• ঢাকা
  • রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

কৃষিতে যন্ত্র ব্যবহারে বিপ্লব


বিশেষ প্রতিনিধি জুন ৫, ২০২১, ০১:৩৮ পিএম
কৃষিতে যন্ত্র ব্যবহারে বিপ্লব

ঢাকা : খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, যখন গরু আর লাঙল-জোয়ালই ছিল কৃষকের ভরসা। সারাদিন খেটে মাঠে ফলাতো স্বপ্নের ফসল। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় সেদিন আর নেই। নতুন নতুন যন্ত্রপাতির ব্যবহারে দেশের কৃষিখাতে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন।

এসব যন্ত্রের ব্যবহারের ফলে কৃষকের কমেছে শ্রম ও খরচ, অপরদিকে কয়েকগুণ বেড়েছে উৎপাদন। চারা রোপণ থেকে শুরু করে ফসল কাটা পুরো প্রক্রিয়াই হচ্ছে যন্ত্রের মাধ্যমে।

এবারের বোরো মৌসুমে কম্বাইন হারভেস্টারে হয়েছে ফসল কাটা। একেকটি হারভেস্টার যন্ত্র দিয়ে প্রতি ঘণ্টায় প্রায় এক একর জমির ধান কাটা সম্ভব। ফলে ধান কাটা-মাড়াইয়ের অনেক টাকার সাশ্রয় হয়েছে কৃষকের। বিশেষ করে প্রতিকূল আবহাওয়া আসার ধানকাটা, মাড়াই শেষ হওয়ার কারণে কৃষককুলে ছিল স্বস্তির নিঃশ্বাস।

শুধু তাই নয়, কৃষকের জমিতে পানি দিতে এখন দখল করে নিয়েছে পাওয়ার টিলার। সঙ্গে যোগ হয়েছে আরো নতুন যন্ত্রপাতি। যা পুরো কৃষিকে বদলে দিয়েছে। শ্রম আর সময় বাঁচিয়ে দূর্দান্তগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে কৃষি।

কৃষি কর্মকর্তাদের আশা আধুনিক যন্ত্রপাতি আর কৃষিবিদদের পরামর্শে কৃষকরা দিন দিন লাভবান হচ্ছেন। খরচ কম আর উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষকরা আরো বেশি কৃষি ফসল উৎপাদনে মনোযোগী হচ্ছেন।

কৃষিতে যোগ হয়েছে রাইস ট্রান্সপ্লান্টারও : কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, নিয়ন্ত্রিত ও নিখুঁতভাবে নির্দিষ্ট পরিমাণে চারা রোপণ সুবিধার কারণে যন্ত্রটির প্রতি দিন দিন আগ্রহী হয়ে পড়ছে কৃষকরা। রাইস ট্রান্সপ্লান্টার যন্ত্র দিয়ে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে বিভিন্ন দূরত্বে ও গভীরতায় চারা রোপণ করা যায়। একজন শ্রমিক ঘণ্টায় প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ জমিতে চারা রোপণ করতে পারে।

যন্ত্রটি ব্যবহার করতে জ্বালানি খরচও খুব কম, ঘণ্টায় মাত্র ০.৫-০.৬ লিটার অকটেন প্রয়োজন পড়ে। যন্ত্রটি ব্যবহার করলে বীজতলা তৈরি করার জন্যও আলাদা জমির প্রয়োজন হয় না। বাড়ির উঠানেই বীজতলা তৈরি করা সম্ভব।

কৃষিতে আরো ব্যবহার করা হচ্ছে ইনক্লাইন্ড প্লেট সিডার যন্ত্রও : জমির সারিতে এ যন্ত্রটির সাহায্যে বীজ বুনলে কম বীজ লাগে, সহজে আগাছা পরিষ্কার করা যায়, গাছ বেশি আলো -বাতাস পায় এবং সর্বোপরি উৎপাদন বাড়ে। সারিতে ও নির্দিষ্ট দূরত্বে এবং গভীরতায় সহজে বীজ বোনার জন্য পাওয়ার টিলার চালিত বীজ বপন যন্ত্রটি উদ্ভাবন করা হয়।

