• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
বিশ্ব শরণার্থী দিবস আজ

রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ে বড় সংকটে বাংলাদেশ


বিশেষ প্রতিনিধি জুন ২০, ২০১৯, ১২:৩৪ পিএম
রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ে বড় সংকটে বাংলাদেশ

ঢাকা : বিশ্ব শরণার্থী দিবস আজ। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর প্রতি বছর ২০ জুন শরণার্থীদের অধিকার রক্ষায় আন্তর্জাতিক নেতৃবৃন্দের সচেতনতা সৃষ্টির জন্য বিশ্ব শরণার্থী দিবসটি পালন করে। ২০০০ সালের ৪ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০০১ সাল থেকে দিবসটি পালিত হচ্ছে। এ বছর ১১ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা কাঁধে নিয়ে বাংলাদেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব শরণার্থী দিবস।

ইউএনএইচসিআর এর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, শরণার্থী আশ্রয়দাতা দেশের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ বাংলাদেশ। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ঢল নামে। বর্তমানে নতুন-পুরনো মিলিয়ে ১১ লাখ ১৮ হাজার ৫৫৭ জন রোহিঙ্গা শরণার্থী কক্সবাজারে অবস্থান করছেন। উখিয়া ও টেকনাফে ৩২টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এসব রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ সরকার।

বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় ৬ কোটি মানুষ শরণার্থী হিসেবে বসবাস করছেন। তবে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা পৃথিবীর ইতিহাসে দ্বিতীয়। জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী ২০০১ সাল থেকে প্রতি বছর এ দিবসটি পালন করা হচ্ছে।

শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ আবুল কালাম বলেন, শরণার্থী দিবস উপলক্ষে উখিয়া ও টেকনাফে ৩২টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে খেলাধুলা, র‌্যালী, আলোচনা সভা ও রোহিঙ্গাদের জীবন চিত্র প্রর্দশনের আয়োজন করা হয়েছে।

জাতিসংঘের অন্য এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ মুহূর্তে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফে অবস্থান করছে। তাদের জন্য আশ্রয়শিবির স্থাপনে সরকার বেছে নিয়েছে টেকনাফ অভয়ারণ্য সংলগ্ন রিজার্ভ বনাঞ্চলের অংশবিশেষ।

এরই মধ্যে কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফের প্রায় চার হাজার একর পাহাড় ও সংরক্ষিত বনাঞ্চল রয়েছে। নতুন করে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের জন্য অস্থায়ীভাবে আশ্রয় শিবির স্থাপনে টেকনাফ উপজেলার কুতুপালং ও বালুখালীতে অবস্থিত সংরক্ষিত বনাঞ্চলের আরও প্রায় আড়াই হাজার একর জায়গা অধিগ্রহণ করা হয়েছে।

‘বিশ্ব শরণার্থী দিবস উপলক্ষে জাতিসংঘের সব সংস্থা কেন্দ্রীয় ও ক্যাম্প পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করবে। তবে যতদিন পর্যন্ত তারা বাংলাদেশে থাকবে, ততদিন পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের পাশে থাকবে এবং তাদের সব ধরনের সুযোগ সুবিধা দিয়ে যাবে।

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের একটি বৃহৎ অংশ ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। তাদের অর্ধেকের বেশির বয়স ১৮ বছরের নিচে, অর্ধেকের বেশি নারী ও মেয়ে শিশু এবং এক তৃতীয়াংশ পর্যন্ত পরিবারের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে বলে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের অনেকেই নিজ দেশে যৌন নির্যাতন এবং মানসিক আঘাতসহ চরম সহিংসতার মুখোমুখি হয়েছেন।

ইউএনএইচসিআর মিয়ানমার সরকারকে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করা, নাগরিকত্ব প্রদানসহ সমস্যার মূল কারণগুলো সমাধানের আহ্বান জানিয়েছে।

বড় সংকটে বাংলাদেশ : এতসংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আশ্রয়ে বিপাকে পড়েছে বাংলাদেশ। পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর তথ্য অনুযায়ী, ১৬ কোটি ৩৬ লাখ ৫০ হাজার মানুষের বসবাস এ দেশে। এর মধ্যে আবার ১১ লাখ রোহিঙ্গার আশ্রয় উন্নয়নশীল বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের একটি চাপ বলা যায়।

মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত এত বড় এই জনগোষ্ঠীর নিজ ভূমিতে ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা না থাকলেও বাংলাদেশের ভূমিতে স্থায়ী বসবাসে দিনের পর দিন জন্ম দিচ্ছে নতুন শিশু। প্রতিদিন প্রায় ৬০ থেকে ৮০ শিশুর জন্ম হচ্ছে রোহিঙ্গা শিবিরে। গত ২০ মাসে নতুন করে আসা রোহিঙ্গা শিশুর সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়েছে। বর্তমানে ২০ হাজারের ও বেশি রোহিঙ্গা নারী সন্তানসম্ভবা। এমন পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী এক বছরে বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া রোহিঙ্গা শিশুর সংখ্যা দুই লাখ ছাড়াবে।      

ইন্টার সেক্টর কোঅর্ডিনেশন গ্রুপের দেওয়া তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৬৩ শতাংশ নারী। এদের মধ্যে ১৩ শতাংশ কিশোরী এবং ২১ শতাংশ গর্ভবতী ও প্রসূতি। শিশুদের মধ্যে ৬-১৮ বছর বয়সী শিশুর হার ২৩ শতাংশ, ৫ বছরের কম বয়সী শিশুর হার ২১ শতাংশ এবং ১ বছরের কম বয়সের শিশুর হার ৭ শতাংশ।

জাতিসংঘ জানিয়েছে, বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রতিদিন অন্তত ৬০ শিশু জন্ম নিচ্ছে। বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি এডওয়ার্ড বেইগবেডার এই তথ্য জানান।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে পরবর্তী তিন মাসে মিয়ানমারে সেনা নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে আশ্রয় নেয় ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। এদের মধ্যে প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা নারী গর্ভবতী অবস্থায় বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এর আগে ১৯৬৮ সাল থেকে বাংলাদেশে আশ্রিত রয়েছে আরও অন্তত চার লাখ রোহিঙ্গা। নতুন করে অনুপ্রবেশের পর গত ২০ মাসে এখানে জন্ম নিয়েছে আরও প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গা শিশু। জানা গেছে, ক্যাম্পগুলোতে প্রতিদিন গড়ে জন্ম নিচ্ছে ৮০ থেকে ১০০ শিশু।

এত সংখ্যক শিশুর জন্ম দেশের উপর বড় ধরনের একটি চাপের প্রভাব। ভবিষ্যতে এই চাপ ভয়াবহ আকারও ধারণ করতে পারে। এরপরেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। মিয়ানমারের সঙ্গে প্রত্যাবাসন চুক্তি হলেও এই নিয়ে দেশটি নীরব ভূমিকাই পালন করে যাচ্ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ মিয়ানমারের উপর আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগের উপরই নির্ভরশীল। আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগের মাধ্যমেই রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমিতে ফেরত পাঠাতে চায় বাংলাদেশ।

কূটনীতিক ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকে অন্যথায় বাংলাদেশে জন্ম নেয়া এত সংখ্যক শিশু কিশোরদের নাগরিকত্ব নিয়ে বিপাকে পড়তে হবে।

তারা বলছেন, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া নিবন্ধনভুক্ত চার লাখ রোহিঙ্গা পরিবারে আরও এক লাখ শিশু জন্ম নিয়েছে। এছাড়া ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে যে সাত লাখ রোহিঙ্গা এসেছে এদের মধ্যেও ২ লাখ ৪০ হাজার শিশু-কিশোর রয়েছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এর এক যুগ্ম সচিব বলেছেন, রোহিঙ্গাদের শিশু জন্ম দেয়ার ব্যাপারে উৎসাহ দিচ্ছে কিছু সংখ্যক এনজিও। তারা রোহিঙ্গা শিশুদের এবং মায়েদের জন্য সামান্য পরিমাণে অর্থ বরাদ্দ দিয়ে সন্তান প্রসবে উৎসাহিত করছে।

নিজস্ব লাভের আশায় এ ধরনের উৎসাহ দিচ্ছে এনজিওগুলো। তারা মনে করছে, সন্তান হলেই তার জন্য আলাদা ভরণপোষণ পাওয়া যাবে। ফলে সরকারের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা পরিবারগুলোকে জন্ম নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হলেও তারা সেটি মানছে না।

অভিবাসন ও শরণার্থী বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে দ্রুত দিকনির্দেশনা দেওয়া উচিত। এখন যেমন প্রাপ্তবয়স্কদের বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে রেজিস্ট্রেশন করা হচ্ছে, সেভাবে বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া শিশুদেরও নিবন্ধন করা হবে কি না সে বিষয়ে সরকারকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

