• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০
বছর শেষে সন্তানের ভর্তি পোশাক-আশাকের দুশ্চিন্তা

নিত্য খরচের চাপে দিশেহারা মানুষ


বিশেষ প্রতিনিধি নভেম্বর ১৭, ২০১৯, ০৪:১২ পিএম
নিত্য খরচের চাপে দিশেহারা মানুষ

ঢাকা : হঠাৎ বেড়ে গেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যে ক্রেতাসাধারণের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। পেঁয়াজ, চাল, তেলসহ প্রায় অধিকাংশ পণ্যের দাম একই সময়ে বেড়ে যাওয়ায় দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে দেশের মানুষ।

শুধু নিত্যপণ্য নয়, খরচ বেড়েছে জীবনযাপনের অন্যসব ক্ষেত্রেও। দফায় দফায় সরকার গ্যাস, পানি, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কারণে সে খরচগুলোও সরাসরি যুক্ত হয়েছে পরিবারের ব্যয়ে।

অন্যদিকে বছরের শেষে বাড়তি চাপ রয়েছে বেড়ে যাওয়া বাড়ি ভাড়াসহ ছেলেমেয়েদের ভর্তি, নতুন পোশাক-আশাকের খরচে। সব মিলে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন গড়পড়তা আয়ের মানুষ।

রাজধানী বেইলি রোডে দুই কক্ষের একটি ছোট বাসায় দুই মেয়েকে নিয়ে থাকেন বেসরকারি ব্যাংকের ছোট কর্মকর্তা নিলুফা বেগম (ছদ্মনাম)। স্বামী মারা যাওয়ার পরে ছোট মেয়ে কাছাকাছি স্কুলে পড়বে বলে বাধ্য হয়েই এই অভিজাত এলাকায় বাসা নিয়ে থাকছেন। নিজের অফিসটাও খুব কাছে। কিন্তু বাড়তি ব্যয়ের কারণে এখন ওই এলাকা ছাড়তে হবে তাকে। গত কয়েক মাসে প্রায় পাঁচ হাজার টাকা খরচ বেড়েছে তার সংসারে, সেটা আর পোষাতে পারছেন না তিনি।

শনিবার (১৬ নভেম্বর) তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, প্রায় সব খাতেই ব্যয় বেড়েছে পরিবারে। কিন্তু আয় সেভাবে বাড়ছে না। সংসার চালানোই এখন কষ্টকর হয়ে পড়েছে। এ জন্য অন্য এলাকায় কম ভাড়ায় বাসা খুঁজছেন তিনি। বাসা ভাড়া বাবদ ব্যয় সংকোচন করে খরচ সমন্বয় করতে হবে তাকে। যদিও এ জন্য তার সন্তানের নিরাপদে স্কুলে যাতায়াতের বিষয়টি ব্যাহত হবে। এখন সংসারের বাড়তি ব্যয় কত নিলুফা বেগম সেটা কড়ায় গণ্ডায় হিসাব রেখেছেন।

তিনি বলেন, আগে ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকার মধ্যে সারা মাসের বাজার খরচ চলত। এখন সেটা ৫ হাজার টাকা পেরিয়ে গেছে। এ ছাড়া চলতি বছরে গ্যাস, পানির দাম বেড়েছে। এতে ৫০০ টাকা বেশি খরচ হচ্ছে। সন্তানের শিক্ষার খরচ বেড়েছে আরো ৪০০ টাকা। এমনকি ডিশ সংযোগ, গৃহকর্মীর মজুরি থেকে ময়লা ফেলার জন্যও বাড়তি টাকা দিতে হচ্ছে। আর আগামী বছরের শুরু থেকে বাড়তি ২ হাজার টাকা ভাড়া দাবি করছে বাড়ির মালিক।

অর্থাৎ এ বছরেই নিলুফার সংসারের খরচ বেড়েছে অস্বাভাবিকহারে। যদিও খরচের সঙ্গে তার উপার্জন বৃদ্ধির কোনোই সামঞ্জস্য নেই। ফলে তার মতো এমন মানুষকে মাসের শুরুতে বেতন পেয়েই এসব ব্যয় মেটাতে হয় ধার-কর্জ করে। ফলে বেতন পেয়েও তাদের মুখে খুশির বাঁকা হাসিটা হারিয়ে যায়। আর এমন পরিস্থিতিতে সাশ্রয়ের তো কোনো সুযোগই নেই।

নিত্যপণ্যের দাম আকাশছোঁয়া : ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) নিত্যপণ্যের ব্যয় বৃদ্ধির বছরভিত্তিক হিসাব রাখে। সংগঠনটির হিসাবে গত ১০ বছরে (২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত) রাজধানীতে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে সাড়ে ৮৬ শতাংশ।

ক্যাবের এই হিসাব ১১৪টি খাদ্যপণ্য, ২২টি নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী এবং ১৪টি সেবার তথ্য বিশ্লেষণ করে তৈরি। এতে শিক্ষা, চিকিৎসা ও প্রকৃত যাতায়াত ব্যয় বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।

এদিকে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) ১৫ প্রকারের নিত্যপণ্যের বাজারদরের হিসাব রাখে প্রতিদিন। এর মধ্যে চাল, আটা, ময়দা, তেল, লবণ, চিনি, ডাল, মশলা, মাছ, মাংস, গুঁড়াদুধসহ আরো কিছু পণ্যের বিভিন্ন প্রকারের দাম রয়েছে।

