• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ হচ্ছে!


বিশেষ প্রতিনিধি জানুয়ারি ১৪, ২০১৯, ০৯:৫০ পিএম
রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ হচ্ছে!

ঢাকা : নির্বাচনের পরে রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ শুরু হয়েছে। দেশের সবক’টি রাজনৈতিক দল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিলেও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ছাড়া অন্যরা নির্বাচনের ফলাফলকে গ্রহণ করেনি। নির্বাচনকে নজিরবিহীন কারচুপি এবং জালিয়াতির নির্বাচন বলে অভিযোগ করেছে তারা। এই প্রেক্ষাপটে রাজনীতিতে একটি নতুন মেরুকরণের সৃষ্টি হতে পারে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপি একাধারে ২০ দল ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। দু’টি জোটই বিএনপি এখনও বহাল রেখেছে। তারা জামায়াত এবং ইসলামী দলগুলো থেকে আলাদা হয়ে একটি বৃহত্তর সরকারবিরোধী বৃহত্তর রাজনৈতিক মোর্চা গঠনের সুযোগ নিতে পারে। সেই মোর্চার রূপরেখা কেমন হতে পারে তা নিয়েও রাজনৈতিক অঙ্গনে গুঞ্জন শুরু হয়েছে।

এদিকে নির্বাচনের আগে যেসব দল এবং জোট সংলাপে অংশ নিয়েছে, তাদের ফের গণভবনে ডেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংলাপে বসবেন বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

গতকাল রবিবার তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘ঐক্যফ্রন্ট-যুক্তফ্রন্টসহ ৭৫টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে গণভবনে সংলাপ হয়েছিল। এখন নির্বাচন শেষ হয়েছে, আমাদের নেত্রী গতকাল (শনিবার) আমাদের সঙ্গে ওয়ার্কিং কমিটি ও উপদেষ্টা পরিষদের যৌথ বৈঠকে বলেছেন, যাদের সঙ্গে সংলাপ হয়েছে তাদেরকে আমন্ত্রণ করবেন, আহ্বান করবেন, নিমন্ত্রণ করবেন।’

একাদশ সংসদ নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ‘জাতীয় সংলাপ’ করার ঘোষণা দেওয়ার পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এমন বার্তা এল।

জানা গেছে যে, ইসলামী দলগুলোকে বাদ দিয়ে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যুক্ত হলে বাম মোর্চাও তাতে শামিল হতে পারে। ন্যূনতম ইস্যুতে তারা ঐক্যবদ্ধভাবে একটি আন্দোলনের সূচনা করতে পারে। বাম মোর্চা ইতোমধ্যে একটি গণশুনানি করে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে প্রত্যাখান করেছে। এটা নজিরবিহীন কারচুপি এবং ভোট জালিয়াতি হয়েছে বলে জানিয়েছে তারা। একই কথা বলছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টও।

একটি সূত্র বলছে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের কয়েকজন নেতা বাম মোর্চার সঙ্গে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বৃহত্তর ঐক্যের জন্য প্রস্তাব দিয়েছিল। সেক্ষেত্রে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে থাকা বিএনপির ব্যাপারে বাম মোর্চা আপত্তি জানিয়েছে বলে জানা গেছে। বাম মোর্চা বলেছে যে, জামায়াত বা ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত থাকবে তাদেরকে সঙ্গে তারা ঐক্য করবে না।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রায় দুই সপ্তাহ পর গত শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে ঐক্যফ্রন্টের প্রধান ড. কামাল হোসেন জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার জন্য বিএনপিকে পরামর্শ দিয়েছেন। জামায়াতকে জোটে নিয়ে ভোট করার বিষয়ে তিনি ‘ভুল স্বীকার’ করে বলেন, ‘তখন ওরা (বিএনপি) বললো না যে জামায়াতের ২৫ জন না কত .., আমি যখন এখানে সম্মতি দিয়েছি, সেটা আমাকে জানানো হয় নাই। আমরা মতে সেটাও একটা ভুল করা হয়েছে।’

এদিকে নির্বাচনের পর বিএনপিকে বিভিন্ন দেশের ক‚টনীতিকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে। তারা সবাই বিএনপিকে অবিলম্বে জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করার পরামর্শ দিয়েছে। এই পরামর্শের প্রেক্ষিতেই বিএনপি এখন ২০ দলকে নিষ্ক্রিয় করে রেখেছে। ২০ দলের মধ্য থেকে জামায়াত এবং ইসলামী দলগুলোকে আলাদা করে বাকি দল বিজেপি, কল্যাণ পার্টি, ন্যাপ, এলডিপিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে নিয়ে আসার জন্য বিএনপির একটি অংশ চেষ্টা করছে বলে জানা গেছে। আর সেটা হলে ২০ দল বিলুপ্ত হয়ে যাবে এবং সেখান থেকে ৪/৫টি দল ঐক্যফ্রন্টে যোগ দেবে।

