• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আবাসন ব্যবসা থেকে হোয়াইট হাউজে


আন্তর্জাতিক ডেস্ক  নভেম্বর ৯, ২০১৬, ০৫:২৬ পিএম
আবাসন ব্যবসা থেকে হোয়াইট হাউজে

ডোনাল্ড ট্রাম্প (জন্ম: জুন ১৪, ১৯৪৬) যুক্তরাষ্ট্রের একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী, বিশিষ্ট সামাজিক ব্যক্তিত্ব, সাহিত্যিক এবং ২০১৬ সালের আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিজয়ী প্রার্থী। তিনি দ্য ট্রাম্প অর্গানাইজেশনের পরিচালক এবং ট্রাম্প এন্টারটেইনম্যান্ট রিসোর্টের প্রতিষ্ঠাতা।

ট্রাম্প নিউইয়র্ক শহরের স্থানীয় বাসিন্দা ফ্রেড ট্রাম্পের ছেলে। রিয়েল এস্টেট ব্যবসাকে নিজের কর্মজীবন হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর পিতার যথেষ্ট অনুপ্রেরণা ছিল। ট্রাম্প পেন্সিল্‌ভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় অধীন হোয়ারটন স্কুলে অধ্যয়নের সময় তাঁর পিতার ‘এলিজাবেথ ট্রাম্প এন্ড সান’ প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। 

পরবর্তীতে ১৯৬৮ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি তাঁর পিতার প্রতিষ্ঠানের হাল ধরেন। ১৯৭১ সালে ট্রাম্প তাঁর পিতার প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করেন এবং প্রতিষ্ঠানটির নাম পরিবর্তন করে ''দ্য ট্রাম্প অর্গানাইজেশ্যান'' রাখেন। ট্রাম্প বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের রিয়েল স্টেট ব্যবসা এবং মিডিয়া তারকাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব।

ট্রাম্প জুন ১৬, ২০১৫ তারিখে রিপাবলিকান পার্টির অধীনে ২০১৬ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তাঁর মনোনয়ন প্রার্থীতা ঘোষণা করেন। ট্রাম্প তাঁর পূর্বের প্রচারণা কর্মকান্ড দিয়ে মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ এবং জনসমর্থন অর্জনে সক্ষম হন। জুলাই ২০১৫ থেকে রিপাবলিকান পার্টির জনমত নির্বাচনের মনোনয়নের ক্ষেত্রে পছন্দের দিক থেকে তিনি ধারাবাহিকভাবে প্রথম সারিতে অবস্থান করছেন। ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তিনি ২৮৯টি ইলেক্টরাল ভোট পেয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।

প্রারম্ভিক জীবনী
ডোনাল্ড জন ট্রাম্প জুন ১৪, ১৯৪৬ সালে নিউ ইয়র্ক শহরের কুইন্সে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মা ম্যারী অ্যানী একজন গৃহিণী ও লোকহিতৈষী এবং তাঁর বাবা ফ্রেড ট্রাম্প (১৯০৫-১৯৯৯) ছিলেন একজন রিয়েল স্টেট ব্যবসায়ী। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে ট্রাম্প চতুর্থ। তাঁর মা ম্যারী অ্যানি স্কটিশ দ্বীপ লিউয়িসের টং গ্রামের বাসিন্দা।
১৯৩০ সালে ১৮ বছর বয়সে তাঁর মা ম্যারী অ্যানী যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসেন এবং সেখানে তাঁর বাবা ফ্রেড ট্রাম্পের সাথে তাঁর মার পরিচয় হয়। তারা ১৯৩৬ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। ট্রাম্পের এক ভাই, রবার্ট (জন্ম: ১৯৪৮) এবং দুই বোন: ম্যারী অ্যানী (জন্ম: ১৯৩৭) এবং এলিজাবেথ (জন্ম: ১৯৪২) রয়েছে। ট্রাম্পের বোন ম্যারীঅ্যানি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারাল আদালতের একজন বিচারপতি। ট্রাম্পের আরেক ভাই ফ্রেড জুনিয়রের মৃত্যু হয়েছিল (১৯৩৮-১৯৮১) অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে।

ট্রাম্পের পিতামহ জার্মানীর অভিবাসী ছিলেন। তাঁর দাদা ফ্রেডেরিক ট্রাম্পের জার্মানীতে নিজের ‘ক্লোনডিক গোল্ড রাশ’ নামের একটি রেস্তোরাঁ ছিল। তাঁর দাদা যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হয়ে আসেন ১৮৮৫ সালে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরিবারের আসল পদবি ছিল মূলত ‘ড্রাম্পফ্‌’ কিন্তু ১৭ শতাব্দিতে এটি অপভ্রংশ হয়ে ট্রাম্প হয়ে যায়। ট্রাম্প লিখিত ১৯৮৭ সালের একটি বই, দ্য আর্ট অব দ্য ডিল গ্রন্থে ট্রাম্প ভুলবশত উল্লেখ করে ছিলেন যে তাঁর দাদু ফ্রেডেরিক ট্রাম্প একজন সুইডিশ বংশোদ্ভূত।

