ঢাকা: টি-টোয়েন্টি-ওয়ানডে ক্রিকেটের পর টেস্ট ক্রিকেটের অধিনায়কত্ব ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছেন ভারতের তারকা ক্রিকেটার বিরাট কোহলি।
সবমিলিয়ে অধিনায়কত্বের দিক থেকে একজন মুকুটহীন রাজারই প্রস্থান হল। এটি বলার কারণও আছে, বিশ্ব ক্রিকেটের একজন দাপটীয় অধিনায়ক হিসেবে আখ্যা দেওয়া হত কোহলিকে। শুধু মাঠেই দলের নেত্বত্ব দেননি। একটা সময় ভারতীয় দলের নিয়ন্ত্রণটাই ছিল কোহলির হাতে।
কাকে দলে নেয়া হবে, কাকে বাদ দেয়া হবে, কোচ কে হবেন এসব বিষয়েই একচ্ছ্বত্র আধিপত্য ছিল কোহলির। কিন্তু অবসরের আগে তার এমন বিদায়ে অবাক ক্রিকেট ভক্তরা। ধোনিও একসময় ভারতের পুরো ক্রিকেটের নেতৃত্ব দিয়েছেন।

কিন্তু কোহলির হাতে দায়িত্ব ওঠার পর ধোনি আর বেশিদিন খেলা চালিয়ে যাননি। ধোনি মাঠে খেলবেন কিন্তু নেতৃত্বে থাকবেন না এটা মানতে পারেননি তার ভক্তরাও। কোহলির বিষয়টাও ঠিক তেমন। কোহলি মাঠে খেলবেন কিন্তু নেতৃত্বে থাকবেন না এটা আবার তার ভক্তরাও মানতে পারছেন না। এ নিয়ে এখনই কানাঘুসা, আলোচনা-সমালোচনা চলছে। অনেকে আবার দাবি করছেন, হয়তো কোহলিও পরের অধীনে বেশিদিন খেলবেন না।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের কিছুদিন পূর্বে তিনি টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের অধিনায়কত্ব ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তার কিছুদিন পরেই তিনি ভারতীয় প্রিমিয়ার লিগে রয়েল চ্যালেঞ্জার ব্যাঙ্গালোরের অধিনায়কত্ব ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এদিকে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড সাদা বলে দুজন অধিনায়ক রাখতে চায় না বলে ওডিআই ক্রিকেটের অধিনায়কত্ব থেকেও বিরাটকে সরিয়ে দেওয়া হয়। আর দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজ শেষে টেস্ট ক্রিকেটের অধিনায়কত্ব ছাড়লেন বিরাট কোহলি।

কোহলি টুইট বার্তায় অধিনায়কত্ব ছাড়ার ইঙ্গিত দেওয়া মাত্র সর্বস্তরের ক্রিকেটপ্রেমীদের মধ্যে রীতিমতো হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। তবে প্রিয় অধিনায়ককে যোগ্য সন্মান দিতে ভোলেনি তারা। শুভেচ্ছা বার্তায় ভরে গেছে বিরাট কোহলির টুইটার টাইমলাইন।
ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড জানায়, ‘অধিনায়ক হিসেবে টেস্ট দলকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য বিরাট কোহলিকে ধন্যবাদ। ৬৮টি টেস্টে দলকে নেতৃত্ব দিয়ে ৪০টিতে জিতেছে। দেশের সব থেকে সফল টেস্ট অধিনায়ক কোহলি।’

সাবেক কোচ শাস্ত্রীর সঙ্গে অধিনায়ক হিসেবে নিজের ক্যারিয়ারের অনেক সময় কাটিয়েছেন কোহলি। অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট সিরিজ জয় থেকে ইংল্যান্ডে দুর্ধর্ষ পারফরম্যান্স, সবটাই এসেছে শাস্ত্রী-কোহলি হাত ধরে। দুজনের মধ্যকার সম্মান ও ভালবাসার ছবি আগেও অনেক বার ধরা পড়েছে।
বিরাট নিজের বিদায়ী বার্তায় যে দুইজনকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন, তার মধ্যে শাস্ত্রী একজন। কোহলিকে এক আবেগঘন স্ট্যাটাসের মাধ্যমে শুভেচ্ছা জানিয়ে শাস্ত্রী লিখেন, বিরাট, তুমি গর্বের সঙ্গে মাথা উঁচু করে বিদায় নিতে পার। তুমি অধিনায়ক হিসেবে যা যা কৃতিত্ব গড়েছ, তেমনটা খুব কমজনই করতে পেরেছে। নিঃসন্দেহে তুমিই ভারতের সবথেকে আগ্রাসী এবং সফলতম অধিনায়ক।
তিনি আরও লিখেছেন, এটা সত্যি বলতে আমার কাছে খুবই দুঃখের একটা দিন, কারণ এই ভারতীয় দলটা আমরা দুইজনে একত্রে তৈরি করেছি। কোহলির বিদায়ে এখন পরবর্তী টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে কার নাম ঘোষণা করা হবে, সকলের নজর সেই দিকে।
ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সচিব জয় শাহ টুইট করে লেখেন, ‘টেস্ট অধিনায়ক হিসাবে দারুণ সময় কাটাল বিরাট কোহলী। ও গোটা দলকে প্রচণ্ড ফিট করে তুলেছে। দেশে এবং বিদেশে দুর্দান্ত খেলেছে দল। অস্ট্রেলিয়া এবং ইংল্যান্ডে টেস্ট জয় অবশ্যই আলাদা আনন্দের।’

