• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
সামাজিক ও পারিবারিক অবক্ষয় হত্যাকাণ্ডের কারণ

আমরা কি তোমাদের কাছেও নিরাপদ নই?


বিশেষ প্রতিনিধি মার্চ ৯, ২০২০, ০৪:৩৯ পিএম
আমরা কি তোমাদের কাছেও নিরাপদ নই?

ঢাকা : বাবা-মায়ের কোলেও নিরাপদ নয় শিশুরা। প্রায়ই দেশের কোথাও না কোথাও বাবা কিংবা মায়ের হাতে খুন হচ্ছে অবুঝ শিশুরা। নিজেদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে গিয়ে আদরের ধনের গলায় ছুরি চালাতেও দ্বিধা করছে না কিছু কিছু নিষ্ঠুর বাবা-মা।

চলতি বছর দেশের বিভিন্ন স্থানে অন্তত ১০ থেকে ১২ জন শিশু বাবা কিংবা মায়ের হাতে খুন হয়েছেন। শিশুরা বাবা-মাকে প্রশ্ন করছেন, আমরা কি তোমাদের কাছেও নিরাপদ নই?

সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, সামাজিক ও পারিবারিক অবক্ষয়, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, অনৈতিক জীবনযাপন, ব্যক্তি স্বার্থপরতা, লোভ, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা বাবা-মায়ের হাতে শিশু হত্যাকাণ্ডের অন্যতম কারণ।

মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষের সহনশীলতা কমে যাচ্ছে, ফলে বৃদ্ধি পাচ্ছে অস্থিরতা। এসব কারণে পারিবারিক অশান্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে। অবিশ্বাস, সন্দেহ আর স্বার্থপরতা সবকিছু তছনছ করে দিচ্ছে। প্রিয়তমা স্ত্রীকে খুন করতে যেমন স্বামী দ্বিধা করছেন না, তেমনি প্রিয়তমা স্ত্রীও স্বামীকে খুন করতে পিছপা হচ্ছেন না। আবার অনেকে স্বামীর পরকীয়ার কারণে সন্তানদের নিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন।

এছাড়া বাবা-মায়ের পরকীয়ার বলিও হচ্ছে শিশুরা। ক্রমবর্ধমান শিশু হত্যা বিশেষ করে বাবা-মায়ের হাতে নিজ সন্তান হত্যা দেশবাসীর মনে উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে।

বাংলাদেশ মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোটে এলিনা খান বলেন, এখন ঘরেই শিশুরা নিরাপদ নয়। বাবা-মায়ের হাতেই শিশুদের জীবন দিতে হচ্ছে । মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় আর কী হতে পারে।

পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে শিশুরা কোথায় নিরাপত্তা পাবে তাই বোঝা মুশকিল। তাই রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তিকে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। শিশুদের সুরক্ষা এবং নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।

মনোবিজ্ঞানীদের মতে, সামাজিক অবস্থা দিন দিন যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে কিছু দিন পর বাবা-মায়ের বুকেও সন্তান যেতে ভয় পাবে। যার ফলে সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধ নষ্ট হবে। চিড় ধরবে পারিবারিক বন্ধনে। নষ্ট হবে সন্তান-মায়ের পবিত্র সম্পর্ক।

অপরাধ বিজ্ঞানীদের মতে, সামাজিক, পারিবারিক ও নৈতিক মূল্যবোধের ক্রমাগত অবক্ষয় এবং পারিবারিক বন্ধনের শিথিলতার কারণে মায়েদের হাতে শিশু হত্যার মতো নৃশংসতার ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলছে।

শিশু বিশেষজ্ঞদের মতে, বাবা-মায়ের হাতে সন্তান হত্যার এমন পৈশাচিকতা শুধু আইন করে কিংবা পুলিশ সদস্যদের মাধ্যমে প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন অভিভাবক মহলে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং ধর্মীয় শিক্ষার প্রসার।

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর মেহজাবিন হক বলেন, মানুষের সহনশীলতা দিন দিন কমে যাচ্ছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে অস্থিরতা। অনেক ক্ষেত্রে স্ত্রী স্বামীকে বিশ্বাস করছেন না, আবার স্বামী স্ত্রীকে বিশ্বাস করেন না। এ রকম আত্মবিশ্বাসের কারণে সংসারে অশান্তি নেমে আসে। বিশ্বাস, ভালোবাসা ও সততার চর্চা না থাকলে দাম্পত্য জীবনে কলহ আসবেই।

