• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

নাটকে চরিত্র সংকট


বিনোদন প্রতিবেদক নভেম্বর ১৭, ২০১৯, ০১:৫৪ পিএম
নাটকে চরিত্র সংকট

ঢাকা : কয়েক বছর আগেও দেখা যেত একটি নাটকে অসংখ্য চরিত্রের ছড়াছড়ি। এক একটি চরিত্র দর্শকদের টানত। সে সময় প্রত্যেকটি চরিত্রের আলাদা গুরুত্ব ছিল। দেখা গেছে, অভিনেতার মায়ের চরিত্রে অভিনয় করে কেউ আলোচিত হয়েছেন। আবার কেউ ভাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করে আলোচিত হয়েছেন। এভাবেই একটি নাটকের প্রত্যেকটি চরিত্র নিয়েই আলোচনা হতো। সময়ের পরিক্রমায় নাটকে এখন আর এত চরিত্র দেখা যায় না।

কেবল নায়ক-নায়িকানির্ভর হয়ে পড়েছে এখনকার নাটক। শুধু এই দুই চরিত্রকে কেন্দ্র করেই অসংখ্য নাটক নির্মাণ হচ্ছে। খুব কম নাটকেই বিভিন্ন চরিত্রের সম্মিলন ঘটে। যে কারণে দেশীয় নাটকে ক্রমাগতভাবে কমছে শিল্পীদের উপস্থিতি। নায়ক-নায়িকার পাশাপাশি মাঝে-মধ্যে দু’একটি পার্শ্বচরিত্র থাকলেও তা ততটা গুরুত্ব পায় না। অল্প সময়ের জন্যই উপস্থাপন করা হয় মা-বাবা, ভাই-বোন, কিংবা বন্ধু চরিত্রকে। সাম্প্রতিক সময়ে বেশিরভাগ নাটকের এমন হালের কারণে বিরক্তি প্রকাশ করছেন দর্শকরা। আগে যেখানে বিভিন্ন চরিত্র রাখা হতো একটি নাটকে।

সেখানে সিনিয়র শিল্পীসহ প্রত্যেকেই গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করতেন। এখন সিনিয়র শিল্পীরা সেদিক থেকে অনেকটাই উপেক্ষিত। অন্য চরিত্রকেও দেখানো হয় কোনো রকমে। এখনকার নাটকে নায়ক-নায়িকার বাইরে বিভিন্ন চরিত্র না থাকায় বৈচিত্র্যতা হারাচ্ছে। ঘুরেফিরে একই মুখ দেখতে দেখতে বিরক্ত হচ্ছেন দর্শক। অন্যদিকে বেকার হয়ে পড়ছেন অভিনয়শিল্পীরা। সময়ের ব্যবধানে দেশে অনেকগুলো টিভি চ্যানেলের পাশাপাশি ইউটিউবের জোয়ার বইলেও কাজের পরিধি বাড়েনি। কাজের সুযোগ পাচ্ছেন না নায়ক-নায়িকার বাইরে অন্য চরিত্রের শিল্পীরা।

নাট্য বোদ্ধাদের মতে, নাটকে বৈচিত্র্যতা নিয়ে আসতে হলে নির্মাতাদের কেবল নায়ক-নায়িকানির্ভর নাটক তৈরির চিন্তা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। ভারতীয় চ্যানেলগুলো দেশীয় দর্শকদের ধরে রাখছে ফ্যামিলি ড্রামা দিয়ে। আমাদের নির্মাতাদেরও পারিবারিক গল্পের দিকে জোর দিতে হবে বলেও মনে করেন তারা। তাহলে একদিকে গুণী সব সিনিয়র শিল্পীও নিয়মিত হবেন, পাশাপাশি নাটকে বৈচিত্র্যতা আসবে।

বরেণ্য নাট্যাভিনেতা ড. ইনামুল হক বলেন, ‘আমাদের সময়ে একটি নাটকে অনেক চরিত্র থাকত। নাটকে যখন অনেক চরিত্র থাকবে তখন বিভিন্ন বয়সের শিল্পীর প্রয়োজন হবে। তখনকার নাটকগুলো পারিবারিক গল্পের ছিল। এখন অনেক নাটকের গল্পে নায়ক-নায়িকার বাইরে অন্য চরিত্র রাখা হয় না। এটার কিছু কারণ আছে তার মধ্যে অন্যতম বাজেট স্বল্পতা। খরচ বাঁচাতে এমন করা হয়।

অন্যদিকে পারিবারিক গল্পের নাটক নির্মাণ করা কঠিন। সময় বেশি লাগে, শিল্পী নির্বাচন করতেও বেগ পেতে হয়। এখনকার অনেক নাটকে এক ধরনের অবাস্তবতাও থাকে। দর্শকও হয়তো চায়। কিন্তু পারিবারিক নাটকে বাস্তবতা থাকে। সেটা সব ধরনের দর্শই পছন্দ করেন।’

