• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

বন্ড মার্কেটের বিকাশ নেই


নিজস্ব প্রতিবেদক জানুয়ারি ২৮, ২০১৯, ০১:০৫ পিএম
বন্ড মার্কেটের বিকাশ নেই

ঢাকা : দেশের বন্ড মার্কেট বিকশিত হচ্ছে না। অথচ উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোয় দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য বন্ড মার্কেট থেকে অর্থ সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো চিত্র ভিন্ন। ফলে ব্যাংকিং খাতকে বিভিন্ন সময়ে সঙ্কটে পড়তে হয়।

বন্ড হলো জনগণের কাছ থেকে নির্দিষ্ট মেয়াদে ও সুদে সরকার ও প্রাতিষ্ঠান যে টাকা ধার নেয় তাকে বন্ড বলে। শেয়ারবাজারে বন্ডকে ডেট বা ঋণ সিকিউরিটিজ বলা হয়। মেয়াদ শেষ হওয়ার পর সুদসহ সরকারের নেওয়া  অর্থ ফেরত দিতে হয়। আর সেকেন্ডারি মার্কেটে তালিকাভুক্ত হওয়ায় মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই জনগণ চাইলে বন্ড বিক্রি করে টাকা নিতে পারে।

দেশে বন্ড মার্কেটের দুরবস্থার কারণে ব্যাংকগুলো আমানত ছাড়া অন্য কোনো উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে পারছে না। এজন্য করপোরেট সেক্টর বন্ড মার্কেটের পরিবর্তে ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল হয়ে আছে। যে কারণে ব্যাংক খাতের ওপর চাপ বাড়ছে। শেয়ারবজারে তালিকাভুক্ত ট্রেজারি বন্ডগুলো বছর ধরে পড়ে থাকলেও লেনদেন হয় না। তবে কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ড ছেড়ে অর্থ সংগ্রহ করে থাকে। জানা গেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ দুই হাজার কোটি টাকার বন্ড ছেড়ে অর্থ সংগ্রহ করেছে। এ ছাড়া বেসরকারি কিছু ব্যাংক বন্ড ছেড়ে বাজার থেকে অর্থ জোগান নিচ্ছে।

আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানান, পর্যাপ্ত সেকেন্ডারি মার্কেট না থাকায় সরকারি বিল ও বন্ডের বেচাকেনা হচ্ছেই না। এসব বন্ড ও বিলের ক্রেতা মূলত সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। ট্রাস্ট অ্যাক্ট ও কোম্পানি অ্যাক্ট অনুযায়ী সরকারি ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রভিডেন্ট ফান্ডের অর্থ বন্ডে বিনিয়োগ করার কথা থাকলেও তা হচ্ছে না।

এ ছাড়া পেনশন ফান্ডের টাকাও বন্ডে বিনিয়োগের বাধ্যবাধকতা আরোপে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেই। এজন্য কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাকেই দায়ী করছেন অনেকে।

ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা জানান, আইন অনুযায়ী প্রভিডেন্ট ফান্ড বন্ডে বিনিয়োগ করা হচ্ছে কি না তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছে সরকার। তাই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পেনশন তহবিল এখনো নন-ফান্ডেড থাকায় বন্ডে বিনিয়োগ হচ্ছে না। অথচ বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই পেনশন তহবিল ফান্ডেড। পেনশন তহবিল বন্ডে বিনিয়োগ করার কারণে সেসব দেশে সেকেন্ডারি বন্ড মার্কেট বিস্তৃতি লাভ করেছে। তাই ব্যাংকগুলো পাচ্ছে বড় মুনাফা।

ট্রেজারি কর্মকর্তারা বলেন, বাজেট বাস্তবায়নে বন্ডের বিপরীতে টাকা তুলে নিলেই দায়িত্ব শেষ হয় না। বন্ডগুলোর কেনাবেচা নিশ্চিত করতে সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

