুষ হিসেবে তারা সঠিক নয় বলেই তাদের কর্মেও তারা সঠিক নন। পৃথিবীর অনেক দেশে রমজান মাসে খাদ্যপণ্যের দাম কমানো হয়। আর আমাদের দেশে হয় ঠিক উল্টো। দাম যেন এ সময় না বৃদ্ধি পায় তার জন্য সরকারকে নানা পদক্ষেপ নিতে হয়। কিন্তু কেন? কেন আমরা নিজেরাই একটু সৎ হই না।

প্রতিদিন খাদ্যপণ্যে ভেজাল মিশিয়ে মোটা টাকা লাভ করে একদিকে এসব ব্যবসায়ীরা বাড়ি-গাড়ির মালিক ও সমাজের হর্তাকর্তা বনে যাচ্ছেন। অন্যদিকে যারা এসব পণ্য খাচ্ছে তারা নিত্য অসুস্থ হয়ে ডাক্তারের কাছে দৌড়ে মরছেন। এর থেকে মুক্তির উপায় কিন্তু কঠিন নয়। বরং সহজ। নিজেদের প্রতি একটু সততা। আমরা জানি কোনটি আমাদের করা উচিত আর কোনটি করা উচিত নয় । দেশপ্রেম অন্তরের বিষয়। ভেতরে দেশপ্রেম না থাকলে প্রকৃত উন্নয়ন অসম্ভব। আজ যারা মাছে, ফলমূলে ফরমালিন মেশাচ্ছেন, যারা মুড়ি ভাজার সময় ইউরিয়া সার ব্যবহার করছেন, যারা চালে মোম ব্যবহার করে পালিশ করছেন বা মোটা চাল ছেঁটে চিকন করে মোটা টাকা কামাচ্ছেন, যারা অখাদ্য-কুখাদ্য বাহারি মোড়কে মুড়িয়ে আমাদের খাওয়াচ্ছেন, তারাও কিন্তু বাজার থেকে ভেজাল পণ্য কিনেই বাড়ি ফিরছেন। তিনি নিজেও এই চক্রের প্রভাবের বাইরে নন।  বাইরে থেকে কারো বোঝার উপায় নেই কোন পণ্যটি ভেজাল আর কোনটি আসল বা খাঁটি। এখানে কেবলই বিশ্বাস কাজ করে। আর এই বিশ্বাস পুঁজি করেই এসব ভেজাল কারবারীরা মোটা টাকার মালিক হয়ে যান। ‘এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি, রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি’—কত বছর আগে কবি এ কথাটি বলেছিলেন, আর আজো সে কথার প্রয়োগ আমাদের সমাজের সর্বত্র ঘটে চলেছে। এত এত টাকার মালিক হওয়া সত্ত্বেও তিনি কিন্তু তার ভেজাল কারবার বন্ধ করছেন না।

দেশকে ভালোবাসি এটা প্রমাণ করার জন্য কোনো প্রচারের দরকার হয় না। দরকার হয় কাজের। দেশ এমনি এমনি উন্নত দেশে পরিণত হয় না। দেশকে উন্নত করতে হলে দেশের মানুষকে ভালোবাসতে হয়। ব্যবসায়ীরা এর বড় অংশীদার। কারণ তারা ব্যবসায়ের মাধ্যমে দেশের মানুষের কাছে খাদ্যপণ্য পৌঁছে দিচ্ছেন। আমি দেশের জন্য কতটুকু কাজ করছি, কী কাজ করছি সেটাই মুখ্য বিষয়। যারা ভেজাল ব্যবসায়ী তাদের ভেতর দেশপ্রেম থাকতেই পারে না। তারা কোনোভাবেই দেশের মানুষকে ভালোবাসতে পারে না। প্রত্যেকেই যদি যার যার জায়গা থেকে দুর্নীতি করে, তবে দেশটা চলবে কীভাবে? অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, যে-কোনো খাদ্যপণ্য কেনার আগেই মনে সন্দেহ জাগে। ভেজাল খাদ্যপণ্য ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আইন এবং সচেতনতা দুটোই একসাথে প্রয়োজন। তাদের শাস্তি এমন হতে হবে যাতে অন্য ব্যবসায়ীরা এই কাজ করতে সাহস না পায়। অন্যকে যারা বিষ খাইয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে তারা কেন কঠিন শাস্তির হাত থেকে রেহাই পাবে?

নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে সরকার আরো কঠোর হচ্ছে। খাদ্যে ভেজাল, নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ খাদ্য বিক্রিতে জারি হচ্ছে কঠোর বিধিনিষেধ। উন্নত দেশগুলোতে নিরাপদ খাদ্যপণ্য নিশ্চিত করতে কঠোর আইনের পাশাপাশি তা বাস্তবায়ন করা হয়। খাদ্যে ভেজাল দেওয়াকে মানুষ হত্যার কাছাকাছি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয় এসব দেশে। আর ভেজাল খাদ্য দিয়ে মানুষকে ক্রমেই মৃত্যুর ঝুঁকির মধ্যেই ফেলে দেওয়া হচ্ছে। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে আমাদের সচেতনতার সাথে সাথে কঠোরভাবে আইনের প্রয়োগ করতে হবে। জেনে ও বুঝে মানুষকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর মুখে ফেলে দেওয়া মানব হত্যার শামিল।

লেখক : সাংবাদিক
[email protected] 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!