• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঝড়ের পূর্বাভাস জাপায়


বিশেষ প্রতিনিধি জুলাই ২৩, ২০১৯, ০২:১১ পিএম
ঝড়ের পূর্বাভাস জাপায়

ঢাকা : বাংলাদেশের সাবেক সামরিক শাসক ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর যেকোন বিশৃঙ্খলায় তার দলে ভাঙন দেখা দিতে পারে - এমন আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

তারা বলছেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘কর্তৃত্ববাদী নেতৃত্ব’ থাকে। আর দলগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ 'গণতন্ত্রের অভাব' রয়েছে। এই পটভূমিতে জেনারেল এরশাদের অনুপস্থিতি জাতীয় পার্টির ভবিষ্যতকে কোন দিকে নিয়ে যাবে, এমন প্রশ্ন করা হয়েছিলো রাজনৈতিক বিশ্লেষক রিয়াজ উদ্দিন আহমেদকে।
 
তিনি বলেনে, ‘জাতীয় পার্টি কোন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় গঠিত হয়নি। এটি ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।’

‘জাতীয় পার্টি সুবিধাবাদীর রাজনীতি করেছে। যার কারণে এক সময় ক্ষমতা ভোগ করেছে, এক সময় ছিটকে পড়েছে ক্ষমতার বলয় থেকে। আবার সমন্বয় করে ক্ষমতার বলয়ের মধ্যে ঢুকেছিলো। কিন্তু এতো সবকিছুই এরশাদকে কেন্দ্র করে ছিল।’

আহমেদ বলেন, ‘এখানে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব রয়েছে। দলে রওশন এরশাদের নেতৃত্বে একটি ধারা রয়েছে । আরেকটি ধারা জিএম কাদেরকে কেন্দ্র করে। এই ধারাই কিন্তু এক সময় ভেঙে যেতে পারে।’
 
‘অথবা দুটি ধারার একটি আওয়ামী লীগের সাথে মিশে যাবে, আরেকটি এ্যান্টি-আওয়ামীলীগ ফোরামে বা বিএনপি ফোরামের দিকে ঝুঁকে যেতে পারে।’

পারসোনালিটি কাল্ট বা ব্যক্তি জনপ্রিয়তা এদেশের রাজনীতির একটা বড় অংশ, যা জেনারেল এরশাদের মধ্যেও ছিল। কিন্তু এধরণের আরো অনেক দল যেমন, মওলানা ভাসানী কিংবা এ কে ফজলুল হকের মতো ক্ষমতাশালী ও জনপ্রিয় ব্যক্তিদের মৃত্যুর পর তাদের দলগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

এরশাদের জাতীয় পার্টির ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটতে পারে কি-না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘খুব সম্ভাবনা রয়েছে এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষণ একথাই বলে।’

তিনি বলেন, ‘এই দলের কোন জনভিত্তি নেই, আদর্শিক ভিত্তি নেই, কোন ভবিষ্যৎ কমিটমেন্ট নেই। একারণে মওলানা ভাসানী ও শেরে বাংলার দলের মতো জাতীয় পার্টিও বিলুপ্ত হতে পারে বলে আমার ধারণা। ’

আওয়ামীলীগ, বিএনপি কিংবা বামদলগুলো সুস্পষ্ট রাজনৈতিক মতবাদের ভিত্তিতে কাজ করে। এমন সুসংগঠিত দলগুলোর রাজনীতিতে  দলগত আদর্শিক ভিত্তি না থাকা সত্ত্বেও জাতীয় পার্টি কিভাবে এতো দিন টিকে ছিলো এমন প্রশ্নও করা হয় আহমেদকে।

তিনি বলেন, ‘টিকে ছিলো ক্ষমতার রসায়নে একটা জায়গা ছিলো বলে। কারণ যেকোন স্বৈরাচারের পতনের পরে একজন স্বৈরাচারী শাসক রাজনীতিতে টিকে থাকে না। কিন্তু এরশাদ টিকে ছিলেন শুধু তার রংপুর রাজনীতিকে ভিত্তি করে।’

উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থানে পতনের পর, জেলখানায় থেকে তিনি নির্বাচনে অংশ নিয়ে রংপুরের ৫টি আসনে জয় লাভ করেছিলেন এরশাদ।’