তিনি বলেন, বাবা-মা রোহিঙ্গা হওয়ায় এ দেশে জন্ম নেওয়া তাদের শিশুরাও স্বাভাবিকভাবেই রোহিঙ্গা বা মিয়ানমারের নাগরিক বলে বিবেচিত হবে। তারা এ দেশে জন্ম নেওয়ার সুবাদে জন্মসূত্রে বাংলাদেশি হবে না। তবে বর্তমান পরিস্থিতি একটু অন্যরকম। তারা এখানে অস্থায়ীভাবে রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে আটকেপড়া বিহারিদের নাগরিকত্ব দেওয়ার আগপর্যন্ত তাদের বিহারি হিসেবেই আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সে সুযোগ নেই, এই শিশুরা রোহিঙ্গা হিসেবেই তালিকাভুক্ত হবে।’

আসিফ মুনীর বলেন, ‘যদি কোনো কারণে তাদের এই দেশে থেকে যেতেই হয়, তাহলে সেটা অনেক পরের বিষয়। এছাড়া মিয়ানমারের সঙ্গে যদি কখনো এই বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়, তাহলে এসব শিশুর বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত হবে, তা গুরুত্ব দিতে হবে। আবার যেসব শিশু বাবা-মা ছাড়া আত্মীয় ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে এসেছে, তাদের কে গ্রহণ করবে, এসব বিষয়ও আলোচনায় থাকতে হবে। এখন পর্যন্ত মনে হয়, এই শিশুদের রোহিঙ্গা বা মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবেই দেখা হবে।’

তিনি বলেন, ‘যেসব শিশু বাংলাদেশে জন্ম নিচ্ছে, তাদের তালিকা তৈরি করা উচিত। নাগরিকত্ব নিয়ে সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত সেই তালিকা যেন বাংলাদেশের কাছে থাকে। এসব শিশুর জন্ম তারিখ, ব্লাড গ্রুপ চেক করে রাখাসহ প্রয়োজনে তথ্য থাকা উচিত।’

রোহিঙ্গা শিশুরা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পাবে কি না জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম বলেন, রোহিঙ্গা শিশুদের নাগরিকত্বের বিষয়ে এ মুহূর্তে কিছু বলা সম্ভব নয়। এটি পুরোপুরি সরকারের পলিসির ওপর নির্ভর করছে।

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও কূটনৈতিক বিশ্লেষক ওয়ালি উর রহমান বলেন, তাদের এ দেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার কোনো সুযোগ এখনো নেই। তবে এ ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকেও কোনো নির্দেশনা নেই। ফলে পুরো বিষয়টি নির্ভর করছে সরকারের পলিসির ওপর। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে নিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা না করলে আমাদের নাগরিক জীবনে ভয়াবহ চাপ পড়বে।

উখিয়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মঈনউদ্দিন বলেন, একটি ক্রাইটেরিয়া ছিল জন্ম নিবন্ধনের সার্টিফিকেটে একটি সিল থাকবে, সেখানে লেখা থাকবে তারা মিয়ানমারের নাগরিক। ওই জন্ম নিবন্ধনের কাজটাও চলছিল শুধু নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের জন্য। কিন্তু এই নিবন্ধিতদের বাইরেও কয়েক লাখ রোহিঙ্গা ছিল, যাদের বিষয়ে সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না। এবার এই রোহিঙ্গা আসার পর থেকে কক্সবাজারের পুরো জন্ম নিবন্ধন প্রক্রিয়াটাই বন্ধ রয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমরা রোহিঙ্গাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করছি আগে। এরপর সরকার যেভাবে নির্দেশনা দেবে, সেভাবেই কাজ হবে। তবে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া রোহিঙ্গা শিশুদের জন্ম নিবন্ধনের বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো ইনস্ট্রাকশন নেই।

এদিকে রোহিঙ্গা শিশুর জন্ম নিয়ে উদ্বিগ্ন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নিজেও উদ্বিগ্ন। তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে দিয়ে রোহিঙ্গা শিশুদের ওপর জরিপ করার নির্দেশ দিয়েছেন। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় এনজিওদের কার্যক্রমের ওপরও নজর রাখতে বলেছেন।

প্রধানমন্ত্রী ব্রুনাই থেকে ফিরে সংবাদ সম্মেলনেও রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে অধিক জন্মহারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, এতে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। তাই দ্রুত এদের ভাসানচরে প্রত্যাবাসনের সমর্থন আদায় করতে হবে।

