• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

কারাগারে রাজসিক জীবন!


নিজস্ব প্রতিবেদক জানুয়ারি ২৭, ২০২১, ০৪:৩৩ পিএম
কারাগারে রাজসিক জীবন!

ঢাকা : রাজধানীর রামপুরা এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী ইয়াসিন খান পলাশ ওরফে কাইল্যা পলাশ প্রায় ২০ বছর ধরে কারাগারে। অথচ ৮ বছর আগে তার একটি মেয়ে সন্তান হয়।

তার স্ত্রী মাহমুদা খানম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ওই সন্তানের বাবা কারাগারে থাকা পলাশ। ঢাকার আদালতে যখন হাজিরা দিতে আসতেন তখন রামপুরার বাসায় ঢুকতেন। কখনো দুই চার ঘণ্টা আবার কখনো পুরো দিন কাটাতেন। কাশিমপুর, রাজশাহী, দিনাজপুর ও মুন্সীগঞ্জ কারাগার ঘুরে এখন তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে থাকেন।

২০১৬ সালে কাইল্যা পলাশের মেয়ে হওয়ার খবর প্রকাশে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছিল। দীর্ঘ ৪ বছর পর কারাগারের অভ্যন্তরে বহুল আলোচিত হলমার্কের জেনারেল ম্যানেজার তুষারের নারীসঙ্গের ঘটনা আবারো আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, কারাগারে থাকা সন্ত্রাসীরা বিভিন্নভাবে কারা কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে একদিকে যেমন বাবা হয়েছেন, তেমনি নারীসঙ্গও পেয়েছেন। অর্থাৎ টাকায় ম্যানেজ করে কারাগারে মাদক-নারী সবই পাওয়া সম্ভব। সেখানে তারা মুক্তজীবনের মতোই থাকেন। আবার সেখানে বসে চাঁদাবাজিও করেন। এক কথায় আয়েশী জীবনই চলে কারাগারে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডনরা কারাগারে বন্দি থাকলেও সময় কাটে মুক্তজীবনের মতো। চাঁদাবাজির সিংহভাগই তারা খরচ করেন কারাগারের ভেতরে। রাজার হালেই কাটে তাদের দিনকাল। তবে এসব অবৈধ সুযোগ বর্তমানে কিছুটা কমেছে।

জানা গেছে, ভারতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত, দুর্ধর্ষ মামলার সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিরা কারাগারে তাদের স্ত্রীদের সঙ্গে একান্তে সময় কাটাতে পারেন। এমনকী তারা চাইলে সন্তান নিতেও পারবেন। যদিও এ সুযোগটি কয়েদিরা পাচ্ছেন এক বছর ধরে। কিন্তু বাংলাদেশে কয়েদিদের তাদের স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ সুযোগ তারা নিচ্ছেন অবৈধভাবে। লেনদেনের মাধ্যমে।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, বন্দি থাকা অবস্থায় কাইল্যা পলাশ আর রায়পুইরা সেইল্লা ছাড়াও বাবা হয়েছেন আমিনবাজারের মামুন, শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও মহাখালীর এক তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। এদের মধ্যে মামুন প্রতিপক্ষের হামলায় ও সেইল্লা পুলিশের ক্রসফায়ারে নিহত হন।

জানা যায়, জেলখানার জীবন মানেই এক ভিন্ন জীবন। সেখানে শাস্তি হিসেবেই জীবন কাটাতে হয়। কিন্তু আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডনদের ক্ষেত্রে এটি কার্যকর নয়। তারা কারাগারে থেকে যেমন বাইরের আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ করেন, তেমন ভেতরে বিলাসী জীবনযাপন করেন।

তাদের যা ইচ্ছা হচ্ছে, তাই তারা পূরণ করছে। ভেতরে বসে মোবাইল ফোনে কথা বলছেন। ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন। ব্যবসায়ীদের হুমকি দিচ্ছেন, চাঁদাবাজি করছেন। চাঁদার টাকা সময়মতো কারাগারেই পৌঁছে যাচ্ছে। কারা কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই তারা বছরের পর বছর এই বিলাসী জীবনযাপন করছেন।

আদালতে হাজিরার দিন আদালত চত্বরেই হাজির হন তাদের অনুসারীরা। সেখানেই তারা সামনাসামনি নির্দেশনা দিচ্ছেন। বিচার-আচার করছেন বাহিনীর সদস্যদের। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও সময় কাটান। কারাগারে তাদের থাকা-খাওয়ার সুযোগ-সুবিধা ভিআইপিদের মতোই।

কাশিমপুর কারাগারে ডনদের এ সুযোগ সবচেয়ে বেশি। এমন বিলাসী জীবনযাপনের সংবাদে ইতোমধ্যে একাধিকবার জেলখানার অভ্যন্তরে অভিযান চালানো হয়েছে। সন্ত্রাসীদের কক্ষে রঙিন টিভি, মোবাইল ফোন সেট, সিম ও মেমোরি কার্ড এবং মাদকদ্রব্য পাওয়া গেছে।