তিনি বলেন, পরিবারের সদস্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে অনেক স্ত্রীর ওপর যদি স্বামী নির্যাতন করে, তাহলে কেউ আর তাকে বাধা দেওয়ার থাকে না। আগে দেখা যেত, কোনো স্বামী যদি তার স্ত্রীর ওপর নির্যাতন করে তাহলে পরিবারের মুরুব্বিরা তাকে শাসন করত। এখন এর লেশমাত্র নেই।

প্রফেসর মেহজাবিন হক বলেন, অনেক ক্ষেত্রে কর্মব্যস্ততার কারণে পরিবারকে সময় না দেওয়ার কারণেও দাম্পত্য জীবনে অশান্তি চলে আসে। স্ত্রী বা স্বামী জড়িয়ে পড়ে পরকীয়ায়।

মনোবিজ্ঞানী ড. মেহতাব খানম শিশু হত্যার সংবাদ প্রকাশ ও প্রচারে গণমাধ্যমকে আরো দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানান। এমন ঘটনার ফলাও প্রচার শিশুদের মনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, শিশুরা এখন তাদের বাবা-মাকে বলছে, আমরা কি তোমাদের কাছেও নিরাপদ নই? এ বিষয়ে সংবাদ প্রচার ও প্রকাশে সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক দিক বিবেচনায় নিতে গণমাধ্যমের প্রতি আহ্বানও জানান তিনি।

মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, আপাতদৃষ্টিতে এসব ঘটনাকে অনেকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে করলেও, স্বজনদের হাতে শিশু হত্যার প্রভাব পড়ছে সমাজের প্রতিটি মানুষের ওপরই। তাই শুধু ঘটনার সাথে জড়িতদের খুঁজে বের করে শাস্তি বিধান করলে শিশু হত্যা প্রতিরোধ সম্ভব নয়। শিশু হত্যার দায় সমাজের প্রতিটি বাসিন্দার, প্রতিটি সদস্যের।

তাই প্রতিটি পরিবারকে, সমাজের প্রতিটি সদস্যকে শিশুদের সুষ্ঠুভাবে বেড়ে ওঠার ওপর নজর দিতে হবে। অন্যথায় দেশ এক ভয়াবহ সামাজিক সমস্যার মুখোমুখি হবে। যার দায় বহন করতে হবে পুরো রাষ্ট্রকে।

গত শনিবার রাজধানীর খিলগাঁও গোড়ানের ৩৯৭ নম্বর বাড়ি থেকে আলভি (১১) ও জান্নাত (৬) নামে দুই কন্যা শিশুর গলাকাটা ও দগ্ধ মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তারা ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুলের চতুর্থ ও প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। বাবা ঠিকমতো সংসার খরচ না দেওয়ায় ক্ষুব্ধ এক মা নিজ হাতে দুই সন্তানকে গলাকেটে হত্যা করে নিজেও শরীরে আগুন দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা চালায়।

আরিফুন্নেসা পপি (৩৫) নামে নিষ্ঠুর এ মা ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের অবজারভেশন কক্ষে সাংবাদিকদের নিজে এ কথা জানান। তিনি স্বীকার করেন নিজের হাতেই বঁটি দিয়ে দুই শিশুকে গলা কেটে হত্যা করেছেন।

এর আগে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর দক্ষিণখানের কে সি মডেল স্কুলের পেছনে প্রেমবাগান এলাকায় একটি বাড়ির পাঁচতলায় রকিবের বাসায় তার স্ত্রী মুন্নী বেগম (৩৭), তাদের ছেলে ফোরকান উদ্দিন (১২) ও মেয়ে লাইভার (৪) লাশ পাওয়া যায়। মুন্নীকে মাথায় ভারী বস্তুর আঘাতে এবং শিশু দুটিকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয় বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। গৃহকর্তা রকিব তখন থেকে লাপাত্তা।

পুলিশ বলছে, পরকীয়ার কারণে গৃহকর্তা রকিবই স্ত্রীসহ দুই সন্তানকে হত্যা করেছে।

এদিকে গত ৫ মার্চ কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার পেয়ারাভাঙ্গা গ্রামে মাহাথির মোহাম্মদ নামে দেড় বছরের ছেলেকে গলা কেটে তার মা হত্যা করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এছাড়া বরিশালের উজিরপুরেও এক মায়ের বিরুদ্ধে চার বছরের নিজ কন্যাসন্তানকে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় মা নাজমা বেগমের বিরুদ্ধে থানায় মামলা দায়ের করেছেন নিহত শিশুর পিতা। নিহত শিশু বাকপ্রতিবন্ধী স্বপ্না খানম মম ওই উপজেলার কমলাপুর গ্রামের ইমরান হোসেন মিলনের কন্যা।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!