কক্সবাজার পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের উপপরিচালক ডা. পিন্টু কান্তি ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, রোহিঙ্গারা যখন বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে আসে, তখন প্রথম তিন মাসে তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল ৩৪ হাজার ৪৮০ জন গর্ভবতী নারীর। তার মধ্যে বিভিন্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব হয় সাড়ে পাঁচ হাজার শিশু আর বাকিগুলো হোম ডেলিভারি হয়।

২০১৭ সালের আগস্টের পর থেকে পরবর্তী ২০ মাস রোহিঙ্গা নারীদের গর্ভধারণ হার আগের মতোই ছিল। সে হিসেবে রোহিঙ্গা নবজাতকের সংখ্যা এক লাখের কম নয়। গত কয়েক মাস আমরা জন্মনিয়ন্ত্রণ নিয়ে কাজ করার পর অনেক সচেতন হয়েছে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ। আমরা এ পর্যন্ত ৬৮ হাজার নারীকে ইনজেকশন দিয়েছি, ৬৫ হাজার নারীকে জন্মনিয়ন্ত্রণ ওষুধ দিয়েছি। এছাড়া তিন বছর মেয়াদি ও ১০ বছর মেয়াদি ইনজেকশন দিয়েছি আরও প্রায় ছয় হাজার জনকে।

অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়াচ্ছে রোহিঙ্গারা : আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীদের কেউ কেউ মাদক কারবারিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। অনেকে আবার বাংলাদেশের পাসপোর্ট বানিয়ে বিদেশ গমনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

বাংলাদেশে বসবাসকারী শরণার্থী রোহিঙ্গারা বেশির ভাগই ‘মাদক বহনকারী’ থেকে ইয়াবা ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছে। কক্সবাজার জেলায় রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় ইয়াবাসহ শরণার্থীদের আটকের সংখ্যাও দিন দিন বেড়ে চলেছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, মিয়ানমার থেকে ইয়াবা এনে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে দিচ্ছে রোহিঙ্গা নারী, কিশোর ও পুরুষরা। জেলা গোয়েন্দা পুলিশের তৈরি করা ইয়াবা কারবারিদের তালিকায়ও রয়েছে ১৩ জন নেতৃস্থানীয় রোহিঙ্গা শরণার্থীর নাম।

তবে এই তালিকায় স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ীর সংখ্যাই বেশি। এদিকে রোহিঙ্গা নেতাদের দাবি, ইয়াবা গডফাদারদের অধিকাংশ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ঘনিষ্ট বা তাদের স্বজন।

মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তারা বলছেন, মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ বাড়ার পর মেথাফেটামাইন ও ক্যাফেইনের মিশ্রণে তৈরি ‘উত্তেজক বড়ি’ ইয়াবার পাচার বেড়ে গেছে। যে কারণে ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ ও ২০১৮ সালে অনেক বেশি ইয়াবার চালান ও পাচারকারী ধরা পড়েছে। এসব মামলায় তিন বছরে ৫ হাজারের বেশি আসামি ধরা পরেছে।

সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে মাদক বিক্রি ও সেবনের আখড়া। ইয়াবা মজুতের জন্যও ব্যবহৃত হচ্ছে জনবহুল ওই ক্যাম্পগুলো। এমনকি অনেক ইয়াবা কারবারিও সেখানে আশ্রয় নিচ্ছে। এভাবেই টেকনাফ রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে ইয়াবা ব্যবসা ও পাচার বেড়ে চলছে। শুধু একটি ক্যাম্পে ইয়াবা ব্যবসা ও পাচারে জড়িত ৮০ জনের নাম স্থানীয় আনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে দেওয়া হয়েছে বলে এক রোহিঙ্গা নেতা জানিয়েছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই রোহিঙ্গা নেতা জানান, ‘গত বছরে ৩১ আগস্ট প্রকাশ্য দিবালোকে লেদার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সেচ্ছাসেবী নিরাপত্তা প্রহরী মোহাম্মদ আবু ইয়াছেরকে (২২) বুকে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। ইয়াবা-সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মাদক বহনকারী হিসেবে কাজ করতে করতে এখন ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত এমন এক রোহিঙ্গা জানান, অভাবের তাড়নায় ইয়াবা পাচারে জড়িয়ে পড়েছে তার সতের বছর বয়সী ছেলে।

তিনি বলেন, ‘এক সময় স্থানীয় এক ইয়াবা কারবারি তার ইয়াবার চালান আমার ছেলের ঘরে মজুদ রাখতো। এর বিনিময়ে তিন হাজার টাকা নিতাম। পরে কিছুদিন পর ওই ব্যবসায়ীর কাছ থেকে খুচরা ইয়াবা কিনে শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে বিক্রি করতে শুরু করে আমার ছেলে।’