‘এরপর থেকে রংপুরকে ভিত্তি করে একটি আঞ্চলিক দল হিসেবে পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসিতে ১৫-২০ আসন পেলে একটা বার্গেনিং পজিশন থাকে। এরশাদ সেটাকে কাজে লাগিয়েছেন।’

১৯৮২ সালে ক্ষমতা দখল করে প্রায় নয় বছর দেশ শাসনের পর ১৯৯০ সালে গণআন্দোলনের মুখে এরশাদ পদত্যাগ করেন। কিন্তু তারপরও জাতীয় পার্টি বিস্ময়করভাবে ক্ষমতার রাজনীতিতে ফিরে আসেন।

ক্ষমতা হারানোর পর থেকে এরশাদের রাজনৈতিক পুনর্বাসনে আওয়ামীলীগ বা বিএনপির ভূমিকাই বেশি ছিল বলে উল্লেখ করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক আহমেদ। তিনি বলেন, এসব দলের কারণেই রাজনীতিতে টিকে গেছেন জেনারেল এরশাদ।

‘এরশাদ সারভাইভ করতে

পারতো না যদি এরা এরশাদকে নিয়ে প্লে করতে না চাইতো। আওয়ামীলীগও করেছে বিএনপিও করেছে,’ তিনি বলেন।

‘পার্লামেন্টোরি ডেমোক্রেসির মধ্যে অঞ্চল ভিত্তিক একটা প্রভাব ছিল। একটা রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ ছিল। এটাকে তারা ব্যবহার করতে চেয়েছে।’

‘এটাকে ব্যবহার করতে গিয়ে এরশাদকে এমন অবস্থানে নিয়ে গেছে যে, এরশাদ খুব দুর্বল অবস্থানে থেকেও সবলভাবে ক্ষমতার রাজনীতিতে দর কষাকষি করতে পেরেছে। এর কারণেই তিনি ১৯৯৬ থেকে ক্ষমতার বলয়ের বাইরে আর পরে যাননি,’ তিনি বলেন।

ঝড়ের পূর্বাভাস জাপায় : জাতীয় পার্টিতে (জাপা) অস্থিরতা সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। দলটির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর জাপার চেয়ারম্যান হয়েছেন তার ছোট ভাই জিএম কাদের।

কিন্তু তাকে যে প্রক্রিয়ায় চেয়ারম্যান করা হয়েছে, তাতে ক্ষুব্ধ রওশন এরশাদ ও তার অনুসারীরা।

অনুসারীদের অভিযোগ, কাউকে না জানিয়ে দলের কোনো পর্যায়ে আলোচনা ছাড়াই এরশাদের স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে জিএম কাদেরকে। বিষয়টি ভালোভাবে নেননি রওশন এরশাদ।

জাপার দু’পক্ষের জ্যেষ্ঠ নেতারা এ তথ্য জানিয়েছেন। তবে কেউ এ বিষয়ে গণমাধ্যমে নাম প্রকাশ করে মন্তব্য করতে রাজি হননি। তারা বলেছেন, এখন পর্যন্ত বিরোধ প্রকাশ্যে না এলেও ঝড়ের পূর্বাভাস দেখা যাচ্ছে জাপায়।

গতকাল শুক্রবার বিকেলে গুঞ্জন ছড়ায়, রওশন এরশাদ ও তার অনুসারী জ্যেষ্ঠ নেতারা চেয়ারম্যান পদে জিএম কাদেরের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। তবে শেষ পর্যন্ত এর সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে বিরোধীদলীয় উপনেতা রওশন এরশাদের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, গতকাল একটি অনানুষ্ঠানিক বৈঠক হয়েছে রওশন এরশাদের গুলশানের বাসভবনে। তার অনুসারীরা জিএম কাদেরের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে বিবৃতি দিতে পরামর্শ দেন। তবে রওশন এরশাদ এতে কান দেননি। তিনি আপাতত এমন কিছু করতে চান না বলে জানিয়ে দিয়েছেন।

সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতার ঘনিষ্ঠ সূত্রটি জানিয়েছে, এখনও এরশাদের মৃত্যুর এক সপ্তাহ হয়নি। স্বামীর মৃত্যুতে শোকাহত রওশন এরশাদ আপাতত রাজনীতি

