• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
স্বপ্ন থেকে বাস্তবে পদ্মা সেতু

জেগে ওঠার প্রতীক্ষায় দক্ষিণাঞ্চল


বিশেষ প্রতিনিধি সেপ্টেম্বর ১১, ২০২১, ১১:১০ এএম
জেগে ওঠার প্রতীক্ষায় দক্ষিণাঞ্চল

ঢাকা : বাংলাদেশে একটি সফল নতুন স্বপ্নের নাম পদ্মা সেতু। ১৯৯৮ সালে এই স্বপ্নের কথা প্রকাশ করেছিলেন শেখ হাসিনা। তখনো তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। যমুনার ওপর নির্মিত বঙ্গবন্ধু সেতুর উদ্বোধন করেই বলেছিলেন পদ্মায়ও একটি সেতু করবেন।

পদ্মা সেতুর ইতিহাসের শুরুটা এভাবে, যার শেষ রচিত হচ্ছে এখন, তারই নেতৃত্বে। আর পদ্মা সেতু জাগাবে পিছিয়ে পড়া দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলাকে।

তবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শিল্পায়নের সুফল পেতে এখনই গ্যাস-বিদ্যুৎ ও অবকাঠামোর ওপর জোর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা মনে করেন, পদ্মা সেতু কেবল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নয়, পুরো বাংলাদেশের অর্থনীতির চেহারা বদলে দেবে।

এই বছরের ২৩ আগস্ট পদ্মা সেতুর সড়কের ওপর শেষ স্ল্যাব বসে। রাজধানীর সাথে দক্ষিণাঞ্চলের সরাসরি সংযোগের পথ পূর্ণতা পায়। প্রমত্তা পদ্মায় সেতু তৈরির স্বপ্ন বোনা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু (যমুনা) সেতু উদ্বোধনের দিন। অবশেষে ২০০১ সালের ৪ জুলাই মাওয়া প্রান্তে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধু সেতুর দৈর্ঘ্য পাঁচ কিলোমিটারের কম। খরস্রোতা পদ্মায় প্রায় সাড়ে ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু নির্মাণ আদৌ সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে দ্বিধা ছিল অনেকের। ২০০১-এর শেষ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্প নিয়ে এগোয়নি।

২০০৭ সালের আগস্টে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকা ব্যয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পের অনুমোদন দেয়।

২০০৯ সালে শেখ হাসিনা পুনরায় সরকার গঠন করেন। ছয় মাসের মাথায় পদ্মা সেতুর নকশা মন্ত্রিসভা অনুমোদন দেয়। পরে সেতুতে রেলপথ যুক্ত করার পরিকল্পনা হয়। নির্মাণ ব্যয় বাড়তে থাকে। এখন খরচ ৩০ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।

পদ্মা সেতুটি হওয়ার কথা ছিল বিশ্বব্যাংকের ঋণে। কিন্তু ২০১২ সালের জুনে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের মিথ্যা অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংক ঋণ দেয়নি।

ফলে অনিশ্চয়তা দেখা দিলে ২০১৩ সালে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই সিদ্ধান্তের পরও অনেকের সন্দেহ কাটেনি। সরকার ২০১৪ সালের ১৭ জুন সেতুর অবকাঠামো নির্মাণের জন্য চুক্তি করে চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানির সাথে।

২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর পদ্মা সেতুর নির্মাণ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর সেতুতে প্রথম স্প্যান বসে। শেষটি বসে ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর । আর ২০১৯ সালের ১৯ মার্চ সড়কের প্রথম স্ল্যাব বসে। গত ২৩ আগস্ট বসেছে শেষ স্ল্যাবটি।

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের ভাগ্যবদলে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে পদ্মা সেতু। এই সেতু ঘিরেই সোনালি ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছেন এই অঞ্চলের ২১ জেলার মানুষ। পদ্মা সেতু চালু হলে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের সঙ্গে এ অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হবে।

