• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ০২ মে, ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১

জান্নাতের নাজনিয়ামত


ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ জানুয়ারি ৩১, ২০২১, ০২:২২ পিএম
জান্নাতের নাজনিয়ামত

ঢাকা : আল্লাহতায়ালা মুমিনের জন্য তৈরি করে রেখেছেন চিরসুখের আবাসন জান্নাত। এ জান্নাতের বর্ণনা আল্লাহতায়ালা কোরআন মজিদে এবং বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদিসে সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। পার্থিব জীবনে যেসব মুসলিম আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে চলবে এবং পরকালীন হিসাবে যার গুনাহর চেয়ে পুণ্যের পাল্লা ভারী হবে ও আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করবে তাদের জন্য আল্লাহ জান্নাত প্রস্তুত রেখেছেন। আল্লাহ মানুষের মনের ইচ্ছা দিয়ে সাজিয়েছেন জান্নাত! যেখানে চিরস্থায়ী নাজনিয়ামত ও সব ধরনের ভোগবিলাস রয়েছে জান্নাতিদের জন্য প্রতিদানস্বরূপ।

আল্লাহ জান্নাতিদের আহ্বান করবেন, সম্মানিত মেহমানদের মতো তারা সামনে অগ্রসর হবে এবং আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হবে। এরশাদ হচ্ছে, ‘হে আমার বান্দাগণ, আজ তোমাদের কোনো ভয় নাই এবং তোমরা চিন্তিতও হবে না।’ সুরা জুখরুফ : ৬৮)। দুনিয়ার মতো সেখানেও তাদের নিজ নিজ বাড়ি-ঘর চিনবে। এরশাদ হচ্ছে : ‘অতঃপর তিনি তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার পরিচয় তিনি তাদেরকে ইতঃপূর্বে দিয়েছেন।’ (সুরা মোহাম্মদ-৬)। সম্মানিত ফেরেশতাগণ তাদেরকে নিরাপদ আগমন ও উত্তম গৃহের সুসংবাদ দিয়ে অভ্যর্থনা জানাবে। এরশাদ হচ্ছে : ‘যারা তাদের রবকে ভয় করেছে, তাদের দলে দলে জান্নাতে নিয়ে যাওয়া হবে। অতঃপর যখন তারা তাতে আগমন করবে ও দরজাসমূহ খুলে দেয়া হবে, তখন তাদেরকে জান্নাতের রক্ষীরা বলবে : ‘তোমাদের প্রতি সালাম, তোমরা সুখী, অতএব তোমরা এতে স্থায়ীভাবে প্রবেশ কর।’ (সুরা জুমার-৭৩)। অন্যত্র আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, ‘এবং ঘোষণা দেওয়া হবে, এটাই তোমাদের জান্নাত, তোমরা এর মালিক হয়েছ, তোমরা যে আমল করতে তার বিনিময়ে।’ (আরাফ-৪৩)।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : ‘জান্নাতে তাদের প্রথম দলটি প্রবেশ করবে, পূর্ণিমা রাতের চাদের মতো। অতঃপর তাদের দ্বিতীয় দলটি যাবে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো।’ (বুখারি-মুসলিম)। অন্যত্র মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : জান্নাতিরা জান্নাতে প্রবেশ করবে তাদের পিতা আদম আলাইহিস সালামের আকৃতিতে। তাদের প্রত্যেকের উচ্চতা হবে ষাট হাত।’ (বুখারি-মুসলিম)। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন : ‘তাদের মাঝে পরস্পর কোনো বিদ্বেষ থাকবে না, তাদের সবার অন্তর একটি অন্তরের মতো থাকবে।’ (বুখারি)।

এরশাদ হচ্ছে : ‘তাদের অন্তরে যে ব্যাধি রয়েছে, আমি তা দূর করে দেব, তারা মুখোমুখি চেয়ারে উপবিষ্ট, সকলে ভাই-ভাই।’(হিজর ৪৭)।

বর্ণিত আছে, জান্নাতিরা বেহেশতি আসনে বসে থাকবে, পক্ষিকুল তাদের সামনে এসে বৃক্ষের ডালে বসে নেহাত মিষ্টি মধুর কণ্ঠে বলবে, জান্নাতের এমন কোনো প্রস্রবণ বাকি নেই যার স্বাদ গ্রহণ করিনি। এমন কোনো শরাব নেই যা পান করিনি। এমন কোনো লীলাভূমি নেই যা অতিক্রম করিনি। আমার স্বাদ অসাধারণ । পক্ষিকুলের অমন তারিফ শুনে মুমিনরা তাকে খাওয়ার আকাঙ্ক্ষা করবে। আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী পাখিটি তার দরস্তখানে ভুনা অবস্থায় তার ইচ্ছানুযায়ী এসে উপস্থিত হবে। মুমিন তার চাহিদামতো ভক্ষণ করবেন। এরপর আল্লাহর হুকুমে পাখিটি জীবন্ত হয়ে উড়ে যাবে এবং অপরের সামনে সগর্বে বলবে, আমার চেয়ে সীেভাগ্যবান আর কে আছে, আল্লাহর প্রিয় বান্দা আমাকে তার লোকমা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তারপর পুনরায় সে তার আপন স্থানে বসের আগের মতো বলতে থাকবে।