নিয়ে ভাবছেন না; বরং জিএম কাদেরের বিরোধী নেতারা তার কাছে গিয়ে পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ জানিয়ে যাচ্ছেন।

এই সূত্রটি জানিয়েছে, ৭৬ বছর বয়সী রওশন এরশাদ নিজেও অসুস্থ। তিনি তার ছেলে সাদ এরশাদকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করে যেতে চান। এরশাদের মৃত্যুতে শূন্য রংপুর-৩ আসনের উপনির্বাচনে সাদকে প্রার্থী করতে চান রওশন। সাদ দলের মনোনয়ন চেয়ে না পেলে, তবে তিনি পদক্ষেপ নেবেন। জিএম কাদেরের অনুসারী হিসেবে পরিচিত একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য সমকালকে জানিয়েছেন,

প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার এবং ফখরুল ইসলাম রওশন এরশাদের পক্ষে রয়েছেন। দলের বাকি জ্যেষ্ঠ নেতাদের সবাই জিএম কাদেরের পক্ষে। তবে দলীয় এমপিদের বড় অংশ রওশন এরশাদের পক্ষে। জিএম কাদেরের বিরোধীরা রওশন এরশাদের কানভারি করছেন। দেবর-ভাবির মধ্যে সংঘাত সৃষ্টির চেষ্টা করছেন।

গত বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে দলের চেয়ারম্যান হিসেবে জিএম কাদেরের নাম ঘোষণা করেন জাপার মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গাঁ। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত দু’জন প্রেসিডিয়াম সদস্য সমকালকে বলেছেন, এমন ঘোষণা আসবে তা তারা আগে থেকে জানতেন না।

গত ৪ মে মধ্যরাতে বাসায় সাংবাদিকদের ডেকে নিয়ে তাদের সামনে জিএম কাদেরকে জাপার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করেছিলেন এরশাদ। ঘোষণা দিয়েছিলেন, তার অবর্তমানে জিএম কাদেরই হবেন জাপার চেয়ারম্যান। দলীয় গঠনতন্ত্রের ২০-এর ১/ক ধারা অনুযায়ী এ ঘোষণা লিখিত ও মৌখিক দুইভাবেই দিয়ে গেছেন এরশাদ। জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া বলেছেন, এ ঘোষণাবলেই জিএম কাদের চেয়ারম্যান হয়েছেন। এতে গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন হয়নি।

তবে জিএম কাদেরের অনুসারী হিসেবে পরিচিত নেতারাই বলেছেন, দলের প্রেসিডিয়াম কিংবা কেন্দ্রীয় কমিটির সভা ডেকে তাদের অনুমতি নিয়ে চেয়ারম্যান পদে জিএম কাদেরকে বসানো উচিত ছিল। এতে বিরোধ সৃষ্টির আশঙ্কা এড়ানো যেত। রওশন এরশাদকে সম্মান দেওয়া হতো। তিনি সন্তুষ্ট থাকলে তার অনুসারীরা কানভারি করার সুযোগ পেতেন না।

জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য এস এম ফয়সাল চিশতি রওশন এরশাদ এবং জিএম কাদের দু’জনেরই ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। তিনি সমকালকে বলেছেন, কোনো বিরোধ নেই। তবে সূত্রের খবর, তিনি দেবর-ভাবির মধ্যে দূরত্ব কমাতে দূতিয়ালি করছেন।

এরশাদ জীবদ্দশাতে জাপার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে গেছেন। তিনি নির্দেশ দিয়ে গেছেন, তার মৃত্যুর পর দলের চেয়ারম্যান হবেন জিএম কাদের। বিরোধীদলীয় নেতা হবেন রওশন এরশাদ। দেবর-ভাবির যৌথ নেতৃত্বে চলবে দল। কিন্তু জিএম কাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হওয়ার পর রওশন এরশাদ ও তার অনুসারীরা দলের কার্যক্রম থেকে দূরে রয়েছেন। আজ জাপার কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক হবে। সেখানেও তাদের উপস্থিতির সম্ভাবনা ক্ষীণ।

