• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ফাঁদে ফেলে মেডিকেল ছাত্রীকে বিয়ে, বেড়িয়ে এল ৩ বিয়ে...


রাজশাহী ব্যুরো মার্চ ১৫, ২০১৯, ০৮:০২ পিএম
ফাঁদে ফেলে মেডিকেল ছাত্রীকে বিয়ে, বেড়িয়ে এল ৩ বিয়ে...

রাজশাহী: শুভ মৃধা। ডাক নাম ফারুক। বাবা ভূমিহীন কৃষক। শুভর ভোটার তথ্য ফরমে দেয়া তথ্য অনুজায়ী তার শিক্ষাগত যোগ্যতা মাধ্যমিক। তবে তিনি মাধ্যমিকও উত্তীর্ণ হননি। তবে নিজেকে একজন প্রকৌশলী পরিচয় দেন। এর এই পরিচয়েই তার প্রেমের ফাঁদে পড়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছেন রাজশাহীর এক মেডিকেল ছাত্রী। তবে প্রতারণার বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় বিয়ের এক দিনের মাথায় ওই ছাত্রী স্বামীকে তালাক দেন।

জানা যায়, প্রতারণার শিকার ওই ছাত্রী রাজশাহী নগরীর লক্ষ্মীপুর এলাকার বাসিন্দা। সিরাজগঞ্জের একটি প্রাইভেট মেডিকেল কলেজের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী তিনি। তার বাবা একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী।

এ দিকে অভিযুক্ত সোহান মাহমুদ ওরফে শুভ মৃধা নাটোরের সিংড়া উপজেলার বাকুন্দা এলাকার আবদুল মজিদ মৃধার ছেলে।

রাজশাহী একটি কমিউনিটি সেন্টারে গত ২২ ফেব্রুয়ারি মহাধুমধামে ওই মেডিকেল ছাত্রী ও শুভর বিয়ে হয়। এটি শুভ মৃধার তৃতীয় বিয়ে। এর আগে প্রথম বিয়ের কথা গোপন করে এক কলেজছাত্রীকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে বিয়ে করেন শুভ। আগের দুই স্ত্রীর দুটি সন্তানও রয়েছে তার।

অন্যদিকে, স্বামীর (শুভ) তৃতীয় বিয়ের খবরে ওইদিনই সন্তানসহ দ্বিতীয় স্ত্রী রাজশাহী এলে জানাজানি হয় শুভর প্রতারণা। পরদিনই শুভকে তালাক দেন ওই মেডিকেল ছাত্রী। প্রতারিত হয়ে ওইদিনই তার বাবা নগরীর রাজপাড়া থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন।

মেডিকেল ছাত্রীর বাবা জানান, তার মেয়েটাকে শুভ প্রেমের ফাঁদে ফেলেছিল। মেয়েটা বড় হয়েছে বলে তার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছিলাম। শুভ বলেছিল, তার বাবা একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল। তবে সম্পর্ক নেই। ঠিকানা দেয়া হয়েছিল নাটোর সদরের। ভেবেছিলাম মেয়ে ডাক্তার হচ্ছে, ছেলে ইঞ্জিনিয়ার তারা ভালো থাকবে। কিন্তু সবই মিথ্যা। ও একটা বড় প্রতারক।

এদিকে শুভর বাবা আবদুল মজিদ মৃধার দাবি, তার ছেলে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার। তবে তিনি অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল নন, তিনি একজন সাধারণ কৃষক। সবগুলো বিয়ে শুভ একা একা করেছে। আর তৃতীয় বিয়ের কথা তিনি জানতেন না।

সিংড়ার ইটালী ইউনিয়ন পরিষদের ৪ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য মকবুল হোসেন জানান, শুভ মৃধার ডাক নাম ফারুক। তার বাবা একজন ভূমিহীন কৃষক। মাধ্যমিক পাশ করতে না পারলেও তিনি অন্যের সনদ দিয়ে চাকরি করছে বলে শুনেছেন।

জানা গেছে, জীবিকার তাগিদে সিংড়া উপজেলা সদরে মোবাইলে রিচার্জের ব্যবসা করতেন শুভ। কিছু দিন গাড়িচালক হিসেবেও কাজ করেন। এরপর শিক্ষা সনদের জাল ফটোকপি দিয়ে চাকরি নেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। আর এ জন্য নিজেকে একজন প্রতিমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচয় দেন সব সময়। শুভর ভোটার তথ্য ফরমে দেয়া হয়েছে তার শিক্ষাগত যোগ্যতা মাধ্যমিক। তবে তিনি মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হননি।