এছাড়া ওয়াসিম জাফর, শচীন টেন্ডুলকার, বীরেন্দ্র শেওয়াগসহ বিশ্বের অনেক ক্রিকেটারই কোহলির বিদায় বেলায় শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছেন।
এদিকে টুইটারে কোহলিকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেটার আহমেদ শেহজাদও।
ভারত আর পাকিস্তানের সম্পর্কটা চিরবৈরিতার। মাঠের আচরণেও তার ছাপ পড়ে হরহামেশাই। তবে কোহলির নেতৃত্ব ছাড়ার পর সেসবকে একপাশে রেখে শেহজাদ তাকে প্রশংসার বানেই ভাসালেন।
তিনি বললেন, ‘আপনি যে আবেগের সাথে আপনার দলকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, সেটা আপনার অধিনায়কত্বে সাফ ধরা পড়ত। ৭ বছর ধরে নির্ভীকভাবে দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, উন্নতমানের ক্রিকেট উপহার দিয়েছেন এবং এই খেলার একজন দূত হয়ে উঠেছেন। আগামীর জন্য শুভ কামনা রইল ভাই বিরাট কোহলি। কিপ রকিং।’
টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে বিরাট ভারতকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ৬৮টি টেস্ট ম্যাচে। সাদা পোষাকের এই ফরম্যাটে বিরাটের জয়ের পাল্লাটা বেশ ভারী। শতাংশের হিসাব করলে তা দাঁড়ায় ৫৮.৮২। জয়ের শতকরা হিসেবে তার উপরে রয়েছে অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তি দুই অধিনায়ক রিকি পন্টিং ও স্টিভ ওয়াহ। ম্যাচে সংখ্যা বিবেচনায় রিকি এগিয়ে থাকলেও জয়ে পরিসংখ্যানে সবার উপরে রয়েছেন ওয়াহ ৭১.৯২%।
২০১৪ সালে ভারতের অন্যতম সেরা ব্যাটার বিরাট কোহলির হাতে দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়েছিল টেস্ট অধিনায়কের। সেই থেকে ২০২২ এর এই শুরু অবধি প্রায় সাত বছরের এক দীর্ঘ যাত্রা শেষে বিরাট নিজেকে দলনেতার দায়িত্ব থেকে মুক্ত করলেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারের নিজস্ব অ্যাকাউন্ট থেকে এক বার্তায় তিনি দায়িত্ব ছাড়ার কথাটি জানান।
সেই টুইট বার্তায় তিনি লিখেছেন, ‘সাত বছর অনেক পরিশ্রম, ঘাম, আর বিরতিহীন চেষ্টায় দলকে একটা নির্দিষ্ট দিকনির্দেশনায় নিয়ে গিয়েছি। কাজটায় আমি শতভাগ সততা দেখিয়েছি, ছাড় দেইনি এক বিন্দুও। তবে, সব কিছুরই শেষ আছে। আমার ভারতের অধিনায়ক হিসেবেও এখানেই ইতি। এই লম্বা যাত্রায় অনেক উত্থান-পতন এসেছে। তবে, কখনো নিজের প্রতি বিশ্বাস হারাইনি। আমি সব সময়ই বিশ্বাস করেছি, আমি দলের জন্য নিজের ১২০ ভাগ ঢেলে দিয়েছি। আমার হৃদয়ে স্বচ্ছতা ছিল, দলের প্রতি আমি সৎ ছিলাম।’
বিদায় বেলায় কোহলি ধন্যবাদ জানালেন সংশ্লিষ্ট সবাইকে। বিশেষ করে মহেন্দ্র সিং ধোনি ও রবি শাস্ত্রীকে, ‘দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য আমি বিসিসিআইয়ের প্রতি কৃতজ্ঞ। সতীর্থদের ধন্যবাদ জানাই, কারণ কেউই ওরা হাল ছাড়তে জানে না। সতীর্থদের জন্যই যাত্রাটা সুন্দর হয়েছে। দলটার চালিকা শক্তি ছিল রবি (শাস্ত্রী) ভাই সাপোর্টিং গ্রুপ। সবাই দলটাকে টেস্ট ক্রিকেটে আরো উপরে তুলতে সাহায্য করেছে। সর্বশেষ ধন্যবাদ জানাতে চাই মহেন্দ্র সিং ধোনি, যিনি আমার মধ্যে একজন অধিনায়ককে খুঁজে পেয়েছিলেন, যিনি বিশ্বাস করেছিলেন যে আমি ভারতের ক্রিকেটকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবো।
কোহলির নেতৃত্ব দেওয়া ৬৮ ম্যাচের মধ্যে ৪০টি ম্যাচ জিতেছে বিরাটের নেতৃত্বাধীন ভারতীয় ক্রিকেট দল। এর বিপরীতে হেরেছে ১৭টি ড্র করেছে ১১টি ম্যাচ। বিরাট অধিনায়কের দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে দেশ ও দেশের বাইরে সমানতালে পারফর্ম করেছে দলটি। দলের সাথে তাল মিলিয়ে বিরাটের ব্যাটও দারুণ চলেছে এই সময়কালে। ১১৩ ইনিংস ব্যাট করে তিনি রান করেছেন ৫৮৬৪ রান। টেস্ট অধিনায়কদের মধ্যে চতুর্থ সর্বোচ্চ রানের মালিক বিরাট কোহলি।
গড়ের দিক বিবেচনায় তিনি রয়েছেন দ্বিতীয় অবস্থানে। তার ব্যাটিং গড় ৫৪.৮০। তাছাড়া অধিনায়ক থাকাকালীন সময়ে বিরাট হাঁকিয়েছেন ২০টি শতক ও ১৮টি অর্ধশতক। সব দিক বিবেচনায় বলাই যায় একজন রাজকীয় অধিনায়কেরই প্রস্থান হল।
সোনালীনিউজ/এআর







