রওশন এরশাদের অনুসারী এক নেতা বলেছেন, জিএম কাদের বিরোধীদলীয় নেতার পদটি রওশন এরশাদের জন্য ছেড়ে দিলে, বিরোধ মিটে যাবে। রওশন এরশাদকে বিরোধীদলীয় উপনেতা নির্বাচনের দায়িত্বও ছেড়ে দিতে হবে; কিন্তু জিএম কাদের নিজেই বিরোধীদলীয় নেতা হতে চাইলে বিরোধ আরও বাড়বে। সরকার যার পক্ষে থাকবে, শেষ পর্যন্ত তার হাতেই যাবে জাপার নিয়ন্ত্রণ।

জি এম কাদেরকে চেয়ারম্যান মানেন না রওশন : জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান পদে জি এম কাদেরকে মানতে রাজি নন রওশন এরশাদ।

সোমবার (২২ জুলাই) গণমাধ্যমে পাঠানো সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতার প্যাডে হাতে লেখা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তিনি দাবি করেছেন, যথাযথ কোনও ফোরামে আলোচনা না করেই জি এম কাদেরকে চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।

বিবৃতিতে পার্টির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী পরবর্তী চেয়ারম্যান না হওয়া পর্যন্ত জি এম কাদেরকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানিয়েছেন রওশন। এতে তাকে সমর্থন জানিয়েছেন সাত জন সংসদ সদস্যসহ দুজন প্রেসিডিয়াম সদস্য।

বিবৃতির সত্যতা নিশ্চিত করেছেন রওশন এরশাদ। তিনি সোমবার রাত সাড়ে ১১ টায় বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,‘ আমি এই বিবৃতি দিয়েছি। জরুরি ভিত্তিতে করার কারণে বিবৃতিটি হাতে লেখা হয়েছে।’

জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতা হিসেবে বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন জাতীয় পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান বেগম রওশন এরশাদ। দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর গত ১৪ জুলাই মারা যান জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এর আগে গত জুনে শারীরিক অসুস্থতাজনিত কারণে পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে জি এম কাদেরকে দায়িত্বভার অর্পন করেন তিনি।

বিষয়টি তাৎক্ষণিক মেনে নিলেও এরশাদের মৃত্যুর চার দিনের মাথায় গত ১৮ জুলাই (বৃহস্পতিবার) জাতীয় পার্টির মহাসচিব জি এম কাদেরকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান থেকে চেয়ারম্যান হিসেবে গণমাধ্যমের সামনে পরিচয় করিয়ে দেন। আর এর পাঁচ দিন পরেই তাকে চেয়ারম্যান পদে মানতে আপত্তি জানালেন রওশন এরশাদ ও তার অনুসারীরা।

সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতার প্যাডে হাতে লেখা এই বিবৃতিতে জাতীয় পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান বেগম রওশন এরশাদ লিখেছেন, ‘‘সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের মারফত আমরা জানতে পেরেছি জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে যা আদৌ কোনও যথাযথ ফোরামে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি।

ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দায়িত্বপালনকালে জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্র ধারা ২০ (২) এর খ-এ দেওয়া ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন। যথা-‘মনোনীত ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান প্রেসিডিয়ামের সংখ্যাগরিষ্ঠদের মতামতের ভিত্তিতে দায়িত্ব পালন করবেন। চেয়ারম্যানের অবর্তমানে ধারা ২০ (২) এর ‘ক’ কে উপেক্ষা করা যাবে না।

আশাকরি বর্তমানে যিনি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি পার্টির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী পরবর্তী চেয়ারম্যান না হওয়া পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করবেন।’

বিবৃতিতে দলের সব নেতা-কর্মীকে গঠনতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি।

বিবৃতিতে এ ঘোষণার প্রতি একমত পোষণকারী আরও সাতজন সংসদ সদস্য ও প্রেসিডিয়াম সদস্যের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তারা হচ্ছেন-প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এমপি, প্রেসিডিয়াম সদস্য ফখরুল ইমাম এমপি, প্রেসিডিয়াম সদস্য সেলিম ওসমান এমপি, লিয়াকত হোসেন খোকা এমপি, রওশন আরা মান্নান এমপি, প্রেসিডিয়াম সদস্য নাসরিন জাহান রত্না এমপি, প্রেসিডিয়াম সদস্য মাসুদা এম রশীদ চৌধুরী এমপি, প্রেসিডিয়াম সদস্য মীর আব্দুস সবুর আসুদ, ও প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন।