অভিনয়শিল্পী সংঘের সাধারণ সম্পাদক আহসান হাবিব নাসিম বলেন, ‘টিভি নাটকে বর্তমানে সাড়ে ১০০০ নিবন্ধিত শিল্পী আছেন। এর মধ্যে অনেক শিল্পীই বেকার। এর মধ্যে অভিনয় জানা গুণী শিল্পীর সংখ্যাও কম নয়। নিয়মিত কাজ করেছেন কিছু শিল্পী। এখন পারিবারিক ও সামাজিক গল্পের নাটক হারিয়ে গেছে। এখন যে ধরনের নাটক তৈরি হয় তাতে নায়ক-নায়িকা ছাড়া অন্যদের কাজের সুযোগ থাকে না। এতে করে কাজের ক্ষেত্র কমে যাচ্ছে। আগের নাটকের মতো শিক্ষক, মেম্বার-চেয়ারম্যান, মামা-খালা, রাখাল, ভাই-বোন এসব চরিত্র নেই বললেই চলে। এজন্য বর্তমান সময়ের নাটক আবেদন হারিয়েছে। নাটকে অভিনয়, রচনা, নির্মাণ ও প্রচারের ক্ষেত্রে কোনো নিয়ম না থাকায় অনেক সমস্যা তৈরি হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি এসব সমস্যা সমাধানের। এতে করে শিল্পীরা বেকার থাকবে না। কাজের ক্ষেত্র তৈরি হবে।’

মঞ্চ, টিভি ও চলচ্চিত্রের শক্তিমান অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদার বলেন, ‘আমাদের সময়ে একটি নাটকে অনেক চরিত্র থাকতো। নাটকে যখন অনেক চরিত্র থাকবে তখন বিভিন্ন বয়সের শিল্পীর প্রয়োজন হবে। এখন অনেক নাটকের গল্পে নায়ক-নায়িকার বাইরে অন্য চরিত্র রাখা হয় না। যার কারণে নাটক সব একই ধরনের মনে হচ্ছে। একই মুখ দেখতে দেখতে দর্শকও বিরক্ত। সিনিয়র শিল্পী বা নাটকের অন্য শিল্পীদের মূল্যায়ন হচ্ছে না। আমি এখন বছরে দু-একটি নাটকে অভিনয় করি। যদি মনের মতো গল্প ও চরিত্র পাই। একটা সময় আমি নিয়মিত অভিনয় করতাম। আমার মতো এমন অনেক সিনিয়র শিল্পী খুব বেশি অভিনয় করেন না। যারা নাটক নির্মাণ করছেন, গল্প লিখছেন তাদের এসব নিয়ে ভাবতে হবে। নায়ক-নায়িকা থেকে বের হয়ে গল্প চিন্তা করতে হবে। তাহলে পরিবর্তন আসবে।’

নির্মাতা চয়নিকা চৌধুরী বলেন, ‘সিনিয়র শিল্পীদের নিয়ে নির্মাতাদের কাজ না করার অন্যতম কারণ হলো বাজেট। এই সময়ে নাটকের বাজেট এতটাই কম যে সেখানে সিনিয়র শিল্পীদের নিয়ে কাজ করা অনেক নির্মাতার পক্ষে সম্ভব হয় না। পাশাপাশি সে ধরনের ভালো গল্পেরও অভাব আছে। আর একটি বিষয় হলো এই সময়ে অনেক নির্মাতা কিংবা প্রযোজক ইউটিউব ভিউয়ার্স নিয়ে চিন্তা করে। যেসব নায়ক-নায়িকাকে নিলে নাটকে ভিউ বেশি হবে তারা তাদের নিয়েই শুধু কাজ করছে। সেখানে নাটকের অন্য চরিত্রগুলোর দিকে তাদের মনোযোগ থাকে না। আমি মনে করি বাজেট কম থাকলেও যতটুকু সম্ভব নায়ক-নায়িকার বাইরে নির্মাতাদের অন্য চরিত্রগুলোর দিকে গুরুত্ব দেয়া উচিত।’

এ বিষয়ে আরেক নির্মাতা সাগর জাহান বলেন, ‘এ সময়ে পারিবারিক গল্পের নাটক নির্মাণের সংখ্যা কমে গেছে। ফলে নাটকে বাবা-মা, দাদা-দাদি, নানা-নানি থেকে শুরু করে অন্য চরিত্রগুলোর খুব বেশি প্রয়োজন হয় না। যেকোনো ফ্যামিলি ড্রামাতে বরাবরই অনেক চরিত্র পাওয়া যায়। আমাদের বাজেটের কারণে এই সময়ে ফ্যামিলি ড্রামা নির্মাণ সম্ভব হয় না। যার কারণে নির্মাতাদের অনেকেই নায়ক-নায়িকা নির্ভর হয়ে গেছেন। তবে আমি আমার নাটকগুলোতে নায়ক-নায়িকার বাইরে আরো অনেক চরিত্র রাখার চেষ্টা করি। সেগুলোর গুরুত্বও থাকে বেশি।’

নাট্যবোদ্ধাদের মতে, নাটকে বৈচিত্র্যতা নিয়ে আসতে হলে নির্মাতাদের কেবল নায়ক-নায়িকানির্ভর নাটক তৈরির চিন্তা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। গুণী সব সিনিয়র শিল্পীদের নাটকে জাযগা করে দিতে হবে। নাট্যনির্মাতাদের ব্যবসায়িক চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে নাটকের মান নিয়ে চিন্তা করতে হবে। আগের নাটকের সেই মান ফিরিয়ে আনতে হবে। তবেই কেবল দর্শক নাটকের প্রতি আবার নতুন করে আগ্রহ দেখাবে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!