• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রাজাকারের তালিকা প্রকাশ, দেশব্যাপী সমালোচনা


বিষেশ প্রতিনিধি ডিসেম্বর ১৮, ২০১৯, ০১:২৮ পিএম
রাজাকারের তালিকা প্রকাশ, দেশব্যাপী সমালোচনা

ঢাকা : সদ্য প্রকাশিত রাজাকার তালিকা নিয়ে সারা দেশে তোলপাড় চলছে। প্রকাশিত তালিকায় অনেক স্বনামধন্য মুক্তিযোদ্ধাসহ কয়েকজন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিশিষ্ট ব্যক্তির নাম অন্তর্ভুক্ত থাকায় দেশের সচেতন মানুষের মধ্যে তালিকা তৈরির সঙ্গে জড়িতদের নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

এ ছাড়া সাধারণ জনমনেও এ তালিকা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে নানা বিতর্ক। তালিকায় প্রকাশিত অনেকেই নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধা ভাতাও পাচ্ছেন। ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে এ তালিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন মুক্তিযোদ্ধাসহ সংশ্নিষ্টদের পরিবার, স্বজন ও সাধারণ মানুষ।

গত রোববার ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে যারা পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা এবং এসব অপকর্মে জড়িত ছিল, সেসব স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকারের প্রথম তালিকা প্রকাশের পর থেকে নানা বিতর্ক শুরু হয়েছে। বেশ কিছুসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষের নাম রাজাকারের তালিকায় থাকার অভিযোগের বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক আরো জোরদার হয়েছে।

অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, প্রকাশিত রাজাকারের তালিকায় ভুলক্রমে কোনো মুক্তিযোদ্ধার নাম যুক্ত হয়ে থাকলে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে যাচাই-বাছাই করে সেসব নাম বাদ দেওয়া হবে।

এদিকে, প্রকাশিত রাজাকারের তালিকা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হওয়ায় আগামী ২৬ মার্চের আগে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রকাশের বিষয়টি একটু ধোঁয়াশার মধ্যে পড়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

ভুল বেশি হলে রাজাকারের তালিকা প্রত্যাহার : প্রকাশিত তালিকায় অনেক মুক্তিযোদ্ধার নাম চলে আসায় দুঃখ প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ভুলের পরিমাণ বেশি হলে তালিকা প্রত্যাহার করা হবে।

আর ভুলভ্রান্তির পরিমাণ কম হলে ভুলবশত যাদের নাম তালিকায় এসেছে, সে নামগুলো প্রত্যাহার করা হবে। গতকাল মঙ্গলবার শিল্পকলা একাডেমির সংগীত ও নৃত্যকলা অডিটোরিয়ামে এক অনুষ্ঠানে একথা বলেন তিনি।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী বলেন, এ তালিকার ভুলের দায় আমরা এড়াতে পারি না। যেসব অভিযোগ পাব, যাচাই করে সেসব নাম প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে।

আগামীতে যাচাই-বাছাই করে পরে তালিকা প্রকাশ করা হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও সে সময়ের সরকারি রেকর্ড দিয়েছে, নতুন কোনো তালিকা করেনি।

আবেদন করলে তালিকা থেকে ভুল নাম বাদ দেওয়া হবে : প্রকাশিত রাজাকারের তালিকায় ভুলভাবে যদি কারো নাম এসে থাকে, আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে যাচাই-বাছাই শেষে সেসব নাম বাদ দেওয়া হবে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে গতকাল এক বিবৃতিতে একথা জানানো হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা সূফি আবদুল্লাহ হিল মারুফের স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, প্রকাশিত তালিকায় অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য মন্ত্রণালয় আন্তরিকভাবে দুঃখিত। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে নতুন কোনো তালিকা প্রণয়ন করা হয়নি।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তালিকা যেভাবে পাওয়া গেছে, সেভাবেই প্রকাশ করা হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে এ তালিকায় বেশ কিছু নাম এসেছে যারা রাজাকার, আলবদর, আলশামস, শান্তি কমিটির সদস্য বা স্বাধীনতাবিরোধী নন, বরং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজন বা মুক্তিযোদ্ধা।

এ ধরনের কোনো ব্যক্তির নাম তালিকায় কীভাবে এসেছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বিষয়টি নিয়ে বিভ্রান্ত না হতে সংশ্নিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, একই নাম অনেকের থাকতে পারে। যারা চিহ্নিত মুক্তিযোদ্ধা তারা কেন রাজাকার তালিকায় আসবেন?