বিষয়টি সম্পর্কে জানতে জাতীয় পার্টির ঘোষিত চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙার সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তাদের কেউ ফোন রিসিভ করেননি।

এর মাধ্যমে জাতীয় পার্টির নেতৃত্বে বিভক্তির বিষয়টি আবারও সামনে চলে এলো। এরশাদের মৃত্যুর পর জি এম কাদের ও রওশন এরশাদের মধ্যে দলের নেতৃত্ব এবং ক্ষমতা নিয়ে যে বিবাদের সৃষ্টি হতে পারে তা রাজনৈতিকমহলে অনুমিতই ছিল।

বিশেষ করে সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতার আসন নিয়ে উভয়ের মধ্যে দ্বন্দ্বের বিষয়টি এমন আভাস আগেই দিয়েছিল।একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিরোধী দলের আসনে গিয়ে গত জানুয়ারিতে জি এম কাদেরকে সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতা ঘোষণা করলেও সে সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারেননি পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।

সংসদের প্রথম অধিবেশনের পরেই তাকে সরিয়ে রওশন এরশাদকে বিরোধীদলীয় উপনেতা করতে বাধ্য হন তিনি।

এরও আগে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া-না নেওয়া নিয়ে রওশন ও জি এম কাদেরের পারস্পরিক মত পার্থক্য ভীষণ দোটানায় ফেলে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদকে। সরকারি দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে মধ্যস্থতা করে তাদের সঙ্গে জোট গড়ার লবি করেন রওশন এরশাদ। এরশাদ তার চাপে মহাজোটে থাকার ঘোষণা দেন।

অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের মন্ত্রী থাকার পরেও বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দেওয়ায় জাতীয় পার্টিকেও নির্বাচনের বাইরে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালান জি এম কাদের ও তার অনুসারীরা।

ফলে দোটানায় পড়ে এরশাদ একবার নির্বাচনে থাকার ঘোষণা দেন, আবার পর মুহূর্তে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে রাজনৈতিক তামাশার সৃষ্টি করেন।

এ অবস্থায় ২০১৪ সালের নির্বাচনের সময় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি থাকতে হয় তাকে। নির্বাচনে না গিয়ে টানা পাঁচ বছর সংসদের বাইরে ছিলেন জি এম কাদের। আর সংসদে বিরাধীদলীয় নেতার দায়িত্ব পালন করেন রওশন এরশাদ। আর হাসপাতালের শয্যায় থেকেও নির্বাচিত হয়ে পাঁচ বছর প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত ছিলেন এরশাদ।

জাতীয় পার্টিতে এখন আর কোন বিভেদ নেই : তীয় পার্টির মধ্যে কোনও বিভেদ নেই বলে দাবি করেছেন দলটির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদের। তিনি বলেন, ‘পার্টির ৯৯ ভাগ প্রেসিডিয়াম সদস্য ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিটি কর্মসূচি এগিয়ে নিচ্ছে। যৌথ নেতৃত্ব পার্টিকে আরও সুসংহত এবং শক্তিশালী করেছে। আমাদের মধ্যে কোনও বিভেদ ও বিশৃঙ্খলা নেই।

শনিবার জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের বনানী অফিসে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। এর আগে দলটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির যৌথসভা অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু বৈঠকে পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ ও তার অনুসারী প্রেসিডিয়াম সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন না।

জিএম কাদের বলেন, ‘দেশের প্রতিটি দুর্যোগে এরশাদ দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াতেন। এক বুক পানিতে নেমেও ত্রাণ বিতরণ করেছেন তিনি। আমরা পল্লীবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে বন্যাদুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াতে চাই। তিনি বলেন, ‘আমরা কাজের মাধ্যমে এরশাদের স্মৃতি সাধারণ মানুষের মাঝে ধরে রাখবো।