তিনি জানান, ‘এক সপ্তাহ আগে চট্টগ্রামে ইয়াবার একটি চালান তার পার্টনারকে দিতে গিয়ে ছেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে যায় আমার ছেলে।’

পুলিশের ভাষ্য মতে, গত এক বছরে কক্সবাজারের নতুন আশ্রিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মাদক ও নিজেদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে ১৮ জন রোহিঙ্গা খুন হয়েছে। এ ঘটনায় রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ২৩৮টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে মাদক মামলা ৬৮টি, ৬টি ধর্ষণ মামলা হয়েছে। বাকিগুলো ডাকাতি, মারামারি, চুরি ও চোরাচালানসহ অন্যান্য। এসব মামলায় গ্রেফতার হয়েছে ১২২ জন।     

এদিকে ভুয়া তথ্য দিয়ে পাসপোর্ট বানিয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন অনেক রোহিঙ্গারা। ডিবির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ভুয়া নাম-ঠিকানা দিয়ে পাসপোর্ট বানিয়ে অনেক রোহিঙ্গা নাগরিক মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় পাড়ি জমিয়েছেন। তবে তাদের প্রকৃত সংখ্যা কত হবে, সে বিষয়টি তদন্তের পর জানা যাবে।

পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) ঢাকা নগর জোনের এসআই জাহিদ হাসান জানিয়েছেন, বিমানবন্দরে দুই রোহিঙ্গা নারী ওমরাহ পালনের উদ্দেশ্যের কথা জানিয়ে সৌদি আরব যেতে কুয়েত এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে উঠতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু বিমানে উঠার আগে তাদের আচরণে সন্দেহ হয়। পরে জিজ্ঞাসা করলে তারা অসংলগ্ন কথা বলে। তখন তাদের গ্রেফতার করা হয়।

সম্প্রতি রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকার একটি বাসা থেকে ২৩ রোহিঙ্গা নারীকে উদ্ধার করে ডিবি পুলিশ। জানা গেছে, তাদের বিদেশে পাচারের জন্য বাংলাদেশি সাজানোর প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছিল।

এই চক্রের মূল হোতা হাজি ইব্রাহিম খলিল ও আবদুস সবুর ওরফে রহিমের খোঁজে মালিবাগের একটি বাসায় অভিযান চালায় ডিবি। সেখানে পাচারচক্রের কোনো সদস্যকে পাওয়া না গেলেও ৫৪টি পাসপোর্ট উদ্ধার করা হয়। জব্দ করা ৫৪টি পাসপোর্টে বেশিরভাগ ব্যক্তিকেই চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা দেখানো হয়েছে।

এছাড়া কয়েকজনকে ফেনী, নোয়াখালী, পাবনা, গোপালগঞ্জ, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, বরিশাল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নড়াইল, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা, গাজীপুর এবং ঢাকার বাসিন্দা হিসেবে দেখানো হয়েছে।   

রোহিঙ্গাদের উদ্দেশে আরসার বার্তা : বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থী শিবিরে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে অনুসারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন মিয়ানমারভিত্তিক রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা)। শরণার্থী শিবিরে হত্যা এবং অপহরণের সঙ্গে আরসা সদস্যদের জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠার পর এক ভিডিও বার্তায় এ আহ্বান জানায় আরসা।

২০১৬ সালে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ওপর হামলার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ ঘটে আরসার। মিয়ানমারে দীর্ঘদিন ধরে নিপীড়নের শিকার রোহিঙ্গাদের স্বাধিকারের দাবিতে দেশটির সরকারি বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করে আসছে তারা।

মিয়ানমার সরকার সংগঠনটিকে সন্ত্রাসী হিসেবে দাবি করে রাখাইনের পশ্চিমাঞ্চলে ব্যাপক সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছে। ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনে আরসার হামলার পর সেনাবাহিনী কঠোর অভিযান শুরু করে। এ অভিযানের মুখে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম রাখাইন ছেড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে।

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীরা শিবিরে নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের অভিযোগও উঠেছে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে। সদস্যদের সহিংসতার খবর স্বীকার করে আরসা জানায়, তারা এ ধরনের সহিংসতা সমর্থন করে না।