সূত্র জানায়, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের এ অবৈধ সুযোগ-সুবিধা আদায় এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তারা বাসাবাড়িতে গিয়েও পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর মতো নজিরবিহীন ঘটনা ঘটিয়েছেন।

শীর্ষ সন্ত্রাসী কাইল্যা পলাশের বাসায় গিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে থাকার ঘটনাটি ২০১৬ সালে ফাঁস হয়। যুবদল নেতা মিজানুর রহমান মিজান হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজা ভোগ করছেন কাইল্যা পলাশ।

২০০২ সালের ২৯ মে রামপুরায় যুবদল নেতা মিজানকে গুলি করে হত্যার মামলায় বিচারিক আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল। উচ্চ আদালত তার সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়।

পলাশের স্ত্রী মাহমুদা খানম বলেছেন, খুনের মামলায় ২০০৩ সালে গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে জেলে আছেন তার স্বামী। ২০১২ সালের অক্টোবরে মুন্সীগঞ্জ হাসপাতালে জন্ম হয় তাদের মেয়ে খাদিজার। তিনি স্বীকার করেন, কারাগার থেকে আদালতে হাজিরা দিয়ে ফেরার পথে রামপুরার বাসায় দেখা করে যেতেন পলাশ।

আগে মাসে দু-তিনটি হাজিরা থাকত, তখন বেশি আসতেন, এখন কম। কখনো কয়েক ঘণ্টা, কখনো সারা দিন পরিবারের সঙ্গে থাকেন। প্রিজন ভ্যানে নয়, মাইক্রোবাসে করেই ইয়াসিন খান আসা-যাওয়া করতেন। বাড়ির বাইরে পাহারায় থাকতেন কারারক্ষীরা।

কারা অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, কাশিমপুর থেকে ঢাকার বিভিন্ন আদালতে হাজিরা দেওয়ার সময় পুলিশি পাহারায় প্রিজন ভ্যানে যাতায়াত করেছেন তিনি। স্ত্রী মাহমুদা বলেছেন, পুলিশের সহযোগিতায় তার স্বামী রামপুরার বাসায় আসা-যাওয়া করতেন মাইক্রোবাসে। প্রিজন ভ্যানে কখনো আসেননি।

সূত্র জানায়, পুলিশ হত্যাসহ দুই ডজন মামলার আসামি তেজগাঁওয়ের সেলিম ওরফে রায়পুইরা সেইল্যা গ্রেপ্তার হন ২০০২ সালে। জামিনে ছাড়া পান ২০০৬ সালে। কিন্তু সেলিম কন্যাসন্তানের জনক হন ২০০৪ সালে। সন্তানের পিতা হওয়ায় তিনি কারাগারে মিষ্টিও খাইয়েছিলেন। তার স্ত্রী পারভীন আক্তার পিস্তল চালাতে পারদর্শী। তিনিও পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলেন একাধিকবার।

পারভীন আক্তারের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো জানায়, কোর্ট গারদে দেখা করার সময় বিশেষ কক্ষ যাকে ‘ফ্রি পোর্ট’ বলা হতো, সেখানে তারা মিলিত হতেন। জামিনে ছাড়া পাওয়ার চার মাসের মাথায় ক্রসফায়ারে নিহত হন দুর্ধর্ষ সেলিম। আমিনবাজারের মামুন ১৯৯৪ সালে গ্রেপ্তারের পর ছিলেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। কোর্ট গারদ ও জেলখানায় গিয়ে দেখা করতেন তার ছোট স্ত্রী।

কোর্ট গারদে সেই সময় তারা সময় কাটাতেন। জেলখানায় থেকেই তিনি পিতা হওয়ার সংবাদ পান। তিনিও সেই সময় জেলখানায় মিষ্টি বিতরণ করেছিলেন। ১৯৯৬ সালে মিরপুরে মোল্লা মাসুদ গুলি করে তাকে হত্যা করেন। ঈদের আগে স্ত্রীকে নিয়ে শপিং করে রিকশায় ফিরছিলেন মামুন। কিন্তু ওঁৎ পেতে থাকা মোল্লা মাসুদের বাহিনী তাকে গুলি চালায়। মামুনও গুলি চালালে তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়।

বাংলাদেশের আরেক ডন সুব্রত বাইন। আন্ডারওয়ার্ল্ডে গ্যাং কিলিং জনপ্রিয় করে তোলেন অপরাধ জগতের এই মুকুটহীন সম্রাট। রাজধানীর আন্ডারওয়ার্ল্ডের শক্তিশালী দুটি গ্রুপের মধ্যে অন্যতম সেভেন স্টারের তিনি জনক। ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকা প্রকাশের পর থেকে তিনি পলাতক। বর্তমানে কলকাতা কারাগারে রয়েছেন।