বন্যার্তদের সহায়তায় জাতীয় পার্টি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে একটি কন্ট্রোল রুম খোলা হবে বলে জানিয়ে দলটির চেয়ারম্যান বলেন, ৪/৫টি টিম বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করবে। পাশাপাশি সরকারের ত্রাণ কার্যক্রমে সহায়তা করবো। দুর্গত এলাকায় দলের নেতাকর্মীদের সাধ্যমতো সহায়তা করার আহ্বান জানান তিনি। এ সময় উপস্থিত ছিলেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা, প্রেসিডিয়াম সদস্য আবুল কাশেম, সাহিদুর রহমান টেপা, সৈয়দ আবদুল মান্নান, শেখ সিরাজুল ইসলাম, সালমা ইসলাম প্রমুখ।

রওশনের বাসায় জি এম কাদের, মান অভিমানের অবসান : জাতীয় পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান বেগম রওশন এরশাদ ও পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ (জি এম) কাদেরের মান-অভিমান দূর হয়েছে গতকাল। বিকাল ৩টার দিকে হঠাৎ জি এম কাদের তার ভাবীর বাড়িতে হাজির। দুই ঘণ্টা ধরে তাদের কথাবার্তা হয়।

এ সময় তারা এরশাদের স্মৃতিচারণ করেন। পারিবারিক বিষয় ও জাতীয় পার্টির ভবিষ্যৎ রাজনীতি নিয়েও মতবিনিময় হয়েছে। তারা সিদ্ধান্ত নেন, রওশন এরশাদ থাকবেন জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতার দায়িত্বে আর জি এম কাদের দল চালনা করবেন রওশন এরশাদের পরামর্শে। পার্টির একাধিক সূত্র  এ তথ্য নিশ্চিত করেন। জি এম কাদের তার ভাবীর বাড়িতেই দুপুরের খাবার খেলেন। রওশন এরশাদ দোয়া করেন সুষ্ঠুভাবে পার্টি চালনায় জি এম কাদের যেন সক্ষম হন।

অন্যদিকে ভাবীকে যে তিনি মায়ের মতো শ্রদ্ধা করেন সে কথা জানিয়ে জি এম কাদের প্রত্যয় ব্যক্ত করেন, নেত্রী রওশনের পরামর্শক্রমেই তিনি দল চালনা করবেন। উভয়ই সংকল্পবদ্ধ হন যে,  আগামীতে ক্ষমতায় যাওয়ার মধ্য দিয়েই তারা এরশাদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবেন। দুজনের আলাপের সময় বাড়ির অন্য কামরায় ছিলেন প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী, যুগ্ম মহাসচিব হাসিবুল ইসলাম জয়। এরশাদ তার অবর্তমানে দল চালনার জন্য ছোট ভাই গোলাম মোহাম্মদ কাদেরকে দায়িত্ব দেওয়ায় রওশনের সঙ্গে জি এম কাদেরের দূরত্ব তৈরি হয়।

অবস্থা এমন হয়েছিল যে, জি এম কাদের যত কর্মসূচিই ঘোষণা করতেন তাতে রওশন ও তার পন্থিরা গরহাজির থাকতেন। দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করার জন্য পার্টির সাবেক মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার এইচ এম এরশাদের অসুস্থতার পর থেকে দলের ঐক্য বজায় রাখার ওপর গণমাধ্যমে গুরুত্বারোপ করে আসছেন। জি এম কাদের এ প্রতিবেদককে জানান, বেগম রওশন এরশাদ আমাদের অভিভাবক। তার  পরামর্শে জাতীয় পার্টিকে আমরা এগিয়ে নিয়ে যাব।

ফুলেল শুভেচ্ছা : পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য আলমগীর সিকদার লোটনের নেতৃত্বে যুব সংহতির নেতা-কর্মীরা পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে শুভেচ্ছা জানান।

এ ছাড়া জি এম কাদেরকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়েছেন জাতীয় মটর থ্রি হুইলার শ্রমিক সংগঠনের নেতারা। এ সময় সংগঠনের সভাপতি মোস্তাকুর রহমান মোস্তাক ও জাপার যুগ্ম-মহাসচিব হাসিবুল ইসলাম জয় উপস্থিত ছিলেন।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!