ঢাকা: একটা সাজানো বাগান যেন তছনছ হতে চলেছে। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে সিরাত জাহান স্বপ্নার ফুটবল ছাড়ার দিনই নারী ফুটবলের সফল কোচ গোলাম রব্বানীর স্বেচ্ছায় বিদায়ের ঘোষণা। সর্বশেষ খবর, ক্যাম্প ছেড়ে বাড়ি চলে গেছেন ডিফেন্ডার আঁখি খাতুনও।
শোনা যাচ্ছে, বিয়ে করে আঁখি চলে যাবেন চীনে। হবু বর চীনে থাকেন। তার সহায়তায় চীনের একটি একাডেমিতে ওঠার কথা আঁখির। যদিও বাফুফেকে মায়ের অসুস্থতার কথা বলে গেছেন।
কিন্তু কবে ফিরবেন, বলে যাননি। বাংলাদেশের ফুটবলে আঁখি-অধ্যায় তাই শেষই বলা যায়। মেয়েদের ফুটবলের প্রতীক হয়ে ওঠা কোচ গোলাম রব্বানীও আজ আনুষ্ঠানিকভাবে বাফুফেকে পদত্যাগের কথা জানাবেন।
বিদায় বলতে পারেন আরও বেশ কজন মেয়ে। কোচিং স্টাফের সদস্যরাও স্বস্তিতে নেই। টেকনিক্যাল ডিরেক্টর পল স্মলির খবরদারিতে তারা কাজ না-ও করতে পারেন, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সদস্য বলেছেন এমন কথাই।
কিন্তু নারী ফুটবলের কেন এই হাল? উঠছে নানা প্রশ্ন। সাবিনা খাতুনেরা তো আরও অনেক কিছু জয়ের প্রতিশ্রুতি জাগিয়েছিলেন। তারাই কেন এখন বিমুখ হয়ে পড়েছেন? বাংলাদেশের বাস্তবতায় একটা সময় মেয়েদের বিয়ের ব্যাপারটা সামনে চলে আসে।
পরিবারের চাওয়া মেনে মেয়েরা খেলা ছেড়ে যাবেন, সেটা অস্বাভাবিক নয়। বাফুফের এখানে আসলে করার কিছু নেই। কিন্তু স্বপ্না-আঁখিদের চলে যাওয়াকে ‘ওদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে’ বলে বাফুফের সরলীকরণ বাস্তবতাকে আসলে পাশ কাটানোই।
দলীয় সূত্রের দাবি, নানা কারণে ক্যাম্পে থাকা মেয়েরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। তারা অবসাদে ভুগছেন। খেলাবিহীন আর কত বসে থাকা যায়! সামনে দেখছেন না কোনো আশার আলো।
গত সেপ্টেম্বরে নেপালে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জেতার পর আট মাস চলে যাচ্ছে। লম্বা এই সময় খেলাবিহীন কাটিয়েছে জাতীয় দল। বাফুফে মিয়ানমারে অলিম্পিক বাছাই খেলতে জাতীয় দল পাঠায়নি টাকা নেই কারণ দেখিয়ে। মিয়ানমার যাওয়ার কথা যখন চলছিল, দুটি প্রস্তুতি ম্যাচ খেলার কথা ছিল, সেটাও হয়নি। তড়িঘড়ি ফিফা প্রীতি ম্যাচ খেলতে সিঙ্গাপুরে দল পাঠাতে চেয়েও শেষ পর্যন্ত পারেনি বাফুফে। ‘না’ বলেছে সিঙ্গাপুর।
মেয়েরা আশার জাল বুনেছিলেন ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ ঘিরে, যেখানে খেললে তারা কিছু টাকা পেতেন। পাঁচ তারকা হোটেলে ঘটা করে এর লোগো-বল উন্মোচন করে এখন আয়োজকেরা নিশ্চুপ। এ মাসে টুর্নামেন্টটি হওয়ার কথা থাকলেও তা নিয়ে কিছু বলছে না বাফুফে।
সবকিছু না গুছিয়েই প্রচার চালানো হয়েছে। আগামী মাসে লিগটা হবে বলা হচ্ছে এখন, কিন্ত দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। মেয়েরা নাকি রোজ রোজ অনুশীলনে গিয়ে কোচদের কাছে প্রশ্ন তোলেন, ‘স্যার, খেলা না হলে এত অনুশীলন করে লাভ কী!’
ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের জন্য ভারতে ঘরোয়া লিগে উড়িষ্যা দলে খেলতে যাওয়ার অনুমতি পাননি স্বপ্না। তখন তাকে বলা হয়েছিল, ‘ভারতে যাওয়ার দরকার নেই, ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে খেলো।’ ফ্র্যাঞ্চাইজি ফুটবলে তিনি ছিলেন আটজন আইকনের একজন। প্রস্তাবিত পারিশ্রমিক ছিল চার লাখ টাকা। কিন্তু লিগই তো হবে কি না ঠিক নেই, এক কানাকড়িও পাননি স্বপ্না। পাননি কেউই। এসব কারণে স্বপ্না মন খারাপ করে ফুটবলই ছেড়ে দিয়েছেন।
সাফ জেতার পর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মেয়েদের মাসিক বেতনও কি বেড়েছে? এক টাকাও বাড়েনি। অধিনায়ক সাবিনা খাতুন মাসে পান ২০ হাজার টাকা। বাকিরা ১০ হাজার টাকার আশপাশে। সেই ‘সামান্য টাকাও’ এপ্রিল থেকে বকেয়া। এই যখন অবস্থা, মেয়েরা তাহলে আর কিসের আশায় পরিবার ছেড়ে পড়ে থাকবেন বাফুফে ভবনে? সেই হতাশারই প্রতিফলন দলে এমন ভাঙন।
গোলাম রব্বানীর বিদায়ের কথা শোনার পর পরশু সিনিয়র মেয়েদের নিয়ে বসেছিলেন বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন। সেখানে তিনি স্পনসর পাওয়া সাপেক্ষে এ বছর বেতন বাড়ানোর কথা বলেছেন। কিন্তু এই আশ্বাসে মেয়েরা আর আস্থা রাখতে পারছেন না। বেতন বৃদ্ধি, ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ, জুলাইয়ে মঙ্গোলিয়ার সঙ্গে ফিফা প্রীতি ম্যাচ খেলার আশ্বাস...কোনো কিছুই মেয়েদের মন ভোলাতে পারছে না। তারা আর আস্থাই রাখতে পারছেন না বাফুফের কথায়।
এত দ্রুত একটা সফল অধ্যায়ের সমাপ্তির ইঙ্গিত দেশের নারী ফুটবলের জন্যই এক অশনিসংকেত।
সোনালীনিউজ/এআর
আপনার মতামত লিখুন :