নির্বাচনের আগের দিনগুলোতে দেখা গেছে, ২০ দলের কর্মসূচিতে জামায়াত ও ইসলামী দলগুলো ছাড়া বাকি অনেক দলই অংশগ্রহণ করেছিল। সেই লক্ষ্যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে বড় করার একটি আয়োজন চলছে।

এ বিষয়ে ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম নেতা অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেছেন, ‘নির্বাচনের পরই জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের কার্যক্রমের নতুন প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। আমরা সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে একটি বৃহত্তর প্লাটফর্ম গড়ার চেষ্টা করছি। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অবস্থান খুবই স্পষ্ট। আমরা জামায়াতের সঙ্গে কোন ঐক্য করতে পারি না। বিএনপি আমাদের সঙ্গে এককভাবে যুক্ত হয়েছে। তবে ২০ দলের যেসকল দল মৌলবাদী নয় এবং যারা সেক্যুলার রাজনীতিতে বিশ্বাস করে তাদেরকে নিয়ে জোট গঠনে কোন সমস্যা নেই।’

একই ভাবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের কয়েকজন নেতা বামমোর্চার সঙ্গেও যোগাযোগ করেছে। তারা নির্বাচন বাতিলে এবং নতুন নির্বাচনের দাবিতে একটি বৃহত্তর মঞ্চ এবং ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করা যায় কি না সে ব্যাপারে মতামত চেয়েছে।

বামমোর্চা বলেছে যে, আদর্শিক ব্যাপারে তাদের সঙ্গে অনেক পার্থক্য রয়েছে। তবে একটি অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া সম্ভব নয়। তাই নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনের জন্য বামমোর্চা নীতিগতভাবে রাজি হয়েছে বলে জানা গেছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘কোন জোটে যাওয়ার কোন ইচ্ছা আমাদের নেই। তবে ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর প্রমাণ হয়েছে যে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অসম্ভব ব্যাপার। এজন্যই আমরা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে অভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে একটি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করতে পারি। তবে সে আন্দোলনে অবশ্যই জামায়াত থাকা যাবে না।’

যেখানে জামায়াত থাকবে সেখানে বাম মোর্চা থাকবে না বলে সরাসরি জানিয়ে দেন তিনি। এর ফলে জামায়াত থেকে বিএনপিকে আলাদা করার চাপ আরও বেগবান হয়েছে। যদি শেষ পর্যন্ত ঐক্য নাও হয় তাহলে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে একটি বৃহত্তর মঞ্চ এবং অভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত¡াবধায়ক সরকারের দাবিতে ন্যূনতম কর্মসূচিতে আন্দোলনের ব্যাপারে চিন্তাভাবনা চলছে।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের একজন নেতা বলেছেন যে, ‘এখনই বড় ধরনের কোন আন্দোলন নয়, বরং ধাপে ধাপে আন্দোলনের কথা আমরা চিন্তা করছি। প্রথমে জনসংযোগ, মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন এবং তারপর ধাপে ধাপে আন্দোলনের ব্যাপারে আমাদের নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা শুরু হয়েছে। এই আন্দোলনে সকল বিরোধী দলকে আমরা সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করছি।’

এদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ৫ দফা দাবি নিয়ে জাতীয় সংলাপ অনুষ্ঠানের জন্য প্রক্রিয়া শুরু করেছে বলে ঐক্যফ্রন্টের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।

দাবিগুলো হচ্ছে- ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনকে বাতিল করতে হবে; ন্যূনতম সময়ের মধ্যে একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার গঠনের জন্য রূপরেখা প্রণয়ন করতে হবে; বর্তমান নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ ও অযোগ্য প্রমাণিত হয়েছে, তাই বর্তমান নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে; নির্বাচনকালীন যে গ্রেপ্তার-হয়রানি হয়েছে সেগুলোর সমাধান করা; যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, সেসব মামলা প্রত্যাহার করে সবাইকে মুক্তি দিতে হবে এবং অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সকলের মতামতে ভিত্তিতে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী এবং প্রশাসনের ভ‚মিকার উপর একটি গ্রহণযোগ্য নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা সুব্রত চৌধুরী বলেছেন, ‘এই খসড়া কর্মসূচি নিয়ে আমরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করবো এবং ধাপে ধাপে আমরা এগুলো এগিয়ে নেবো’।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!