টুইটারে দেয়া এক ভিডিও বার্তায় আরসা জানায়, অভিযুক্তরা শুধু বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধেই কাজ করছে না, বরং তাদের নিজেদের অপরাধের জন্য আরসাকেও কাঠগড়ায় তুলছে। তাদের কার্যকলাপের কারণে পুরো বিশ্বের সামনে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কে অপমানিত করা হচ্ছে। বিবৃতিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে আরসা।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ভারত-চীনের সহযোগিতা : রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমিতে ফেরত পাঠাতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ সরকার। এ লক্ষ্যে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের পাশাপাশি বিশ্বের ক্ষমতাধর দুই দেশ যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার সঙ্গে এ প্রসঙ্গে সংলাপ অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ। একই সঙ্গে বাংলাদেশের দুই বন্ধু রাষ্ট্র প্রতিবেশী ভারত ও চীনের সহযোগিতা পেতেও প্রচেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। তবে এক্ষেত্রে মিয়ানমারের সঙ্গে ভারত ও চীনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক থাকায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন অনেকটাই আটকে আছে।    

এ বিষয়ে মালয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের চায়না স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের গবেষক ড. সৈয়দ মাহমুদ আলী বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে চীনের দুটি স্বার্থের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, এর একটি হলো অন্যদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার পক্ষে তাদের চিরাচরিত পররাষ্ট্রনীতি - যার পাশাপাশি চীন চায় যে তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারেও অন্য কোন দেশ হস্তক্ষেপ না করুক।

"আর অপরটি হচ্ছে, তাদের কৌশলগত ও বাণিজ্যিক স্বার্থ - যার মূল কথা: তাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও তেল-গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য মালাক্কা প্রণালী ছাড়াও মিয়ানমারের ভেতর দিয়ে আরেকটি স্থলপথকে অক্ষুণ্ণ রাখা।"

চীনের এই নীতির বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়ে ড. আলি বলেন, রোহিঙ্গা প্রশ্নে তারা ২০১৭ সাল থেকেই বলে আসছে যে চীন ও বাংলাদেশের সরকারকেই আলোচনার মাধ্যমে একটা সমাধান করতে হবে - বাইরের কোন শক্তির হস্তক্ষেপ করা উচিত হবে না, কারণ তাতে সমস্যার সমাধান হবে না।

তিনি বলেন, চীনের নিজস্ব সমস্যা রয়েছে। তিব্বত বা শিনজিয়াং - এই দুই প্রদেশের অন্য জাতিগোষ্ঠীর লোক বাস করে এবং তাদের সাথে বহু দশক ধরে চীনের সংখ্যাগরিষ্ঠ হান সম্প্রদায়ের সংঘাত চলছে। চীন সরকার এই অঞ্চলগুলোকে শান্ত করার জন্য বেশ কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে।

এ নীতি দেখিয়েই তারা চাইছে, অন্য দেশগুলো চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করুক। এটা হচ্ছে একটি দিক। অন্য আরেকটি বিষয় ভুললে চলবে না যে বহু দশক ধরে মিয়ানমার চীনের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ। এর অনেক কারণ - তবে একটির কথা আমি বলতে চাই।"

সৈয়দ মাহমুদ আলির কথায়, "গত দু দশক ধরে চীনের ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ বাণিজ্য সমুদ্রপথে হচ্ছে। সেই বাণিজ্য মালাক্কা প্রণালী দিয়ে হয় এবং চীন জানে যে তার সাথে শত্রুভাবাপন্ন দেশ যুক্তরাষ্ট্র এবং তার আঞ্চলিক মিত্ররা চাইলেই চীনের বাণিজ্য বন্ধ করে দিতে পারে। এটাকেই বলে চীনের মালাক্কা সংকট।"

"এখন বাণিজ্য পথ খোলা রাখার জন্য চীন যদি সেখানে নৌবাহিনী পাঠায় - তাহলে সংকট আরো ঘনীভূত হবে - যাকে বলে চীনের মালাক্কা ডাইলেমা।"

"সেই মালাক্কা সংকটের কথা মাথায় রেখেই চীন স্থলপথে বিভিন্ন পাইপলাইনের মাধ্যমে তেল এবং গ্যাস যাতে চীনে পৌছাতে পারে- তার ব্যবস্থা করেছে। এরকম দুটি পাইপলাইন আরাকান অর্থাৎ মিয়ানমারের ভেতর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে এসে পৌঁছেছে।

ভারতেরও এ ধরণের বিনিয়োগ রয়েছে কালাদান এবং সিটওয়ে বন্দরে - কিন্তু চীনের অর্থনীতির জন্য এ দুটি পাইপলাইন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সে জন্যই চীন চাইছে না যে মিয়ানমার সরকার যেন আরাকানের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ হারায়, বা আরাকানকে কেন্দ্র করে চীন-মিয়ানমার সম্পর্ক খারাপ হোক।

অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার চীনের যে নীতি - তার সূচনা কিভাবে হয়েছিল তা ব্যাখ্যা করে ড. আলি বলেন, তিব্বতে ১৯৫৪ সালে যখন গৃহযুদ্ধ চলছিল - যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত তখন তিব্বতী যোদ্ধাদের সমর্থন দিচ্ছিল। সেই যুদ্ধ অবসানের লক্ষ্য নিয়ে চীন এবং ভারত সরকার ১৯৫৪ সালে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। সেই চুক্তিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে পাঁচটি আদর্শের কথা বলা হয়েছিল। তার প্রথমটি ছিল - কোন দেশই অন্য কোন দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে না। জাতিসংঘের সনদেও এমনটা লেখা আছে।

"১৯৫৫ সালে ইন্দোনেশিয়ার বান্দুং-এ আফ্রিকান এবং এশিয়ান দেশগুলোর এক সম্মেলনে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সূচনা হয়। সেখানেও বলা হয়েছিল, এই আদর্শগুলোকে অনুসরণ করেই জোটনিরপেক্ষ দেশগুলোকে পরস্পরের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখবে। চীন আনুষ্ঠানিকভাবে এই পাঁচটি নীতিমালা এখনো বজায় রেখেছে, সেকারণেই তারা অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে অন্তত আনুষ্ঠানিকভাবে চাইছে না। মিয়ানমারের ক্ষেত্রেও তাই প্রযোজ্য।"

তাহলে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের ক্ষেত্রে আসল চাবিকাঠি কার হাতে এমন প্রশ্নের জবাবে জবাবে সৈয়দ মাহমুদ আলি বলেন, লক্ষ্য করার বিষয় যে অন্য ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকলেও রোহিঙ্গা বা মিয়ানমার বিষয়ে তাদের নীতি মোটামুটি একই রকম।

তিনি বলেন, "বাংলাদেশ যদি আলোচনার মাধ্যমে মিয়ানমারের সাথে এ সংকটের সমাধানে আগ্রহী হয় - তাহলে আমার মনে হয় বাংলাদেশের দুটি বন্ধু রাষ্ট্র ভারত ও চীন - এই দুই রাষ্ট্রের সহযোগিতার মাধ্যমেই মিয়ানমারের সাথে আলোচনা করা সম্ভব।” কিন্তু ভারত এবং চীনকে বাদ দিয়ে এ সংকটের সমাধান সম্ভব বলে আমার মনে হয় না - বলেন তিনি।

এদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মিয়ানমার সফরে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানের পথ উন্মোচিত হবে বলে আশা করা হয়েছিল। তবে এ বিষয়ে বন্ধু রাষ্ট্র ভারত যে নিজ স্বার্থই আগে দেখবে সেটা বুঝতে হয়ত দেরিই ছিল বাংলাদেশের কাছে।

মূলত অর্থনীতি, ভূ-রাজনীতি এবং দলীয় নীতির কারণেই ভারত রোহিঙ্গাদের নিয়ে কোনো আগ্রহ দেখায়নি৷ বরং ভারতের কাছে গুরুত্ব পেয়েছে দেশের অভ্যন্তরীণ স্বার্থ৷ বিশ্লেষকরা বলছেন, রোহিঙ্গা নয়, মিয়ানমার এখন ভারতের কাছে নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ৷ তাই মিয়ানমারকে না চটিয়ে এই সফরে দেশটিকে আরো কাছে টানতে তৎপর ছিলেন মোদী৷ তিনি মিয়ানমারের ডি-ফ্যাক্টো নেত্রী অং সান সু চির সঙ্গে বৈঠক করেছেন৷ ইয়াঙ্গুনের কালীমন্দিরে গেছেন, পুজোও দিয়েছেন৷

ভারত স্বপ্ন দেখছে ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড – ত্রিদেশীয় হাইওয়ে প্রকল্প নিয়ে। আর তার জন্য প্রথম যাকে লাগবে, সেই দেশটি হলো মিয়ানমার৷ আসিয়ান জোটের দেশগুলোর সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়াতেও প্রথম যাকে ভারতের দরকার, সে দেশটিও হলো মিয়ানমার৷ বিসটেক জোটেও ভারতের সহযোগী মিয়ানমার৷ তাই ‘কানেকটিভিটি' এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে মিয়ানমার ভারতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷

বলা বাহুল্য, মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ভারতের মাথাব্যথার অন্যতম কারণ। মিয়ানমারে কায়াখফু বন্দর তৈরি করে দিচ্ছে চীন৷ এছাড়া দু'দেশের মধ্যে গ্যাস লাইন বসানোর কাজও চলছে৷

অন্যদিকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য দিয়ে ভারত প্রায় ৫০ কোটি ডলার খরচ করে ‘কালাদান মাল্টি-মোডাল ট্রান্সপোর্ট প্রোজেক্ট'-এর কাজ করছে৷ এই ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল আর বঙ্গোপসাগরের মধ্যে সরাসরি সংযোগ গড়ে তুলবে৷ ভারতের টার্গেট – বাংলাদেশ যদি কখনো ভারতকে ট্রানজিট দিতে অস্বীকার করে, তাহলে মিয়ানমারের মধ্য দিয়েই হবে ট্রানজিট৷

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক ড. শান্তনু মজুমদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মিয়ানমারকে চটানোর কোনো কারণ নেই ভারতের৷ তারা চীনের কারণে মিয়ানমারকে সঙ্গে নিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করতে চায়৷ বঙ্গোপসাগরে ভারতের বড় স্বার্থ আছে৷ আর ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্যও মিয়ানমার ভারতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ৷''

তিনি বলেন, ‘‘মিয়ানমার দীর্ঘদিন ধরেই চীনের প্রভাব বলয়ে আছে৷ ভারত চাইছে সেই প্রভাবটা হালকা করে দিতে৷ ভারতের কাছে ভূ-রাজনৈতিকভাবে মিয়ানমার গুরুত্বপূর্ণ৷ বাংলাদেশেরও গুরুত্ব আছে৷ তবে তা মিয়ানমারকে বাদ দিয়ে নয়৷ তাই মিয়ানমার নিয়ে বাংলাদেশের কোনো প্রত্যাশা আছে কিনা, মোদী সেটা মাথায় রাখার প্রয়োজন মনে করেননি৷''

অধ্যাপক মজুমদার মনে করেন, ‘বিজেপির নীতির সঙ্গেও চমৎকার মিলে গেছে মোদীর এই আচরণ৷ বিজেপি একটি সাম্প্রদায়িক দল৷ তাই মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমান নির্যাতন নিয়ে মোদীর কথা না বলাটাই স্বাভাবিক।’

অন্যদিকে ভারতের ইকনমিক টাইমস-এর ডিপ্লোম্যাটিক এডিটর দীপাঞ্জন রায় চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘মিয়ানমার সফরে নরেন্দ্র মোদী রোহিঙ্গাদের নিয়ে কথা বলেছেন৷ তবে কথাগুলো তিনি ভিন্নভাবে বলেছেন।’

দীপাঞ্জন রায় চৌধুরীর কথায়, ‘ভারত-মিয়ানমারের যৌথ সমঝোতা স্মারকটা দেখলে বোঝা যায় যে ভারত রোহিঙ্গাদের কথা একটু ঘুরিয়ে বলেছে৷ কারণ বাংলাদেশ যেভাবে দেখবে ভারতের কাছে বিষয়টি সেরকম হবে, সেটা আশা করা যায় না৷ ভারত বলেছে, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি কীভাবে করা যায় যাতে ‘মাইগ্রেশন' না হয়৷ এ নিয়ে যৌথভাবে কিছু কাজ করার কথাও হয়েছে৷ তাই উনি (মোদী) যে রোহিঙ্গাদের নিয়ে কোনো কথা বলেননি, এটা বলা ভুল।’

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কালাদান মাল্টি-মোডাল প্রজেক্ট, ত্রিদেশীয় হাইওয়ে, ভারতের উত্তর-পূর্বের সঙ্গে মিয়ানমারে আরো একটি যোগাযোগ প্রকল্প রয়েছে৷ এগুলো ২০২১ সালের মধ্যে শেষ করার তাগিদ আছে৷ এই সফরে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্তও হয়েছে।’

ভারতের বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘বঙ্গোপসাগর ছাড়াও মিয়ানমারের সঙ্গে ভারতের ১৬৪৩ কিলোমিটার স্থল সীমান্ত আছে৷ এই সীমান্ত অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ড, মণিপুর ও মিজোরাম – এই চারটি রাজ্য জুড়ে, যার অন্য প্রান্তের গহীন জঙ্গলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অনেক জঙ্গি গোষ্ঠীরই ঘাঁটি রয়েছে৷ তাই মিয়ানমারের সহযোগিতা ভারতের প্রয়োজন।’

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!