• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি ভোট অধরাই থাকল


বিশেষ প্রতিনিধি জুলাই ১৮, ২০১৮, ১১:৩৩ এএম
সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি ভোট অধরাই থাকল

ঢাকা : আরো ২৫ বছর জাতীয় সংসদে সরাসরি নির্বাচনের সুযোগ পাচ্ছেন না নারীরা। সংরক্ষিত আসনের বিধান আরো ২৫ বছর বাড়ানোয় এই সময় পর্যন্ত তাদেরকে নিজ দলের বা দলীয় শীর্ষ ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছাতেই তাদেরকে সংসদ সদস্য হতে হবে।

অথচ নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বাসি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী  লীগ সংরক্ষিত নারী আসন বাড়ানো এবং এতে সরাসরি নির্বাচনের কথা শুরু থেকেই বলে আসছিল। দলটির সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত মেয়াদে বলেছিলেন, সংরক্ষিত নারী আসন বাড়িয়ে ১০০ করা হবে এবং নারীরা সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে আসবেন। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও এর উল্লেখ আছে। অথচ তা না করে ২৫ বছরের জন্য মনোনয়নের বিধান রাখায় সরাসরি নির্বাচনের সুযোগ দীর্ঘ মেয়াদের জন্য কমে এল।

সংরক্ষিত আসনের সাংসদ, রাজনীতিক ও বিশিষ্টজনেরাই বলছেন, বিনা ভোটে সাংসদ হওয়া এই নারীরা একটি ‘ভারী’ পদ বহন করেন ঠিকই, কিন্তু এতে নারীর ক্ষমতায়নের যে উদ্দেশ্য, তা পূরণ হয় সামান্যই। সংবিধানে সংরক্ষিত নারী আসনে মনোনয়নের বিধান আরও ২৫ বছর রাখায় ধরেই নেওয়া যায়, এই সময়ের মধ্যে এই আসনগুলোয় সরাসরি নির্বাচন হচ্ছে না। এতে মাঠের রাজনীতিতে নারীদের শক্ত অবস্থান নিশ্চিত হবে না। তাঁরা বলছেন, সরাসরি নির্বাচনের বিধান থাকলে মাঠে নারীরা সক্রিয় থাকতেন। নারীদের মধ্যে প্রতিযোগিতার মানসিকতা ও দক্ষতা তৈরি হতো। তা ছাড়া এই মনোনয়নের বিধান সরকারের বিভিন্ন নীতির সঙ্গেও সাংঘর্ষিক বলে মনে করছেন তাঁরা। সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের যাঁরা সাংসদ হন,  

তাঁরা দলীয় বা দলীয় প্রধানের পছন্দের ভিত্তিতে মনোনীত হন। এ ক্ষেত্রে যোগ্যতার কোনো মাপকাঠি থাকে না। সাংসদেরা কোনো এলাকার সাংসদও থাকেন না। কাউকে কাউকে কিছু এলাকা দেওয়া হয়। তবে সেখানে নির্বাচিত একজন সাংসদ থাকায় তাঁদের কাজের সুযোগও কম থাকে। ফলে, সংসদের কাজের বাইরে আলাদা কোনো ভূমিকা রাখার তেমন কোনো সুযোগ তাঁরা পান না।

৮ই জুলাই জাতীয় সংসদে সংবিধানের সপ্তদশ সংশোধনী পাস হয়। যেখানে সংরক্ষিত নারী আসন ২৫ বছর করা হয়েছে। সময় বাড়ানো হলেও এবারও আসনসংখ্যা আগের মতোই ৫০ ও সদস্যদের নির্বাচনপদ্ধতি আগের মতোই, অর্থাৎ অনির্বাচিতই থাকছে।

এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল বলেন, জাতীয় নারীনীতিতে যে সুপারিশগুলো ছিল, সেখানে অল্প সময়ের মধ্যে সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন করার কথা। সংরক্ষিত আসনে নারীর সঙ্গেই নারীর নির্বাচন হবে; মনোনয়ন নয়। মনোনয়নের বিধান রেখে ২৫ বছর সময় বাড়ানোয় কোনোভাবেই নারীর ক্ষমতায়ন হবে না। স্বাধীনতার ৭০ বছর পরও যদি নারী মনোনীতই হয়ে আসেন, তবে এতে তাঁরা একপ্রকার ক্ষমতাহীনই রয়ে যাবেন। এ সিদ্ধান্তে নারীরা একটা পদ পাবেন, কিন্তু কোনো অবস্থানে পৌঁছাতে পারবে না। ক্ষমতায়ন তো দূরের ব্যাপার।