এ যন্ত্র দিয়ে চাষ করা জমিও চাষবিহীন অবস্থায় বেলে ও বেলে দোআঁশ মাটিতে ধান, গম, ভুট্টা, পাট, তৈলবীজ ও ডালশস্য সারিতে বোনা যায়। এ যন্ত্রটি ব্যবহারে প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে প্রায় ১০-৪০ শতাংশ বীজ কম লাগে এবং ফলন ১০-১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। এ পদ্ধতিতে প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ০.১৮ হেক্টর (৪৫ শতাংশ) জমিতে বীজ বপন করা যায়।

ধান ও গম কাটার যন্ত্র ‘রিপার’ ফসল কাটার মৌসুমে ব্যবহার হচ্ছে। এই মেশিন ব্যবহার করে ১ ঘণ্টায় ৬৬ শতাংশ জমির ধান ও গম কাটা সম্ভব এবং এখানে পেট্রোল খরচ হচ্ছে মাত্র ১ লিটার।

যেখানে সনাতন পদ্বতিতে প্রয়োজন হচ্ছে ১০/১২ জন শ্রমিকের, যার খরচ ন্যূনতম ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা। কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর অফিস বলছে এ যন্ত্র ব্যবহারে সাশ্রয় হচ্ছে ৯২ ভাগ খরচ, শ্রম ও সময় ব্যয় কমে প্রায় ৯০ ভাগ।

আর বেড প্লান্টার ব্যবহার করে বেড-নালা তৈরি করা হচ্ছে : আলু, ভুট্টা, মরিচ, সবজিসহ বিভিন্ন প্রকার ফসল বীজ-ফারো বা বেড-নালা তৈরি করে আবাদ করা হয়।

বেড পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদন করলে বাতাস সহজেই গাছের শিকড়ের কাছে যেতে পারে। এ যন্ত্রের ব্যবহারে ১-২টি চাষে বেড তৈরি, সার প্রয়োগ ও বীজ বপনের কাজ একই সঙ্গে করা যায়, স্থায়ী বেডেও বীজ বপন করা যায়, যন্ত্রটি প্রতি ঘণ্টায় ০.১১ হেক্টর জমিতে বেড তৈরি করতে পারে।

আরো ব্যবহার হচ্ছে কম্বাইন্ড হারভেস্টার : অনেকটা ট্রাক্টরের মতো দেখতে এ যন্ত্র দিয়ে একই সাথে ধান কাটা, মাড়াই ও বস্তায় ভরা যায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে। কম্বাইন্ড হারভেস্টার ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন খরচ ৬০-৭০ শতাংশ পর্যন্ত খরচ কমানো যায়। যন্ত্রটি ব্যবহার করলে সময় বাঁচায় ৭০-৮২ শতাংশ এবং ৭৫ শতাংশ কম শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। প্রচলিত পদ্ধতিতে এক একর জমির ধান বা গম কাটতে খরচ হয় প্রায় ছয় হাজার টাকা। সেখানে কম্বাইন্ড হারভেস্টার ব্যবহারে লাগে মাত্র ৪০০ টাকা। এটি অল্প কাদার মধ্যেও ব্যবহার করা যায়। একই সঙ্গে এ যন্ত্র দিয়ে ফসল কাটার পর খড়ও আস্ত থাকে।

কৃষিবিদ ড. খালেদ কামাল হোসেন বলেন, যন্ত্রের ব্যবহারে কৃষিতে উৎপাদন বেড়েছে কয়েকগুণ। এসব যন্ত্রের ব্যবহারে কৃষিতে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন সম্ভব হচ্ছে। তিনি বলেন, দিন দিন ফসলের জমি কমে যাচ্ছে অপরদিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে খাদ্যের চাহিদা বাড়ছে। আর সে কারণেই অধিক জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে কৃষিতে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার বাড়াতে হবে।