অপরদিকে অনুসন্ধানে জানা গেছে, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত সরকারি ট্রেজারি বন্ডের লেনদেন আট বছরেও হয়নি। ২২১টি বন্ডের পরিশোধিত মূলধন ৫৫ হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা। যা ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মূলধনের ২২.৫০ শতাংশ। বিশাল এই খাতের লেনদেনের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগও নেই। একই সঙ্গে মেয়াদ শেষ হওয়ায় প্রায় ১৫টি বন্ড তালিকাচ্যুত করা হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে। আবার কিছু প্রতিষ্ঠান তালিকাচ্যুত হওয়ার সময় হয়েছে। তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি না পাওয়ায় তাদের তালিকাচ্যুত করা হচ্ছে না।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বন্ড খুবই সম্ভাবনাময় একটি পণ্য। বাংলাদেশের অর্থনীতি যে হারে বাড়ছে সে গতি ধরে রাখতে বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন। অবকাঠামো প্রকল্পের জন্য বড় ও দীর্ঘমেয়াদি তহবিল দরকার। ব্যাংকে অর্থায়নের মাধ্যমে এই চাহিদা কখনো পূরণ করা যাবে না। তা ছাড়া ব্যাংকের জন্য দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন বেশ ঝুঁকিপূর্ণও বটে। তবে বন্ডের সমস্যা হলো সক্ষম বিনিয়োগকারী এখানে আসতে চায় না। কারণ বন্ড কিনলে প্রায়  ১০ বছরের জন্য বিনিয়োগ স্থিত হয়ে যায়। বন্ডের মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত পুরো বিনিয়োগ ফেরত পাওয়া যায় না।

এ ছাড়া বিনিয়োগ প্রত্যাহারের কতটা সহজ সুযোগ আছে সে সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চায়। বন্ডের একটি কার্যকর সেকেন্ডারি মার্কেট থাকলে হয়তো এ সমস্যা থাকত না।

বিআইবিএম আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বন্ড মার্কেটের বিদ্যমান অসঙ্গতি নিয়ে ব্যাংকিং খাতের এক বিশেষজ্ঞ বলেন, অসঙ্গতি আছে, থাকবে। এর মধ্য দিয়েই কীভাবে মার্কেট ডেভেলপমেন্ট করা যায় সেটা দেখতে হবে। এখানে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন নিশ্চিত করা।

সম্পদ ব্যবস্থাপকরা বলছেন, পুঁজিবাজারকে বিকশিত করতে হলে এখানে বিভিন্ন ধরনের প্রডাক্ট নিয়ে আসতে হবে। আমাদের বাজারে প্রডাক্টের ভিন্নতা নেই। এটি মূলত শেয়ারবাজার। আর বন্ড ও ডিবেঞ্চারে একেবারেই লেনদেন নেই। এগুলো শুধু তালিকাভুক্তিতেই সীমাবদ্ধ।

ব্যাংকাররা বলছেন, দেশের পুঁজিবাজার এশিয়ার বাজারগুলোর তুলনায় সবচেয়ে বেশি লাভজনক। তাই এখানে বিনিয়োগকারীরা আসতে শুরু করেছেন। এ অবস্থায় ভালো কোম্পানির শেয়ারের সরবরাহ ও প্রডাক্টের ভিন্নতা আনতে হবে। তাই স্টক এক্সচেঞ্জ ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে বাজারে ভালো কোম্পানির শেয়ার আনতে উদ্যোগী হতে হবে।

জানা গেছে, ১৯৮৮ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত মাত্র তিনটি করপোরেট বন্ড ও ১৪টি ডিবেঞ্চার ইস্যু করা হয়েছে। বন্ডগুলোর স্থিতি দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) মাত্র ০.২ শতাংশ। এ ছাড়া ব্যাংকগুলো ১৯ হাজার ৮২৪ কোটি টাকার মোট ৫৭টি সাব-অর্ডিনেট বন্ড ইস্যু করেছে।

