• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

করোনাভাইরাসে বাড়ছে উৎকণ্ঠা, সতর্ক সরকার


বিশেষ প্রতিনিধি জানুয়ারি ২৯, ২০২০, ০২:৫৭ পিএম
করোনাভাইরাসে বাড়ছে উৎকণ্ঠা, সতর্ক সরকার

ঢাকা : চীনসহ বিশ্বের প্রায় ১৩টি দেশে ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাসের ঝুঁকিতে বাংলাদেশ থাকলেও রোগটি ঠেকাতে ব্যাপক প্রস্তুতি ও সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এখনো পর্যন্ত নতুন সংক্রামক বিদেশি রোগ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত কেউ দেশে শনাক্ত না হলেও বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে রোগটির প্রতিরোধমূলক নানা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

রোগটির প্রতিরোধ ও প্রতিকারের বিষয়ে দেশীয় বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে প্রস্তুতি নেওয়ার পাশাপাশি বৈশ্বিক সংস্থার সঙ্গেও যোগাযোগ রাখা হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে।  

রোগীর ব্যবস্থাপনার বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) নির্দেশ অনুযায়ী পদক্ষেপ নিয়ে সরকারি হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের প্রস্তুত রেখেছে সরকার। বৈশ্বিক রোগ প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক নীতিমালা অনুসরণ করে সরকার দেশের প্রবেশপথগুলোতে সতকর্তা জারির পাশাপাশি রোগ নির্ণয়ের ব্যবস্থার আয়োজন করেছে।

বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরগুলোতে চিকিৎসক, কর্মী ও চিকিৎসার দরকারি যন্ত্রপাতিও সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে।

সরকারের শীর্ষ স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের মতে, এখনো পর্যন্ত করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ, রোগ শনাক্তকরণ ও জানানো, ত্বরিত কাজে নামা, স্বাস্থ্যকাঠামো ও পদ্ধতি, হু’র ২০০৫ সালের আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করা এবং ঝুঁকির পরিবেশ মোকাবেলায় সরকারের প্রস্তুতি যথেষ্ট। তবে দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়া ওই সংক্রামক ব্যাধির বিষয়ে নানা প্রস্তুতির মধ্যেও শঙ্কামুক্ত থাকা যাচ্ছে না।

চিকিৎসা ব্যবস্থায় চীনের মতো এত উন্নত দেশ রোগটির প্রতিরোধে এখনো হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশের মতো জনঘনত্বের দেশে এ ভাইরাসের সংক্রমণ হলে তা ভয়ানক হয়ে উঠতে পারে।  

দেশে চীনের তুলনায় পর্যাপ্ত পরিমাণে ডায়াগনোসিস করার ব্যবস্থা যেমন নেই, তেমনই নেই প্রশিক্ষিত জনবল। ইনফেকশন প্রতিরোধের কোনো ব্যবস্থা নেই বললেও চলে। স্থলবন্দরগুলোতে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাও তেমন জোরালো নয়। কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায়। প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধের দিকেই তাই সরকারের পক্ষ থেকে বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে।

চীনের উহানে প্রদেশ দেখা দেওয়া ও সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়া নতুন ধরনের করোনা ভাইরাস কোনোভাবেই যেন বাংলাদেশে ছড়াতে না পারে, সেজন্য সরকার ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে বলে মঙ্গলবার (২৮ জানুয়ারি) সাংবাদিকদের জানান স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী জাহেদ মালেক।

অন্যদিকে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ও নিহতের সংখ্যা বাড়ছে চীনে। গতকাল পর্যন্ত ১০৬ জন মারা গেছেন বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছে চীনা কর্তৃপক্ষ। দেশটিতে নতুন এ করোনা ভাইরাসে এ পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা চার হাজারেরও বেশি। ভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে ভ্রমণ কিংবা চলাচলে আরো বাধানিষেধ আরোপ করেছে চীন সরকার।

উহান শহর, যেখান থেকে প্রথম ভাইরাসটি ছড়িয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে, সেই শহরটি কার্যত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। চীনের বহু শহরে গণপরিবহন বন্ধ রাখা হয়েছে।

চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। প্রতিদিন বাংলাদেশ থেকে অনেক মানুষ দেশটিতে ব্যবসাসহ নানা কারণে যাওয়া-আসা করছেন।

এ ছাড়া চীন থেকে অন্য যেসব দেশে রোগটি সংক্রমিত হয়েছে, সেসব দেশের সঙ্গেও বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কসহ প্রায় নানা ধরনের যোগাযোগ ও যাতায়াত রয়েছে। এখন পর্যন্ত দেশে কোনো রোগী পাওয়া না গেলেও বাংলাদেশকে ঝুঁকিমুক্ত বলা যাচ্ছে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

তবে চীন থেকে আসা জ্বরেভোগা অন্তত দশজনের লালার নমুনা পরীক্ষা করে করোনা ভাইরাস পায়নি সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ দেশের সব প্রবেশ পথে কারোনাভাইরাস ঠেকাতে বিশেষ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ হিসেবে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দওে স্ক্যানিং শুরু হয়েছে।