১৯৯৭ সালে নয়াপল্টন এলাকার একটি হাসপাতাল থেকে গোয়েন্দা পুলিশের এসি আকরাম ১২ সহযোগীসহ গ্রেপ্তার করেন সুব্রতকে।  তিনিও জেলে থাকার সময় সন্তানের জনক হন। তার স্ত্রীর সঙ্গে সেই জেলগারদেই নিয়মিত দেখা করতেন বলে জানা গেছে। জামিন পাওয়ার পরই ভারতে গিয়ে আত্মগোপন করেন।

২০১২ সালের ৮ নভেম্বর সুব্রত বাইন ১২ সহযোগীসহ নেপালের কারাগার থেকে সুড়ঙ্গ কেটে পালান। ২৭ নভেম্বর কলকাতা পুলিশের হাতে ফের গ্রেপ্তার হন। এরপর তাকে দেশে ফেরাতে ভারতের সঙ্গে একাধিকবার বাংলাদেশ চিঠি চালাচালি করে। কিন্তু তাকে দেশে ফেরত আনা যায়নি।

সর্বশেষ তথ্যমতে, গত মাসে আলীপুর কারাগারে আটক সুব্রত বাইনের কাছ থেকে সাতটি সিম কার্ড ও একটি মোবাইল ফোন সেট উদ্ধার করা হয়েছে; যা লালবাজার পুলিশ হেডকোয়ার্টারে জমা রয়েছে। ওই সিমগুলো দিয়েই তিনি ঢাকায় নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। বর্তমানে আলোচিত এ সন্ত্রাসী দুবাইয়ে আছেন বলে জানা যায়।

সূত্র জানায়, মহাখালীর আরেক ডন কিলার আব্বাস জেলে থাকা অবস্থাতেই বাবা হয়েছেন। তিনি এখনো জেলে রয়েছেন। সেখান থেকেই পরিবারের খোঁজখবর নেন তিনি। আব্বাসের স্ত্রী হামিদা বেগমের দাবি, তার ছেলের বাবা কারাগারে থাকা আব্বাস। তিনি পুলিশকে ম্যানেজ করে মিরপুরের বাসায় আসতেন। দীর্ঘ সময়ও কাটাতেন। ছেলের বয়স এখন প্রায় ৬ বছর। তার ক্যানসার হয়েছে।

এছাড়া কারাগারে থেকেই মোবাইল ফোনে বিয়ে করেছেন রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ক্ষমাপ্রাপ্ত ফাঁসির আসামি লক্ষ্মীপুরের আলোচিত মেয়র আবু তাহেরের জ্যেষ্ঠপুত্র আফতাব উদ্দিন বিপ্লব (৩৮)। ২০১৪ সালে লক্ষ্মীপুর কারাগারে এ বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। ওই বিয়ের দেনমোহর ধরা হয় ১০ লাখ টাকা।

বিয়ের সময় বিপ্লবের বাবা আবু তাহের, ভাই এ কে এম সালাহ উদ্দিন টিপুসহ অর্ধশতাধিক মেহমান উপস্থিত ছিলেন। পরে কারাগারের গেটে কাবিননামায় স্বাক্ষর করেন বিপ্লব। সূত্র জানায়, পিতা হননি, কিন্তু স্ত্রী বা বান্ধবীদের সঙ্গে সময় কাটাননি এমন কোনো ডন নেই। প্রায় প্রত্যেকেই এ সুযোগ নিয়েছেন অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঊর্ধ্বতন কারা কর্মকর্তা বলেন, ‘কারাগারে চাকরি করলেও আমাদেরও সমাজে সন্তান ও পরিবার নিয়ে বসবাস করতে হয়। এসব সন্ত্রাসী বা দাগি আসামির অপরাধের ধরন অনুযায়ী শাস্তি প্রয়োগ করা হলে বা কঠোর হলে তাদের হুমকিতে আমাদের পরিবারের সদস্যদের স্বাভাবিক জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।

এছাড়া কারা-অভ্যন্তরে আটক দুর্ধর্ষ বন্দিদের নানা অপরাধের দরুন জেলকোড অনুযায়ী শাস্তি প্রদান করা হয়। কিন্তু কোনো কোনো অপরাধী এতোই ক্ষমতাবান ও দুর্ধর্ষ যে তাদের করা অপরাধ জেনেও কোনো প্রকার শাস্তি প্রয়োগ করা সম্ভব হয় না। অনেক সময় তাদের অপরাধের কথা জেনেও চুপ থাকতে হয়।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোমিনুর রহমান মামুন সাংবাদিকদের বলেন, কাইল্যা পলাশ ও কিলার আব্বাসের সন্তানের বাবা হওয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে তুষার আহমেদের নারীসঙ্গের বিষয়টি এরইমধ্যে নজরে এসেছে। এ ঘটনায় একটি কমিটি তদন্ত করছে।

তদন্তের স্বার্থে এরইমধ্যে সিনিয়র জেলসুপার রত্না রায়, জেলার, ডেপুটি জেলারসহ পাঁচ কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করে অধিদপ্তরে সংযুক্ত করা হয়েছে। কমিটি প্রতিবেদন দিলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, কারাগারের অনিয়ম দূর করতে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

 

 

Wordbridge School
Link copied!