তারাগঞ্জে পাইলট প্রকল্প : রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম রহিমাপুর গ্রামে একই প্লটে ৭৮ জন কৃষকের ৫০ একর জমিতে সরকারের কৃষি প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়েছে সার, বীজ ও বালাইনাশক। ট্রেতে চারা রোপণ থেকে শুরু করে ধানকাটা সবই হয়েছে যন্ত্রের মাধ্যমে। আধুনিক এই চাষপদ্ধতিতে আগের তুলনায় উৎপাদনও বেড়েছে, ফলে খুশি কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তা।

কৃষকরা জানান, কম্বাইন হারভেস্টারের মাধ্যমে ফসল কাটায় জমি থেকে রাস্তার মধ্যে ধান পাওয়া যাচ্ছে। এটা অনেক ভালো একটা পদ্ধতি। রংপুরের তারাগঞ্জের কৃষি কর্মকর্তা উর্মি তাবাসসুম বলেন, ‘এই পদ্ধতির মাধ্যমে বোরো মৌসুমে আমাদের শ্রমিক সংকট দূর হচ্ছে এবং উৎপাদন খরচ কম হচ্ছে। পাশাপাশি সময়টাও কম লাগছে।’

কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর বলছে কৃষিকে সহজ, লাভজনক ও আধুনিক করতেই কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। রংপুর কৃষি সস্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. ওবায়দুর রহমান মন্ডল বলেন, ‘এই সবকিছু আমরা সরকারি প্রণোদনা থেকেই করে দিচ্ছি। এতে কৃষকদের উৎপাদন খরচ কম হবে এবং লাভ বেশি হবে।’

সরকারের এমন উদ্যোগ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে বলে মনে করছেন জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা। জেলা প্রশাসক আসিব আহসান বলেন, ‘উৎপাদন খরচ কমার পাশাপাশি কৃষিপণ্য নষ্টও হচ্ছেনা এবং কৃষক এই পণ্য ভালোমূল্যে বাজারে বিক্রি করার একটি সুযোগ পেয়েছে।’

হাওরে ২৪৩ হারভেস্টার : এবারের ধান কাটায় হাওরে যুক্ত ছিল ২৪৩ হারভেস্টার। যার কারণে এবারে কোনো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসার আগেই কৃষকরা সময়মতো ধানকেটে ঘরে তুলতে পেরেছেন।

কৃষি বিভাগের মতে, জেলায় চলতি বছর ২ লাখ ১৯ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত করা হলেও আবাদ হয়েছে ২ লাখ ২৩ হাজার ৩৩০ হেক্টর। এর মধ্যে বিআর ২৮ ধান ৬৭ হাজার হেক্টর এবং বিআর ২৯ ধান আবাদ হয়েছে ৬৩ হাজার হেক্টর জমিতে। বাকি ধান হাইব্রিডসহ কিছু দেশীয় প্রজাতিও রয়েছে। আর এ ধান কাটতে সরকারিভাবে ৮৯টি ধান কাটার মেশিন বিতরণ করা হয়।

গতবারের বিতরণকৃত আরো ১২৯টি মেশিনও যুক্ত ছিল। তাছাড়া কৃষকদের অনেকেই ব্যক্তিগত উদ্যোগে আরো ২৫টি মেশিন হাওরে নামান। সবমিলিয়ে ২৪৩ টি মেশিনে দ্রুততার সঙ্গে ধান কেটে কৃষকরা ঘরে তুলতে পেরেছেন।

সুনামগঞ্জ কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. ফরিদুল হাসান বলেন, ধান কাটতে বাইরের জেলা থেকে শ্রমিক নিয়ে আসার পাশাপাশি প্রায় আড়াই শ ধান কাটার মেশিন হাওরে ছিল। অতিবৃষ্টি ও অনাবৃষ্টিতে কিছু চিটা হয়। তবে এবার হাওরের গড় ফলনে এতে কোনো প্রভাব পড়েনি। ধান রোপণ থেকে শুরু করে কাটা মাড়াইয়ে পূর্বের যে কোনো সময়ে তুলনায় যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ফলে কৃষকরা দ্রুততার সঙ্গে সবকিছু করতে পেরেছেন।

তিনি বলেন, আগামিতে কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহার আরো বৃদ্ধি পাবে। সবমিলিয়ে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসছে কৃষিতে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!