এ প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, আমরা তো কোনো তালিকা প্রস্তুত করিনি। তিনি বলেন, একটি মহল তালিকা বিকৃত করে ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে বিতর্ক সৃষ্টি করছে।

তালিকায় অসংগতি থাকলে সংশোধন করা হবে কি না—এ প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, আমরা নিজেরা কোনো তালিকা প্রস্তুত করিনি।

একাত্তরে পাকিস্তানিরা যে তালিকা করেছে, যাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার পর মামলা হয়েছে, আমরা শুধু তা প্রকাশ করেছি। যদি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার নাম রাজাকারের তালিকায় এসে থাকে সেটা যাচাই করে দেখা হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

অন্যদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর দালাল আইনে যেসব মামলা হয়েছিল, সেগুলোর নথিই তার মন্ত্রণালয় মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়কে সরবরাহ করেছিল। নথিতে অনেকের মামলা বাতিলের সুপারিশও ছিল। এসব পর্যালোচনা ও যাচাই করার জন্য একটি নোটও সঙ্গে দেওয়া হয়েছিল বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

তার ধারণা, যারা তালিকা তৈরির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তারা বিষয়টি হয়তো খেয়াল করেননি।

তাদের নামও রাজাকার তালিকায় : রাজাকার তালিকায় যেসব মুক্তিযোদ্ধার নাম এসেছে বলে জানা যাচ্ছে তাদের মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বেশ কজন নেতাও রয়েছেন।

এমনকি দলটির সাবেক এমপির নাম, বর্তমান একজন এমপির বাবার নামও রয়েছে তালিকায়। যেসব ব্যক্তির নাম রাজাকার তালিকায় ওঠায় বিতর্ক ও সমালোচনা হচ্ছে বেশি তাদের মধ্যে রয়েছেন যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু ও বরিশালের বাসদ নেত্রী ডা. মনীষা চক্রবর্তীর বাবা তপন কুমার চক্রবর্তী।

অনেকে তাদের নাম ওঠায় বিস্ময় প্রকাশ করে এর পেছনে ষড়যন্ত্রের সন্দেহও প্রকাশ করেছেন। রাজশাহী বিভাগে স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকায় গোলাম আরিফ টিপুসহ পাঁচজনের নাম রয়েছে। এই ছকের মন্তব্যের ঘরে লেখা আছে ‘তাদের অব্যাহতি দিতে জেলা কমিটি আবেদন করেছিল।’

অন্য চারজন হলেন— অ্যাডভোকেট মহসিন আলী, অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম, তৎকালীন জেলা প্রশাসক আবদুর রউফ ও পুলিশ কর্মকর্তা এস এস আবু তালেব। অ্যাডভোকেট মহসিন আলী ও অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক হিসেবে পরিচিত বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।

এমনকি প্রকাশিত রাজাকার তালিকায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, ভাতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নামও রয়েছে। এ ছাড়া পরিবারের সদস্যদের পাকিস্তানিরা হত্যা করেছে এমন পরিবারের সদস্যের নামও এসেছে তালিকায়।

বরিশালের গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট তপন কুমার চক্রবর্তীসহ রাজশাহীর আইনজীবী রয়েছেন এ তালিকায়। তপন কুমারের বাবা অ্যাডভোকেট সুধীর কুমার চক্রবর্তীকে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য পাকিস্তানি বাহিনী হত্যা করেছিল।

তপন কুমারের কন্যা বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) বরিশাল জেলা শাখার সদস্য সচিব ডা. মনীষা চক্রবর্তী অভিযোগ করছেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসাবশত তার বাবা ও ঠাকুরমার নাম রাজাকার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আর অ্যাডভোকেট আবদুস সালামের দুই ছেলেসহ পরিবারের ছয়জনকে ২৫ মার্চ হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী।

এভাবে বরগুনার পাথরঘাটায় মুক্তিযুদ্ধের সময় থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবুল হক, গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা আমির হামজা ওরফে রুস্তম খাঁ ও খলিলুর রহমান ওরফে মানিক, মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তাকারীর আমজাদ আলীর নাম এসেছে তালিকায়।

এ ছাড়া চট্টগ্রামের রাউজানের সাবেক সংসদ সদস্য এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরীর বাবা এ কে এম ফজলুল কবির চৌধুরীর নাম রয়েছে ঘোষিত তালিকায়।

ফজলুল কবির চৌধুরী তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের বিরোধীদলীয় নেতা ও মুক্তিযুদ্ধের সময় নানাভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেন বলে জানান স্থানীয় নেতারা। বগুড়া-আদমদীঘি উপজেলার রাজাকার তালিকায় অন্তত আটজনের নাম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সেখানকার মানুষ।

উল্লেখ্য, গত ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে রাজাকার, আলবদর, আলশামসসহ শান্তি কমিটির সদস্য ও স্বাধীনতাবিরোধী ১০ হাজার ৭৮৯ জনের তালিকা প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সরবরাহ করা নথি পর্যালোচনা করে প্রথম ধাপে এ তালিকা প্রকাশ করা হয়।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!