বন্ড কয়েক প্রকারের হয়ে থাকে। যেমন ‘সাব-অর্ডিনেটেড বন্ড’। বন্ড হচ্ছে এক ধরনের ঋণপত্র। এই ঋণপত্র ছেড়ে ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে। পরিশোধের দিক থেকে কোম্পানির ঋণদাতাদের মধ্যে সবার নিচে এই বন্ডধারীদের অবস্থান বলে এটাকে সাব-অর্ডিনেটেড (ঝুঁকিপূর্ণ) বন্ড বলে।

আরেক প্রকারের বন্ড হচ্ছে ‘সভরেন বন্ড’। সভরেন বন্ড একটি বিশেষ ধরনের বন্ড, যা আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজারে বিক্রি হয়। বাণিজ্য ঘাটতি মেটাতে এ ধরনের বন্ড ইস্যু করা হয়। সরকারি বন্ডের সঙ্গে এর পার্থক্য হলো সরকারি বন্ড দেশের অভ্যন্তরে টাকায় কেনাবেচা হয়। আর সভরেন বন্ড বৈদেশিক মুদ্রায় আন্তর্জাতিক বাজারে কেনাবেচা হয়।

বন্ডের সর্বশেষটি হলো ‘ট্রেজারি বন্ড’। বর্তমানে বাজারে মোট ৪ মেয়াদের বন্ড রয়েছে- ৫ বছর, ১০ বছর, ১৫ বছর এবং ২০ বছর।  ২০০৫ সাল থেকে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ সরকারি ট্রেজারি বন্ড তালিকাভুক্ত হয়। সর্বশেষ কার্যক্রম শেষ হয় ২০১১ সালের ৩০ অক্টোবর। ট্রেজারি বন্ডের প্রত্যেকটিরই অভিহিত মূল্য এক লাখ টাকা। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো লেনদেন হয়নি। এমনকি ডিএসইর ওয়েবসাইটেও এসব বন্ডের তেমন কোনো তথ্য নেই।

বন্ডের লেনদেন নিয়ে ইতোমধ্যে পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন তৈরি করেছে ডিএসই। তারা লেনদেন না হওয়ার পেছনে কিছু কারণ চিহ্নিত করে। সবচেয়ে বড় কারণ হলো অথোরাইজড ডিলাররা বন্ডের লেনদেনে প্রস্তাব করেনি। প্রতিষ্ঠানটির মতে, ২২১টি বন্ডের মধ্যে প্রত্যেকটির অভিহিত মূল্য এক লাখ টাকা। তবে অভিহিত মূল্য ১০ হাজার টাকা করার সুপারিশ করা হয়েছে, কিন্তু তা কার্যকর হয়নি।

অন্যদিকে বন্ডের ব্যাপারে অধিকাংশ বিনিয়োগকারীর ধারণা নেই। তাদের মতে, বন্ডের বিকাশের ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং স্টক এক্সচেঞ্জের মধ্যে যোগাযোগে ব্যাপক দূরত্ব রয়েছে। বাজারবান্ধব পরিকল্পনার অভাব আর উন্নত প্রযুক্তির অভাবের কারণে বন্ডকে বিনিয়োগকারীদের কাছে উপস্থাপন করা যাচ্ছে না।

উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে বন্ড মার্কেটকে শক্তিশালী করার কথা জানিয়ে ঢাকা ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাকিল রিজভী বলেন, ‘ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে বন্ড মার্কেটের উন্নয়নের জন্য একটি প্রস্তাব বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো হয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে বন্ড মার্কেট বিকল্প পণ্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। অথচ আমাদের এখানে দেশে বন্ডের প্রচলন সে রকম নেই। এখন সময় হয়েছে উন্নত বাংলাদেশের জন্য বন্ডের বিষয়টি ভাবার। কারণ পৃথিবীর সব দেশেই এই বন্ড প্রথা চালু রয়েছে। পরিকল্পনা আর পদ্ধতিগত সুবিধার বিকাশ ঘটিয়ে দেশে বন্ড চালু করা কঠিন কিছু নয়।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!