• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিলুপ্তির পথে হালুয়াঘাটের তাঁত শিল্প


ময়মনসিংহ প্রতিনিধি ডিসেম্বর ১৫, ২০১৬, ০৬:১৭ পিএম
বিলুপ্তির পথে হালুয়াঘাটের তাঁত শিল্প

ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী হালুয়াঘাট উপজেলার মনিকুড়া, জয়রামকুড়া এলাকায় প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্পের গ্রাম নামেই এক সময় বহু পরিচিত ছিল এই গ্রাম। গ্রামের প্রতিটি বাড়ির উঠানে কারিগররা নিপুণভাবে বুনতেন গারো আদিবাসী ও সকল ধর্মের লোকদের জন্যে গামছা, শাড়ি, কম্বল, চাদরসহ নানা ধরণের রুচিশীল পোশাক। খট খট শব্দে মুখরিত থাকত হালুয়াঘাটের মনিকুড়া ও জয়রামকুড়ার এসব এলাকা। দিন-রাত নানা বৈচিত্র্যের পোশাক তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করতেন তাঁতী পরিবারের সদস্যরা। কিন্তু পুঁজির অভাবে চাহিদা মতো পোশাক তৈরি করতে না পারায় অনেক কারিগর আজ পথে বসেছে। যার কারণে সেই ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প আজ বিলুপ্তির পথে এসে দাঁড়িয়েছে।

বৃহস্পতিবার (১৫ ডিসেম্বর) তাঁতপল্লী থেকে ঘোরে এসে জানা যায় এসব তথ্য। সরজমিনে তাঁতীদের সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের, তারা বলেন, এখন পুঁজির অভাবে তাঁতীরা আগের মতো এ ব্যবসায়ে আর বিনিয়োগ করতে পারছেন না। বেশির ভাগ তাঁতীই এখন পুঁজি যোগাতে মহাজন ও দাদন ব্যবসায়ীদের সুদের জালে জড়িয়ে পড়েছেন। ফলে সুদ পরিশোধ করতেই চলে যাচ্ছে তাঁতীদের পুঁজির বড় অংশ। এছাড়াও জয়রামকুড়ার তাঁতশিল্পী কামাল (৪৫) জানান, পুঁজির অভাবে তার তাঁত শিল্পটি বন্ধ করে দিয়েছেন। একই অবস্থা হয়েছে গাজিরভিটা, সংড়া, রান্ধনিকুড়া, গোষবেড় গ্রামের পুরনো সেই তাঁতপাড়ায়। যা আজ হয়েছে বিলুপ্ত। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে শুরু হয়েছিল এখানে তাঁতযন্ত্রের মাধ্যমে পোশাক তৈরির কাজ। এই দুই গ্রামে প্রায় ৫ হাজার পরিবারের বসবাস। অনেক পরিবারই তাঁতের তৈরি কাপড় বুননের কাজের সঙ্গে জড়িত ছিল। তারা বলসুতা, পুরোনো সোয়েটারের উল দিয়ে কম্বল, গায়ের চাদর, গামছা, শাড়ি, মাফলারসহ আরও অনেক কিছুই তৈরি করতেন।

নানা প্রতিকূলতার স্বত্ত্বেও এখানকার ২ হাজার পরিবারের মধ্যে এখন মাত্র শতাধিক মানুষ বংশানুক্রমে এখনো তাঁত শিল্পের সাথে জড়িয়ে আছেন। তারা আগে শাড়ি-লুঙ্গি তৈরী করলেও বর্তমানে গারো আদিবাসীদের জন্যে ধকমান্দাসহ নানা ধরনের পোশাক তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। এসব তাঁতীর বাড়িতে ২ থেকে ৬ টি করে তাঁতযন্ত্র এখনও আছে। এর কোনোটা রডের চাকাওয়ালা, আবার কোনোটা একেবারেই বাঁশ-কাঠ দিয়ে তৈরী করা। সকাল থেকেই নারী-পুরুষসহ তাঁতী পরিবারের সকলে মিলে লেগে পড়েন কম্বল, গামছা, গারোদের জন্যে শাড়ি, দকমান্দা তৈরির কাজে। উত্তর মনিকুড়া গ্রামের তাঁতী শাহাদত হোসেন দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, প্রায় ২০ বছর যাবৎ তাঁতের তৈরি কাপড় বিক্রি করে সংসারের খরচ চালাচ্ছেন। কিন্তু কোনোদিন কারো কাছ থেকে কোন সাহায্য তিনি পাননি। সরকার যদি আমাদের আর্থিক সহযোগিতা করতো তাহলে সারা বছর তারা তাঁতের কাজ করে একটু ভালোভাবে পরিবারের সকলকে নিয়ে চলতে পারতো। তিনি আরো অভিযোগ করে বলেন, সুতার দাম এখন অনেক বেশি তাই তাদের এখন আর ব্যাবসা আগের মত নেই। এছাড়া মেশিনে তৈরি কাপড় অনেক কম দামে পাওয়া যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, তাদের নিজের কোন পুঁজি নাই। আর্থিকভাবে তারা এখনো স্বচ্ছল না। ঋণ নিয়ে সুতা কিনে কম্বল তৈরি করে। সরকারিভাবে কোন আর্থিক সহযোগিতা পেলে তাদের এই শিল্পকে টিকে রাখা সম্ভব হবে।

এদিকে তাঁত শিল্পের সঙ্গে জড়িত পুরনো কারিগর ফজিলা খাতুন (৪০) বলেন, তাঁত শিল্পকে বাঁচাতে হলে স্বল্প সুদে তাঁতীদের ঋণ দেয়ার মাধ্যমে এই পুরোনো দিনের তাঁত শিল্পকে হয়তো বাঁচানো যাবে। তাঁত কারিগদের নিজেস্ব কোন পুঁজি না থাকায় তারা বেশি সুদে ঋণ নিয়ে তাঁতের কাপড় তৈরি করে লাভবান হতে পারছে না। তাঁত সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল লতিফ বলেন, পুঁজির অভাবে অনেক তাঁত কারিগররা তাদের ব্যাবসা বন্ধ করে দিয়েছে। তার সময়ে মনিকুড়া ও জয়রামকুড়া ছাড়াও গাজিরভিটা এবং ধারায় অনেক তাঁতশিল্প ছিল যা বর্তমানে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তাঁতশিল্প এলাকার চেয়ারম্যান আলহাজ্ব কামরুল হাসান বলেন, আর্থিক অস্বচ্ছলতা ও সাংগঠনিক দুর্বলতার জন্যে জয়রামকুড়ার তাঁত শিল্প আজ হারিয়ে যাবার উপক্রম। বর্তমানে যদি তাঁতিদের সরকারিভাবে আর্থিক সহযোগিতার ব্যবস্থা করা হয় তাহলে তাঁত শিল্পকে আরও উন্নত ও সমবৃদ্ধি করা সম্ভব হবে বলে আশাবাদী।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এইচএআর

Wordbridge School
Link copied!