বিমানবন্দরের অ্যারাইভ্যাল ও ভিআইপি টার্মিনালে থার্মাল স্ক্যানার বসানো হয়েছে। প্রত্যেক যাত্রীকে স্ক্যানারের ভেতর দিয়ে আসতে হয়। কোনো যাত্রীর গায়ে অতিরিক্ত তাপমাত্রা থাকলে স্ক্যানারে ধরা পড়ে। তখন যাত্রীর তাপমাত্রা পরিমাপ করা হয় এবং তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়।

চট্টগ্রাম শাহ আমানত আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দরেও থার্মাল স্ক্যানার বসানো হয়েছে। সেখানেও চিকিৎসক ও সেবিকাসহ অতিরিক্ত সেবাকর্মী নিযুক্ত করা হয়েছে। চীন থেকে চট্টগ্রামে সরাসরি কোনো ফ্লাইট নেই। দুবাই ও ভারত হয়ে কানেকটিং ফ্লাইটে চীনের যাত্রীরা চট্টগ্রামে আসেন। এ ধরনের কানেকটিং ফ্লাইটের কোনো যাত্রী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত কিনা সেটির ওপর নজর রাখছেন চিকিৎসকরা।

সার্বিকভাবে প্রস্তুতি রাখতে দেশের দুটি সমুদ্রবন্দর ও স্থলবন্দরগুলোকে প্রস্তুত থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য বন্দরেও একই বিষয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। সংক্রমণ ঠেকাতে বেনাপোল স্থলবন্দরের চেকপোস্ট ইমিগ্রেশনে সতর্কতা জারি করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। এ পথে ভারত থেকে আগত বিদেশি নাগরিকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা।

করোনা ভাইরাসের হালনাগাদ তথ্য সংগ্রহ, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের জন্য আইইডিসিআর তথ্যকেন্দ্র খুলেছে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এ প্রসঙ্গে গতকাল বলেন, ‘সংক্রামক ব্যাধি করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে দেশে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। ভাইরাসটি শিগগির ছড়িয়ে যায়।

এটি যাতে বাংলাদেশে আসতে না পারে, এ জন্য দেশের সব বন্দরে প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য বার্তা পাঠানো হয়েছে। সেখানে স্ক্যানার যন্ত্র বসানো হয়েছে। প্রস্তু্তুতির অংশ হিসেবে রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল ও মহাখালী সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে আলাদা ওয়ার্ড করা হয়েছে। সব জেলা হাসপাতালগুলোয় আলাদা ওয়ার্ড করার জন্য সিভিল সার্জনকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সম্ভাব্য যত ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, তা নেওয়া হয়েছে।’

এ ভাইরাস বাংলাদেশে আসবে না বলে তারা আশা।

গতকাল সচিবালয়ে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধের বিষয়ে সরকারের প্রস্তুতি জানাতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে প্রায় ৩০০ বাংলাদেশি শিক্ষার্থী আছেন। তাদের বিষয়ে খোঁজখবর রাখা হচ্ছে। কেউ এখনো আক্রান্ত হননি। চীন সরকার ১৪ দিনের মধ্যে কাউকে সেই শহর ত্যাগ করতে দেবে না বলে জানিয়েছে।’

ঢাকায় সর্দি-কাশি নিয়ে ভর্তি এক রোগী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত বলে যে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে, সে বিষয়ে গতকালের সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করা হলে এর জবাব দেন সেখানে উপস্থিত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. আবুল কালাম আজাদ।

তিনি বলেন, ‘একজন রোগী ভর্তি হয়েছিলেন। তিনি এখন সুস্থ, বাড়ি ফিরে যেতে চাইছেন। তার স্বাস্থ্যের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। সেগুলোর প্রতিবেদন এখনো হাতে আসেনি।

যোগাযোগ করলে আইইডিসিআরের পরিচালক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে আইইডিসিআরের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ আছে। তাদের নির্দেশনা মেনে কাজ করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দুটি কৌশল হাতে নিয়েছে।

প্রথমত, দ্রুত আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত করা; দ্বিতীয়ত, আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেলে তাকে কড়া নজরদারিতে রাখা এবং প্রয়োজনে আলাদা করে ফেলা। কুর্মিটোলা হাসপাতালে রোগী রাখার ব্যবস্থা আছে।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার মনে করেন, ‘বাংলাদেশের আবহাওয়া ও পরিবেশের কারণে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বেশি। যে কোনো ভাইরাস কোথাও একবার ঢুকলে তা খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

এ কারণে সব সময়ই একটা ঝুঁকি থাকে। আমাদের দেশে ঝুঁকি আরো বেশি, কারণ আমাদের দেশ জনবহুল।

এ ছাড়া মানুষ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে কম, রাস্তাঘাটে থুতু-কফ ফেলেন। ভাইরাসটির বংশবৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশে বিরাজমান তাপমাত্রা-বাতাসের আর্দ্রতা উপযোগী। বিভিন্ন প্রাণির মাধ্যমেও রোগটি ছড়াতে পারে।’

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!