অথচ শুভ রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ইলেকট্রিক্যাল টেকনোলজিতে ডিপ্লোমা এবং ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্স (ইউআইটিএস) থেকে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে বিএসসি পাশের জাল সনদ দিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। চাকরি নেয়ার সময় শিক্ষা সনদের যেসব ফটোকপি শুভ দিয়েছেন, তার সবই জাল। শিক্ষাবোর্ড এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।

নিশ্চিত হওয়ার জন্য শুভর এসএসসির রোল নম্বর দিয়ে অনলাইনে শিক্ষাবোর্ডের আর্কাইভে কোনো শিক্ষার্থীরই ফলাফল পাওয়া যায়নি।

রাজশাহী মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর আনোয়ারুল হক প্রামানিক বলেন, অনলাইন আর্কাইভে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের ফলাফল দেয়া আছে। সেখানে ফলাফল না পাওয়া গেলে বুঝতে হবে সনদপত্রটি জাল।

বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের অনলাইনেও শুভর সনদের রোল নম্বর দিয়ে ফলাফল পাওয়া যায়নি। বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ড. প্রকৌশলী সুশীল কুমার পালও বলেছেন, শুভর ওই সনদটি জাল।

শিক্ষার্থীর আইডি নম্বর নিয়ে খুঁজে দেখে এই সনদও জাল বলে নিশ্চিত করেন ইউআইটিএআইয়ের সিনিয়র সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক জেসমিন সুলতানা।

শুভর বিষয়ে আরও জানা যায়, ২০০৯ সালে সিংড়া পৌরসভার মাদারিপুর মহল্লার এক ভ্যানচালকের মেয়েকে বিয়ে করেন শুভ। শ্বশুরবাড়ি যাওয়া-আসার সময় ওই এলাকার এক ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্রী তার টার্গেটে পড়েন। ২০১৪ সালে শুভ ওই ছাত্রীর মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে কথাবার্তা শুরু করেন। গোপন রাখেন বিয়ের কথা।

শুভ তখন একজন প্রকৌশলী হিসেবেই কুষ্টিয়ায় একটা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। প্রেমের ফাঁদে ফেলে ওই বছরের ১২ নভেম্বর শুভ সেই ছাত্রীকে আদালতে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করেন। এরপর আগের বিয়ের কথা জানিয়ে সেদিনই প্রথম স্ত্রীকে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় তালাক দেন। শুভর তালাকপ্রাপ্ত প্রথম স্ত্রীর এখন পাঁচ বছরের একটা ছেলে আছে।

দ্বিতীয় স্ত্রী জানান, গত বছর শুভ ঢাকায় একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। বেতন পেতেন প্রায় ৫০ হাজার টাকা। তখন তিনি স্বামীর সঙ্গেই ঢাকায় থাকতেন। গত বছরের নভেম্বরে শুভ সেই চাকরি ছেড়ে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের একটি প্রকল্পে প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দেন। এরপর শুভ রাজশাহীতে থাকতে শুরু করেন। তিনি রাজশাহী আসতে চাইলেও শুভ তাকে বলতেন, কিছু দিন পরই এই চাকরি ছেড়ে তিনি ঢাকায় আসবেন। এভাবে তাকে রাজশাহী না এনে তৃতীয় বিয়ের ফাঁদ পাতেন।

তিনি আরো জানান, তৃতীয় বিয়ের পরদিনই শুভ তালাকপ্রাপ্ত হলে নিজের সন্তানের কথা ভেবে তিনি মেনে নেন। রাজশাহী থেকে স্বামীকে বাড়ি নিয়ে যান। সাতদিন শুভ শ্বশুরবাড়িতেই থাকেন। এরপর ব্যাংক ঋণের কথা বলে শুভ তার অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য শ্বশুরের কাছ থেকে ৪০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন। ড্রয়ার থেকে নেন আরও ৯৫ হাজার টাকা। সঙ্গে একজোড়া বালা নিয়ে ব্যাংকে ঋণ পরিশোধের কথা বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। আর ফেরেননি।

শুভ মৃধা ওরফে ফারুক মোবাইলে নিজের শিক্ষা সনদ আসল বলে জানান। প্রতারণা করে বিয়ের বিষয়ে তিনি কথা বলতে রাজি হননি।

রাজশাহী নগরীর রাজপাড়া থানার ওসি হাফিজুর রহমান বলেন, এ বিষয়ে এখনো কোনো অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে শুভর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি।

সোনালীনিউজ/এমএইচএম

Wordbridge School
Link copied!