‘হজরত যাবির (রা) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, অবশ্যই জান্নাতবাসীরা জান্নাতে খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করবে। কিন্তু তাদের থুথু ফেলার, প্রস্রাব-পায়খানা করার, কিংবা নাক ঝাড়ার প্রয়োজন হবে না। সাহাবিরা প্রশ্ন করলেন, তাদের ভক্ষ্যবস্তুর (পেটে) কী দশা হবে? রাসুল (সা) বললেন, ঢেকুর ও পরিচ্ছন্নতার মাধ্যমে বের হবে। কিন্তু মেশকের সুগন্ধ বের হবে। আর জান্নাতবাসীদের অন্তরে আল্লাহর তাসবিহ ও তাহমিদ এমনভাবে বেঁধে দেওয়া হবে যেমন শ্বাস-প্রশ্বাস (অর্থাৎ জান্নাতবাসীরা শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো সুবহানাল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ পাঠ করতে থাকবে)।’ (সহিহ মুসলিম)।

পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘তাতে রয়েছে দুর্গন্ধহীন পানির নহর; সুস্বাদু দুধের নহর; সুপেয় শরাবের নহর এবং পরিশোধিত মধুর নহর। সেখানে তাদের জন্য আরো রয়েছে, রকমারি ফলমূল এবং তাদের রবের পক্ষ থেকে ক্ষমা।’ (সুরা মোহাম্মদ-১৫)। তার ভেতর আরো আছে সুদীর্ঘ ছায়া, অনেক নেয়ামত, রুচিশীল ফল-ফলাদি, সুস্বাদু পাখির গোস্ত, তার পানাহার সব সময়ের জন্য উন্মুক্ত, কখনো শেষ হবে না। তার ছায়া কখনো নিঃশেষ হবে না। দীর্ঘ সময় তাতে আমোদ-প্রমোদ আয়োজন চলবে, তাতে ঘুম আসবে না, ঘুমের প্রয়োজনও হবে না। তার ফল মাখনের চেয়ে নরম, মধুর চেয়ে বেশি মিষ্টি। তার ফল হাতের নাগালে থাকবে, তার পানীয় সুস্বাদ্য, বৃক্ষরাজি অবনত, আনুগত্যশীল। এরশাদ হচ্ছে : ‘তার ফলসমূহ খুব নাগালে করে দেওয়া হয়েছে।’ (সুরা দাহর-১৪)। চাহিদা হওয়া মাত্রই ফলসমূহ সম্মুখে ঝুঁকে যাবে। এরশাদ হচ্ছে : ‘রেশমের আস্তর বিশিষ্ট বিছানায় হেলান অবস্থায় থাকবে। উভয় উদ্যানের ফল অবনত থাকবে।’ (সুরা রাহমান : ৪৫)। পানাহার ক্ষুধা নিবারণ কিংবা তৃষ্ণা মিটানোর জন্য নয়, বরং স্বাদ আস্বাদন আর মস্তি করার জন্য। আল্লাহ বলেন, ‘তোমার জন্য; তুমি এতে ক্ষুধার্থ হবে না এবং বস্ত্রহীনও হবে না। আর তুমি এতে পিপাসার্থ হবে না, রৌদ্র কষ্টও পাবে না।’ (সুরা ত্বহা : ১১৮-১১৯)। মোদ্দাকথা জান্নাতে কষ্টদায়ক কোনো বস্তু বিদ্যমান থাকবে না। ‘জান্নাতিরা থুথু ফেলবে না, নাকের শ্লেষা ফেলবে না এবং পায়খানাও করবে না।’ (বুখারি-মুসলিম)। ‘তাদের প্রয়োজন হবে শুধু ঢেকুর তোলার, মৃগ নাভি ছিটানোর মতো।’ (মুসলিম)।

আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, ‘হে আমার বান্দাগণ, তোমাদের আজ কোনো ভয় নেই এবং তোমরা দুঃখিত ও পেরেশান হবে না। তোমরা আমার আয়াতসমূহের বিশ্বাস স্থাপন করেছিলে এবং তোমরা আমার আজ্ঞাবহ ছিল। জান্নাতে প্রবেশ করো তোমরা এবং তোমাদের বিবিগণ সানন্দে। তাদের কাছে সোনার তৈরি ডিশ ও পানপাত্র পেশ করা হবে এবং সেখানে রয়েছে মন যা চায় এবং নয়ন যাতে তৃপ্ত হয়। তোমরা সেখানে চিরকাল থাকবে। এই যে জান্নাতের তোমরা উত্তরাধিকারী হয়েছ, এটা তোমাদের কর্মের ফল। সেখানে তোমাদের জন্য আছে প্রচুর ফলমূল, তা থেকে তোমরা খাবে।’ (সুরা জুমার : ৬৮-৭৩)। সুপ্রিয় পাঠক, আপনাদের যদি প্রশ্ন করা হয়, তোমরা কে কে জান্নাতে যেতে চাও? নিশ্চয়ই আপনারা একবাক্যে বলবেন আমরা সবাই জান্নাতে যেতে চাই। শুধু জান্নাতে যাওয়া কেন, চিরকাল জান্নাতের অধিবাসী হতে চাই। বেহেশতে যেতে চায় না এমন মানুষ পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। একজন মানুষ যতই পাপ করুক না কেন সে জান্নাতে যেতে চায়। জান্নাতের নাজনিয়ামত ভোগ করতে চায়। যারা আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করবে এবং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশিত পথে চলবে আল্লাহতায়ালা তাদের জান্নাত দান করবেন। তাদের তিনি এমন জান্নাত দান করবেন যার তলদেশ দিয়ে ঝরনাধারা প্রবাহিত। যারা সাফল্য লাভ করবে তাদের জন্য এটা আল্লাহর ওয়াদা।

মুত্তাকি লোকদের জন্য আল্লাহতায়ালা জান্নাতের বর্ণনা এভাবে দিয়েছেন, ‘তাতে রয়েছে পানির ঝরনাসমূহ, চির সুস্বাদু দুধের প্রবাহ এবং পানকারীদের জন্য বিশেষ স্বাদযুক্ত পানীয়ের প্রবাহ এবং বিশুদ্ধ নহরসমূহ।’ ঝরনাধারা প্রবহমান হবে স্বচ্ছ পরিচ্ছন্ন মধুর। সেখানে তারা যা খেতে চাইবে তাই পাবে। পার্থিব জীবনে আমাদের খাওয়াদাওয়ার পর তা আবার শরীর থেকে বেরিয়ে না গেলে আমরা খাবার গ্রহণ করতে পারি না। এটি আমাদের নিয়মিত কাজের অংশ কিংবা অভ্যাসও বটে। কিন্তু যারা জান্নাতবাসী হবে তাদের এমন কোনো প্রয়োজনীয়তা দেখা দেবে না। জান্নাতবাসীরা খাবার গ্রহণের পর যখন হজম হবে তখন ঢেকুরের মাধ্যমে তা নিঃশেষ হয়ে যাবে। পুনরায় তারা খেতে চাইবে, তাদের খেতে দেওয়া হবে। এভাবে দিনের পর দিন চলবে। কিন্তু পায়খানা বা প্রাকৃতিক কাজের প্রয়োজন হবে না। ঢেকুর ও পরিচ্ছন্নতার মাধ্যমে তা হজম হয়ে যাবে। তাদের এ ঢেকুরের সাথে যে গন্ধ বের হবে তা মেশকের সুগন্ধযুক্ত হবে। আল্লাহতায়ালা জন্নাতবাসীদের জন্য এমন ব্যবস্থা করে রেখেছেন যা দুনিয়ার কোনো ব্যবস্থাপনার সাথে মিলবে না। এত সুন্দর নাজনিয়ামত ভোগ করার আগ্রহ কার না জাগে? আমরা সবাই চাই এমন একটি সুন্দর জান্নাতের চিরস্থায়ী অধিবাসী হতে। পরিশেষে আমাদের সকলের আল্লাহতায়ালাকে বেশি বেশি ভয় করার পাশাপাশি প্রিয় নবীজির দেখানো পথ ও মতে নিজেদের পরিচালিত করে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন জরুরি। আল্লাহতায়ালা মুসলিম উম্মাহকে কোরআন-সুন্নাহ মোতাবেক জীবন পরিচালনা করার তাওফিক দান করুন। আমীন।

লেখক : কামিল হাদিস, ইসলামী বিশ্ব বিদ্যালয় কুষ্টিয়া।
কো-চেয়ারম্যান, হোমিও বিজ্ঞান গবেষণা ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র।

Wordbridge School
Link copied!