১৯৭২ সালের নারীদের জন্য ১৫টি সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা রাখা হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৭৮ সালে বাড়িয়ে তা ৩০ করা হয়। এরপর ৪৫ এবং সর্বশেষ সংরক্ষিত নারী আসন ৫০টি করা হয়। রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে এবং জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকারে নারীদের সরাসরি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ বাড়ানোর লক্ষ্যে ২০০৮ সালে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ আইন সংশোধন করে সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের কমিটিতে ২০২০ সালের মধ্যে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়।

২০২০ সাল আসতে আর মাত্র দেড় বছর বাকি। এরপর এই আইন কার্যকর হবে। অথচ দেড় বছর আগে সংরক্ষিত আসনে মনোনয়নের বিধান রেখে সংবিধান সংশোধন ভবিষ্যতে দলগুলোর মধ্যে এই আইন কতটা কার্যকর হবে বা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ আইনের এই ধারা সংশোধন করা হবে কি না, তা নিয়েও সন্দেহ-সংশয় প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম বলছিলেন, সংরক্ষিত নারী আসনে মনোনয়নের বিধান রেখে ২৫ বছরের সময়সীমা বাড়িয়ে বিল পাস সরকারের বিভিন্ন সময়ে দেওয়া প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে এই সরকারের দেওয়া বিভিন্ন বক্তব্য ও গৃহীত নীতি (জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি) জাতিসংঘ-ঘোষিত সিডও সনদ ও এসডিজির সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। জাতীয় নারীনীতি ২০১১-তে উল্লেখ আছে ৩৩ শতাংশ সংরক্ষিত আসন রেখে সরাসরি নির্বাচন করার বিধান রাখার।

এ ব্যাপারে নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর দুজন সদস্য বলেন, ২৫ বছরের জন্য বাড়ানো হলেও পরিস্থিতি অনুযায়ী সরাসরি নির্বাচনের বিধান যেকোনো সময় করা যায়। তাঁদের মতে, সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচনের বিধান রাখা হলে সংসদ সদস্যদের সঙ্গে সেটা সাংঘর্ষিক হতো। নারীদের জন্য বিশাল এলাকায় নির্বাচন করতে হতো।

অর্থাৎ, প্রতি তিনটি সংসদীয় আসন এলাকায় একটি সংরক্ষিত নারী আসন হতো। এত বড় এলাকায় ভোট করা একজনের জন্য কঠিন ব্যাপার। আরও কিছু সমস্যা আছে। এ কারণে সময় নেওয়া হয়েছে।

অবশ্য ক্ষমতাসীন দলের সংরক্ষিত নারী আসনের চারজন সদস্য বলেছেন, মনোনীত হয়ে আসাকে তাঁরা বড় করে দেখছেন না। এটা এক ধাপ আসা। তাঁদের লক্ষ্য ভবিষ্যতে নির্বাচনের মাধ্যমে সাংসদ হওয়া।

তাঁরা বলছেন, সংরক্ষিত নারী আসন থেকেই শিরীন শারমিন চৌধুরী প্রথমে ডেপুটি স্পিকার হয়েছিলেন। পরে নির্বাচিত হয়ে স্পিকারও হয়েছেন। তারানা হালিম প্রতিমন্ত্রীর পদ পেয়েছেন। তা ছাড়া সংসদের বিভিন্ন কমিটি ও দলে সংরক্ষিত আসনের অনেক সংসদ সদস্যই ভালো কাজ দেখাচ্ছেন।

দলটির সংরক্ষিত আসনের নারী সংসদ সদস্য ফজিলাতুন নেসা বাপ্পি বলেন, সংরক্ষিত আসনের সদস্য হয়ে তিনি নিজেকে তৈরি করছেন মূলধারায় নির্বাচিত হয়ে আসার জন্য।

সংরক্ষিত নারী আসনের মনোনীত সংসদ সদস্যরা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন না বলে উল্লেখ করেছেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন, সামাজিক প্রেক্ষাপটে সংসদে নারীদের এই কোটা রাখতে হবে। কিন্তু বর্ধিত করা কোনো সমাধান না। এই ২৫ বছর করাটাও গ্রহণযোগ্য না। এদের প্রয়োগ ও ব্যবহার কীভাবে করা যায়, তা নিয়ে ভাবতে হবে। দলে নারীদের ৩০ ভাগ কোটা রেখে সেই অনুযায়ী তাঁদের মনোনয়ন দিলে তাঁরা সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পাবেন।

তাঁর মতে, সংরক্ষিত আসনের নারী সংসদ সদস্যরা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন না। ঢাকায় থাকেন। আনুগত্যের পুরস্কার হিসেবে তাঁরা এই পদ লাভ করেন। নারীদের পেশি ও কালোটাকার শক্তি নেই। রাজনীতিতে অবস্থান দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণিতে। বড় বড় ইস্যুতে তাঁদের কোনো বক্তব্য কেউ শুনতে পায় না।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!