সর্বমোট টিসিবির তালিকায় থাকা ৩৬ ধরনের পণ্যের মূল্যতালিকা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এর মধ্যে বছর ব্যবধানে বেড়েছে ২৩টি পণ্যের দামই। আর অপরিবর্তিত রয়েছে ৪টি পণ্য। কমেছে শুধু ৯ ধরনের পণ্যের দাম। অর্থাৎ অধিকাংশ পণ্যই ঊর্ধ্বমুখী।

তথ্য আরো বলছে, তালিকায় থাকা পণ্যগুলোর দাম বেড়েছে সাড়ে ৫০০ শতাংশ পর্যন্ত। কিন্তু কমার ক্ষেত্রে নেমেছে সর্বোচ্চ ২৮ শতাংশ।
এদিকে বর্তমান বাজারে বেড়েছে চাল, পেঁয়াজ, তেল, আলু থেকে শুরু করে অধিকাংশ নিত্যপণ্য। এর মধ্যে পেঁয়াজের দাম ইতিহাসে সর্বোচ্চ। প্রতি কেজি পেঁয়াজ কিনতে গুনতে হচ্ছে ২২০ থেকে ২৫০ টাকা। যা প্রায় ৬ কেজি চালের সমান আর গ্রামগঞ্জে ভরা মৌসুমে এ দামে আধা মণ চালও পাওয়া যায়।

অন্যদিকে ঢাকার বাজারে কোথাও ৫০ টাকার নিচে কোনো সবজি মিলছে না। অর্থাৎ কয়েক পদের সবজি কিনতে একজন রিকশাচালকের আধা বেলার ইনকাম গুনতে হচ্ছে।

অন্যদিকে বেড়েছে সাবান, সোডা, গুঁড়াদুধের মতো নিত্যপণ্যের দামও। এমনকি চলতি বছর বেশ বেড়েছে ওষুধের দামও। সবমিলে বেশিরভাগ জরুরি পণ্যের দাম হু হু করে বেড়ে ক্রেতার সামর্থ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে।

গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির খরচও বেড়েছে : এ বছরের মাঝামাঝিতে ৩২ দশমিক ৮ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়েছে গ্যাসের। এতে পরিবারে এখন দুই চুলার জন্য ৮০০ টাকা থেকে বেড়ে ৯৭৫ টাকা আর এক চুলার খরচ ৭৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৯২৫ টাকা হয়েছে। পাশাপাশি গৃহস্থালি মিটারে দাম বেড়েছে প্রতি ঘনমিটারে ১২.৬০ টাকা।

অন্যদিকে সিএনজি গ্যাসের দাম, বিদ্যুৎ, সার, ক্যাপটিভ পাওয়ার, শিল্প, চা বাগান, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পসহ হোটেল, রেস্তোরাঁয়ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর কারণে তার মাশুলও গুনছে সাধারণ মানুষ। গ্যাসের দাম বাড়ার পরে ওইসব খাতে উৎপাদিত পণ্যসহ পরিবহন ও সেবার ব্যয় বেড়েছে।

অন্যদিকে সম্প্রতি পাইকারি বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবও দিয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়লে বিতরণ সংস্থাগুলোর ব্যয় বেড়ে যায়। এই ব্যয় সামাল দিতে শেষ পর্যন্ত ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। যদিও এর আগে সর্বশেষ ২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছিল।

বাড়ছে বাসা ভাড়াও : বছর শেষে এখন বাসা ভাড়াও বাড়ার সময় এসেছে। ইতোমধ্যে অনেকের বাসা ভাড়া বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন মালিকরা। রাজধানীর সব এলাকাতেই বাসা ভাড়া বাড়ছে।

নগরের বিভিন্ন এলাকার ভাড়াটের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিবছরই বাড়ির মালিক ভাড়া বাড়ান। গত ২৫ বছরে রাজধানীতে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে প্রায় ৪০০ শতাংশ।

অন্যদিকে ক্যাবের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে ১৯৯০ সালে পাকা ভবনে দুই কক্ষের একটি বাসার ভাড়া ছিল ২ হাজার ৯৪২ টাকা। ২০১৫ সালে সেই ভাড়া দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ১৫০ টাকা। গত বছর এই ভাড়া এসে ঠেকেছে ২১ হাজার ৩৪০ টাকায়।

বাজেটে বেড়েছে বাড়তি চাপ : এ বছর বাজেট মধ্যবিত্তের খরচ বাড়ার এক গাদা দুঃসংবাদ নিয়ে এসেছিল। এর প্রভাবে এ বছর খরচ বেড়েছে বেশি হারে।

বাজেটের পরে এলপিজি, চিনি, ভোজ্যতেল, শিশুখাদ্যের, গুঁড়া মসলা, ভালোমানের বিস্কুট, কেক, ফলের রস, আচার ও আইসক্রিম রয়েছে মূল্যবৃদ্ধির তালিকায়। ফলে এসব পণ্য কিনতে বাড়তি টাকা লাগছে। পোশাকেও আগের চেয়ে বেশি হারে মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) দিতে হবে। যাতায়াতেও আগের চেয়ে কিছুটা খরচ বেড়েছে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!