পিছিয়ে পড়া এই অঞ্চল ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আরো মনোযোগ কাড়বে, গড়ে উঠবে এসব জেলায় নতুন নতুন শিল্পকারখানা। এ সেতু দিয়ে বাংলাদেশ যুক্ত হতে পারবে এশিয়ান হাইওয়েতে। ফলে দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতির চাকা ঘোরার পাশাপাশি বাড়বে কর্মসংস্থান।

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পিছিয়ে পড়া ২১টি জেলা হচ্ছে-খুলনা বিভাগের খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা, নড়াইল, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরা।

বরিশাল বিভাগের বরিশাল, পিরোজপুর, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা ও ঝালকাঠি এবং ঢাকা বিভাগের গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও রাজবাড়ী।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, গ্যাস-বিদ্যুৎ ও অবকাঠামোর চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হলে দেশে পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে।

ভবিষ্যতে এই সেতু দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ, বাণিজ্য, পর্যটনসহ অনেক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিবেশী অন্যান্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে পারবে।

তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর সড়ক ও রেলপথ এই দুয়ের মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া অঞ্চলকে কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ, রপ্তানি বাড়াতে সহায়তা করবে। পাশাপাশি দেশের ভেতরে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ আরো বাড়বে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, স্বপ্নের এই সেতুকে মাথায় রেখে মানুষ নানা ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করে দিয়েছে। সামনে আরো নদী বন্দর, সমুদ্র বন্দর চালু হতে যাচ্ছে। মংলা বন্দরেরও প্রসার ঘটছে, ইকোনমিক জোন হচ্ছে। এ কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শিল্পায়নের সুফল পেতে এখনই গ্যাস-বিদ্যুৎ ও অবকাঠামোর ওপর জোর দিতে হবে।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক রিফাত ফেরদৌস বলেন, যমুনা সেতু হবার ফলে দেশের উত্তরাঞ্চলের ফসল ও সবজির বাজার আজ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে।

তেমনি বরিশালের আঞ্চলিক মৎস্য ও কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে একই ঘটনা ঘটবে পদ্মা সেতু ব্যবহার উপযোগী হলে। এখানকার মাছ, চাল, পেয়ারা, আমড়া, নারিকেল, সুপারি ইত্যাদি ছড়িয়ে পড়বে দেশব্যাপী, বৃদ্ধি পাবে বাজারের আয়তন।

ফলে এসব পণ্যের সাথে সংশ্লিষ্ট শিল্প আরো বৃদ্ধি পাবে বরিশালে। যার সুফল ভোগ করবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষ।

তবে পদ্মা সেতুর ফলে সৃষ্টি হওয়া সম্ভাবনা কাজে লাগাতে বরিশালে বাণিজ্য সহযোগী পরিবেশ নিশ্চিত জরুরি বলে জানিয়েছেন বরিশাল বিসিক শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি মো. মিজানুর রহমান।

তিনি বলেন, বরিশালে শিল্পকারখানা শুরু করতে হলে যেসব সরকারি দপ্তরের সহযোগিতা দরকার সেগুলোর বেশিরভাগ কার্যালয় দূরবর্তী জেলা ও বিভাগে। যে কারণে অহেতুক দৌড়ঝাঁপের শিকার হতে হয় এখানকার একজন উদ্যোক্তাকে। একই সাথে স্বাধীনভাবে ব্যবসা পরিচালনা করতে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করতে হয় এখানে।

বাগেরহাট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি লিয়াকত হোসেন লিটন বলেন, পদ্মা সেতুর সুফল পেতে এই অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। এই সময়ে ভ্যাট, ট্যাক্স আরোপের নামে অহেতুক হয়রানি করা না হলে ব্যবসায়ীরা এই অঞ্চলকে বেছে নেবে।

ইতোমধ্যে ফরিদপুর, মাদারীপুর এবং খুলনার খালিশপুরের অর্থনৈতিক জোনের সীমানা নির্ধারণ হয়ে গেছে। হয়তো আগামী দশ বছরের মধ্যে এই অঞ্চল হবে বাংলাদেশের দ্বিতীয় রাজধানী।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!