মূলত এই দাবি ছিল তাঁর বাবা ফ্রেড ট্রাম্পের। কিন্তু ট্রাম্প পরবর্তীকালে স্বীকার করেছিলেন যে তাঁর পূর্ব-পুরুষরা আসলে জার্মান বংশোদ্ভুত এবং তারা ১৯৯৯ সালে নিউ ইয়র্ক শহরে জার্মান-আমেরিকান স্টুবেন প্যারেডে সেনাবাহিনীর গ্র্যান্ড মার্শাল হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন।

ট্রাম্প পরিবারের দোতলা বিশিষ্ট মক ট্যুডোর রিভাইভাল আদলে একটি বাড়ি ছিল যেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্প কিউ-ফরেস্ট স্কুলে অধ্যয়নের সময় বসবাস করতেন। কিউ-ফরেস্টে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাবা ফ্রেড ট্রাম্প সম্পত্তির তত্ত্বাবধায়ক পরিষদের সদস্য ছিলেন। ১৯৮৩ সালের এক সাক্ষাৎকারে তাঁর বাবা ফ্রেড ট্রাম্প বলেছিলেন যে ‘ট্রাম্প ছেলেবেলায় ছিলেন খুবই দুরন্ত প্রকৃতির’ যার দরুন ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিউ ইয়র্ক মিলিটারি একাডেমীতে ভর্তি করিয়ে দেওয়ার জন্য তাঁকে তৎপর হতে হয়েছিল। ট্রাম্প তাঁর অষ্টম শ্রেণী এবং হাইস্কুল জীবন নিউ ইয়র্ক মিলিটারি একাডেমীতেই শেষ করেন। ২০১৫ সালে ট্রাম্প এক বায়োগ্রাফারকে বলেছিলেন যে, নিউ ইয়র্ক মিলিটারি একাডেমী তাঁকে অন্যান্য ছেলেদের চেয়েও বেশি সামরিক প্রশিক্ষণ শিখিয়েছিল।

ট্রাম্প দুই বছর অব্দি ফোর্ডহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেছিলেন। ট্রাম্প পেন্সিল্‌ভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় অধীন হোয়ার্টন স্কুল অব বিজনেসেও অধ্যয়ন করেছেন। হোয়ার্টনে অধ্যয়নের সময় ট্রাম্প তাঁর বাবার প্রতিষ্ঠান ‘এলিজাবেথ ট্রাম্প অ্যান্ড সান’ কোম্পানীতে কাজ করতেন। ট্রাম্প ১৯৬৮ সালে হোয়ার্টন বিজনেস স্কুল থেকে অর্থনীতির উপর স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।

বিশ্ববাসীকে তাক লাগালেন ট্রাম্প

আমেরিকার পয়সাওয়ালা লোক তিনি কিন্তু রাজনীতির ময়দানে তাকে একজন বহিরাগত হিসেবেই দেখা হয়। তার কাঁড়িকাঁড়ি টাকা, ম্যানহাটনে বিলিয়ন ডলারের সম্পদ এবং নিজের পকেটের টাকা খরচ করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণা করেছেন। প্রচারণা তহবিল সংগ্রহের জন্য তিনি সেভাবে ডোনারদের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন না। বা ডোনাররাও সেভাবে এগিয়ে আসেনি। কিন্তু লোকটি নিম্নআয়ের মানুষ এবং শ্বেতাঙ্গ শ্রমিক ভোটারদের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয়। তিনি হলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।

অনেক আমেরিকানই মনে করছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প হলো বহু বছরের গুমোট অবস্থা থেকে বেরিয়ে নির্মল বাতাসে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়ার অবসর। তবে অন্যরা মনে করছেন, বৈশ্বিক নিরাপত্তার জন্য তিনি খুব বিপজ্জনক লোক।

যাই হোক, আজকের এই ডোনাল্ড ট্রাম্প নিউইয়র্ক শহরতলী থেকে কীভাবে ক্ষমতাধর বিলিয়নেয়ার রিয়েল এস্টেট টাইকুন হিসেবে উঠে এলেন এবং রিপাবলিকান পার্টির মনোনয়ন ছিনিয়ে নিলেন শুধু তাই নয় সব সমলোচনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে হোয়াইট হাউজে চার বছরের জন্য জায়গা করে নিলেন- সেটাই একটু ঘেঁটে দেখার চেষ্টা এটা:

সব জরিপ মিথ্যা প্রমাণ করে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন ডোনাল্ড টাম্প। মার্কিন ভোটারদের মধ্যে ৪৮ শতাংশের সমর্থন পেয়েছেন। অনেক আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ ট্রাম্পকে চেনেন একজন ধনকুবের হিসেবে। এবার বিশ্ববাসী তাকে চিনবে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে।

রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির একেবারে কেন্দ্রে আবির্ভূত হবেন, এমনটা কেউ ভাবেনি। অভিবাসী, মুসলিম ও নারীদের নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্যের কারণে নিজের দলেই সমালোচিত ছিলেন তিনি। দেশটিতে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন দেখিয়ে নির্বাচনী দৌড়ে জয় ছিনিয়ে নেবেন তিনি, এমনটা অনেকেই ভাবতে পারেননি। এমনকি নিজ দলের অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু নির্বাচনী লড়াইয়ে সককিছুকে ছাপিয়ে গেছেন তিনি।

নিউইয়র্কের রিয়েল এস্টেট টাইকুন ফ্রেডরিক ট্রাম্পের পাঁচ সন্তানের মধ্যে চতুর্থ ডোনাল্ড। ১৯৪৬ সালের ১৪ জুন কুইন্সে তার জন্ম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী যুক্তরাষ্ট্রে শিশুজন্ম হার বেড়ে গিয়েছিল। ট্রাম্পও ছিলেন সেই ‘বেবি বুম’ এর প্রজন্ম।

রিয়েল এস্টেট ছিল তার রক্তে। বাবা ফ্রেডরিক স্থানীয় কুইন্স, স্ট্যাটান আইল্যান্ড আর ব্রুকলিন এলাকায় সাধারণ মধ্যবিত্তদের জন্য অ্যাপার্টমেন্ট বানাতেন। অভিবাসী বিরোধী হলেও ট্রাম্পের মা কিন্তু স্কটিশ বংশোদ্ভূত। ছুটিতে নিউইয়র্ক বেড়াতে এসে ফ্রেডরিকের সঙ্গে পরিচয়। তারপর বিয়ে করে আমেরিকাতেই থিতু হন।

স্কুলে বেয়াড়াপনা, সহপাঠীদের সাথে খারাপ আচরণ এবং যাকে তাকে মারধর করার ধারাবাহিক অভিযোগ আসতে থাকে বাবার কাছে। এর মধ্যে একদিন বিছানায় টিপচাকু পান বাবা। তখন ১৩ বছর বয়সী ট্রাম্পকে পাঠানো হয় মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে। অবশ্য চেহারার কারণে প্রতিবেশী ও সহপাঠীদের অনেকে তাকে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করতে ছাড়তো না।

নিউইয়র্কের মিলিটারি একাডেমি তখন কড়া নিয়মকানুনের একটি বোর্ডিং স্কুল। কিন্তু সেখানে উদীয়মান অ্যাথলেট ও ছাত্রনেতা হিসেবে নজর কাড়েন ট্রাম্প। তার নেতৃত্বে স্কুলের বেসবল টিম তখন অঙ্গরাজ্যের সেরাদের কাতারে। ১৯৬৪ সালে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেন। এর মধ্যে সিনেমায় ক্যারিয়ার গড়ার চিন্তাও করেছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত ভর্তি হন ফোর্ডহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং এর দুই বছর পর ট্রান্সফার হন পেনসিলভানিয়া ইউনিভার্সিটির হোয়ারটন স্কুল অব ফিন্যান্সে। ১৯৬৮ সালে সেখান থেকেই অর্থনীতিতে ডিগ্রি নেন।

কলেজে থাকার সময় পড়াশোনার অজুহাতে একবছর এবং পরে আরও এক বছর মেডিকেল লিভ নিয়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধে যাওয়া এড়ান ট্রাম্প। যদিও গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে বাবার কোম্পানিতে ঠিকই সময় দিয়েছেন। বাবার কাছ থেকে ১০ লাখ ডলার ধার করে নিজেই শুরু করেন রিয়েল এস্টেট ব্যবসা। বড় ভাই ফ্রেড পাইলট হওয়ার পথে গেলে বাবার ব্যবসার পুরো নিয়ন্ত্রণ চলে আসে তার হাতে। পরে নিজ দক্ষতায় ও পরিশ্রমে ব্যবসার বিস্তৃতি ঘটান।

১৯৭১ সালে ট্রাম্প কোম্পানির নাম বদলে হয় ‘ট্রাম্প অর্গানাইজেশন’। পারিবারিক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ বুঝে নেয়ার পর ব্রুকলিন ও কুইন্স থেকে প্রকল্প সরিয়ে ম্যানহাটনে বড় বড় ভবন নির্মাণে নজর দেন। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ম্যানহাটনের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা আঁচ করতে পেরে সেখানে বিনিয়োগ বাড়াতে থাকেন। বিপুল মুনাফা আসে।

এরপর ট্রাম্প গ্র্যান্ড হায়াত হোটেল নির্মাণে হাত দেন। ম্যানহাটনের গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল স্টেশনের কাছে পেন সেন্ট্রাল কোম্পানির কমোডোর হোটেল তখন লোকসানে। ১৯৭৫ সালে হায়াত হোটেল কর্পোরেশনের সঙ্গে চুক্তি করে সেখানে নতুন হোটেল নির্মাণের কাজ শুরু করেন। হায়াত চেইনের তখনো কোনো বড় হোটেল ছিল না।

১৯৮০ সালে গ্র্যান্ড হায়াত হোটেল খুলে দেয়ার পর অল্প সময়ের মধ্যে তা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। লোকসানি একটি প্রতিষ্ঠানকে ব্যবসায়িক সাফল্য এনে দেয়ায় ট্রাম্পের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৭৯ সালে ম্যানহাটনের ফিফথ অ্যাভিনিউয়ের বিখ্যাত জুয়েলারি প্রতিষ্ঠান টিফানি অ্যান্ড কোম্পানির অফিস সংলগ্ন এলাকায় জমি ইজারা নিয়ে ২০ কোটি ডলারের অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স নির্মাণে হাত দেন।

ওই কমপ্লেক্স ১৯৮২ সালে উন্মুক্ত হয়, যার নাম পরে হয় ট্রাম্প টাওয়ার। ৫৮ তলা ওই ভবনে রয়েছে ৮০ ফুট দীর্ঘ একটি কৃত্রিম ঝর্ণা। বিলাসবহুল এ ভবন ব্যবসায়ী ও সেলিব্রেটিদেরও আকর্ষণ করে। ১৯৭৭ সালে নিউজার্সিতে জুয়ার ব্যবসা বৈধতা পেলে সেখানে টাকা ঢালেন ট্রাম্প। ১৯৮০ সালে আটলান্টিক সিটিতে জমি কেনেন। হলিডে ইন কর্পোরেশনের অংশীদারিত্বে ১৯৮৪ সালে সেখানে নির্মাণ করেন ২৫ কোটি ডলারের ট্রাম্প প্লাজা। কিছুদিন পর হলিডে ইনের শেয়ার কিনে নেন এবং ওই প্লাজায় নির্মাণ করেন হোটেল ও ক্যাসিনো।

আটলান্টায় হিলটন হোটেলের ক্যাসিনো-হোটেলটিও কিনে নেন ট্রাম্প; ৩২ কোটি ডলার খরচ করে গড়ে তোলেন ট্রাম্প ক্যাসল। অল্প সময়ের মধ্যে ট্রাম্পের হাতে আসে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ক্যাসিনো হোটেল ‘তাজমহল’। ১৯৯০ সালে সেটি ‘ট্রাম্প তাজমহল’ নামে যাত্রা শুরু করে। যদিও অর্থনৈতিক সংকট ও শ্রমিক অসন্তোষের কারণে চলতি বছর ‘ট্রাম্প তাজমহল’ বন্ধের ঘোষণা দেয়া হয়।

দক্ষিণাঞ্চলে সাম্রাজ্য গড়ার সময় ট্রাম্প ফ্লোরিডার ওয়েস্ট পাম বিচেও একটি বিলাসবহুল প্রকল্পের কাজ শেষ করেন। ১৯৮৯ সালে ৩৬ কোটি ৫০ লাখ ডলারে ইস্টার্ন এয়ারলাইনস শাটলের একটি শাখা কিনে নেন, পরে যার নাম হয় ট্রাম্প শাটল। ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ ট্রাম্প ১৯৯২ সালে ওই কোম্পানি বিক্রি করে দেন।

এময় ট্রাম্প অর্গানাইজেশন যে কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রচুর পরিমাণ ঋণ নিতে থাকে যা মূল্যস্ফীতি বাড়াতে এবং ছোট ছোট আবাসন কোম্পানিকে ধসিয়ে দিতে ভূমিকা রাখে বলেও সে সময় অভিযোগ ওঠে। সেসময় ৯০ কোটি ডলার ঋণের বাধা কাটিয়ে ২শ কোটি ডলারের সম্পদ গড়ে তোলেন বলে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দাবি। তবে স্বতন্ত্র গবেষকরা ওই অংক মানতে নারাজ। তাদের ধারণা, ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ট্রাম্পের সম্পদের পরিমাণ কোনোভাবেই ৫০ কোটি ডলারের বেশি হবে না।

২০০০ সালে সুউচ্চ একটি ভবন নির্মাণে আদালতের বাধা ঠেকিয়ে দিয়ে আবারও শিরোনামে আসেন ব্যবসায়ী ট্রাম্প। ