• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

দারিদ্র্য বিমোচনে জাকাতের ভূমিকা


আর.এম. আল আমীন আগস্ট ৬, ২০২১, ০৩:৪১ পিএম
দারিদ্র্য বিমোচনে জাকাতের ভূমিকা

ঢাকা : জাকাত আরবী শব্দ। শাব্দিক অর্থ পবিত্রতা বা বৃদ্ধি। শরিয়তের পরিভাষায় জাকাত হলো আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশে শরিয়তের নির্দেশ মতো নিসাব পরিমাণ মালের মালিক হলে, সেই সম্পদ থেকে এক নির্দিষ্ট পরিমাণ মালকে জাকাত গ্রহণের উপযোগী কোনো এক মুসলমান ব্যক্তিকে মালিক বানিয়ে দেওয়াকেই জাকাত বলে। জাকাত ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম একটি। আল-কোরআনে বারবার নামাজের পরেই জাকাত আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।  যেমন-‘তোমরা সালাত কায়েম করো এবং জাকাত আদায় করো।’ (সুরা বাকারা) অন্য আরেকটি আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা ইরশাদ করেন; ‘আপনি তাদের অর্থসম্পদ থেকে জাকাত উসুল করে তাদের পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করুন।’ (সুরা তাওবা, আয়াত-১০৩) ‘মুশরিকদের জন্য রয়েছে ধ্বংস, তারা জাকাত দেয় না।’ (সুরা হামীম) ‘আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশে তোমরা যে জাকাত দাও, মূলত তা জাকাত আদায়কারীর-ই সম্পদ বৃদ্ধি করে।’ (সুরা রুম) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তোমরা তোমাদের সম্পদ থেকে জাকাত পরিশোধ করো।’ (তিরমিযি)

জাকাত ইসলামী অর্থনীতির কত গুরুত্বপূর্ণ অংশ, তা বুঝতে ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর (রা.)-এর খেলাফতের দিকে দৃষ্টি দিলে বুঝতে পারব। তিনি খলিফা নিযুক্ত হওয়ার পর কিছু মানুষ জাকাত দিতে অস্বীকার করেছিল। তখন তিনি তাদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘যদি কারো কাছে জাকাতের পশু বাঁধার রশি পরিমাণও জাকাত প্রাপ্য হয়, আর সে তা আদায় করতে অস্বীকার করে, তবে তার বিরুদ্ধে আমি জিহাদ ঘোষণা করব।’

সেই জাকাত আজ মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ দেশে শুধু প্রথা হিসেবে চালু রয়েছে। কেউ কেউ তো জাকাত দিতেই অনিহা প্রকাশ করে, কিংবা দিলেও  তা শুধু লোক দেখানোর জন্য দেয়। সে জন্যেই তো আজ মুসলিম বিশ্বে অভাবী ও নিঃস্ব লোকের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধিই পাচ্ছে। তাছাড়া জাকাতের বর্তমান ব্যয়পদ্ধতি দ্বারা না সমাজের প্রকৃত কল্যাণ হচ্ছে না অভাবী ও দরিদ্র জনগণের সমস্যার স্থায়ী সুরাহা হচ্ছে। ইসলামে জাকাত ও তার বিলি-বণ্টন ব্যক্তির খেয়াল খুশির ওপর ছেড়ে দেয়নি; বরং রাষ্ট্রের ওপর এর আদায় ও বণ্টনের দায়িত্ব অর্পণ করেছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলেন, ‘আপনি তাদের অর্থসম্পদ থেকে জাকাত উসুল করে তাদের পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করুন।’ (সুরা তাওবা, আয়াত-১০৩) এই আয়াত দ্বারা পরিষ্কারভাবে বুঝা যায়, জাকাত আদায় করা হবে রাষ্ট্রীয় ভাবে। বিভিন্ন মুসলিম প্রধান রাষ্ট্রে, রাষ্ট্রীয়ভাবে জাকাত আদায়ের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় আছে। যেমন, সৌদি আরব, ইরান, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, লিবিয়া, জর্দান, বাহরাইন, সুদান, কুয়েত ও ইয়ামেনে রয়েছে।

কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো; বাংলাদেশ, ইরাক, ওমান, ইত্যাদি মুসলিম দেশগুলোতে জাকাত সংগ্রহের জন্য সরকারের কিছুটা উদ্যোগ পরিলক্ষিত হলেও বাধ্যতামূলকভাবে পালনীয় কোনো আইন আজ অবধি প্রণীত হয়নি। বাংলাদেশে জাকাত উসুলের বোর্ড প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮২ সালে। এই উসুলকৃত জাকাত ব্যবহারের জন্য একটা উপদেষ্টা কমিটি রয়েছে। এই তহবিলে জাকাতের অর্থ জমা দেওয়া সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাধীন। তাই এ পর্যন্ত জাকাতের অর্থে গড়ে আয় বার্ষিক বিশ লাখের বেশি নয়। অথচ ২৪-০৬-২০২০ এর এক বর্ণনা মতে, বাংলাদেশে কোটিপতি ছিল ৯২,১১৫ জন। যদি বাধ্যতামূলক জাকাত উসুলের জন্য কোনো মন্ত্রণালয় স্থাপন করা হতো, তাহলে শুধুমাত্র কোটিপতিদের কাছ থেকে বার্ষিক জাকাত উসুল হতো ২,৩০,২৮,৭৫,০০০/= (দুইশত ত্রিশ কোটি আটাশ লক্ষ পঁচাত্তর হাজার টাকা)। ২০১৯ সালে দরিদ্রে হার দাঁড়িয়েছিল ২১ দশমিক ৮ শতাংশে। কিন্তু ২০২০ সালে করোনা প্রভাবে দরিদ্রের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ শতাংশ। ২,৩০,২৮,৭৫,০০০/= (দুইশত ত্রিশ কোটি আটাশ লক্ষ পঁচাত্তর হাজার টাকা যদি ৪০ শতাংশ হতো দরিদ্রের মাঝে বণ্টন করে দিলে কিছু দিনের মধ্যে ওরা স্বাবলম্বী হয়ে যেত। এমনকি দারিদ্র্যের হারও কমে শূন্যের কোঠায় নেমে আসত। কিন্তু তা হচ্ছে কোথায়? ধনী সে তো ধনকুবে পরিণত হচ্ছে। আর হত দরিদ্রের বিষয়টি হচ্ছে তার বিপরীত।

জাকাত না দেওয়ার আযাব : ‘আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যাকে আল্লাহ সম্পদ দান করেছেন, অথচ সে তার জাকাত আদায় করেনি, কিয়ামতের দিন তার জন্য তার সম্পদকে বিষধর (অজগর) সাপের রূপ ধারণ করানো হবে-যার দুই চোখের ওপর দুটি কালো দাগ থাকবে। অতঃপর তার গলায় বেড়ী হয়ে তার মুখের দুদিক থেকে তাকে দংশন করতে থাকবে এবং বলতে থাকবে আমি তোমার মাল, আমি তোমার সংরক্ষিত সম্পদ। মহান আল্লাহ বলেন, আর যারা সোনা-রূপা জমা করে রাখে অথচ তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না। তাদের যন্ত্রণাদায়ক আজাবের সুসংবাদ দিন। যেদিন সেগুলো জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করা হবে, অতঃপর তা দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্বদেশ এবং তাদের পৃষ্ঠদেশসমূহে দাগ দেওয়া হবে। (এবং বলা হবে) এ হলো যা তোমরা তোমাদের জন্য সঞ্চয় করেছিলে, এখন তার স্বাদ গ্রহণ করো যা তোমরা সঞ্চয় করেছিলে। (সুরা তাওবা, আয়াাত-৩৪, ৩৫)

জাকাত দেওয়ার উপকারিতা : আবু সাঈদ (রা.) বর্ণনা করেন, ‘একদা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে নসিহত করছিলেন। তিনবার শপথ করে তিনি বললেন, ‘যে ব্যক্তি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়বে, রমজানের রোজা রাখবে, জাকাত প্রদান করবে এবং সব ধরনের কবিরা গুনাহ থেকে বিরত থাকবে আল্লাহতায়ালা তার জন্য অবশ্যই বেহেশতের দরজা খুলে দিয়ে বলবেন, ‘তোমরা নিরাপদে তাতে প্রবেশ করো।’ (নাসায়ী, হাদিস নং-২৩৯৫) জাকাত আদায় করার দ্বারা মানুষের ধন-সম্পদ বাড়তে থাকে। বরকতে কানায় কানায় ভরে ওঠে মানুষের সম্পদ।

জাকাতের অর্থ দিয়ে যেভাবে দারিদ্র্য মোচন করা যায় : আমাদেরকে প্রথমে জানতে হবে একটি দরিদ্র পরিবারের কী কী সমস্যা রয়েছে? তারপর সে সমস্যানুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া। আমরা যদি তাদের দিকে লক্ষ করি তবে দেখতে পাবো তাদের অনেক পরিবারই প্রায়শই অনাহারে অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছে। সুচিকিৎসার অভাবে ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ছে। যে শিশুটি শিক্ষা নিকেতনের আলোকময় পরিবেশ থেকে নিজেকে আলোকিত মানুষরূপে গড়ে তোলার কথা ছিল, দারিদ্র্যের কারণে তাকে আজ দেখা যাচ্ছে হাটে-ঘাটে, রাস্তায়, স্টেশনে শ্রমবিক্রি করতে ব্যস্ত। এদের কেউ তো আবার ভিক্ষার পথে বেছে নিয়েছে। অনেকে আবার নর্দমা কিংবা ডাস্টবিন থেকে ফলে দেওয়া খাবার খেয়ে কোনো মতে দিন গুজার করছে।

অন্য দিকে এনজিও সংস্থাগুলো দারিদ্র্য বিমোচনের শ্লোগানকে পুঁজি করে ঋণ দেওয়ার নামে সুদি ব্যবসার রমরমা আসর বসিয়েছে। দারিদ্র্যকে পুঁজি করে শিক্ষা সমপ্রসারণের নামে ধর্মান্তরিত করছে হাজার হাজার মুসলিম শিশুকে। তাদের কাছে নাচ-গান নৃত্যকে করে তুলছে প্রিয়। ফলে যে শিশু হওয়ার কথা ছিল মানবতাবোধে উদ্বুদ্ধ, আল্লাহপ্রেমী, ঈমান দীপ্ত খাঁটি মুসলমান, সে শিশু হচ্ছে আজ আধুনিকতার নামে উগ্র ও মুক্তমনার দিগভ্রান্ত নাস্তিক। এধারা অব্যাহত থাকলে নিকট ভবিষ্যতে দেখা যাবে, আমরা মুসলমানরা নিজ দেশে পরবাসী। এক কথায় দারিদ্র্যের কারণে আজ আমাদের ঈমান ও স্বাধীনতা হুমকির সম্মুখীন। যার বাস্তবতার সামনে আজ আমরা দণ্ডায়মান।

এই জাকাতের অর্থ দিয়ে একটি দারিদ্র্য পরিবারকে আমরা ছোটখাটো কোনো ব্যবসা ধরিয়ে দিতে পারি, ওদের পরিবারে দিতে পারি একটি করে সেলাই মেশিন, দিতে পারি মৎস্য বা অন্যান্য পশুর খামার। তার শিক্ষার্জনের জন্য ‘ইসলামী একাডেমি’ খুলে ধরিয়ে দিতে পারি জীবন চলার পন্থা। এভাবেই একদিন দেখা যাবে অনেকাংশেই দারিদ্র্যের হার কমে গেছে। তারা স্বাবলম্বী হতে শুরু করেছে। আর তার সম্ভব হবে যখন আমরা ন্যায়ভাবে জাকাত আদায় করে তা সুষ্ঠুভাবে বিলি করতে পারব। আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে সঠিক বুঝার ও আমল করার তৌফিক দান করুক, আমীন।

লেখক : প্রাবন্ধিক
সদস্য, বাংলাদেশ নবীন লেখক ফোরাম

Wordbridge School
Link copied!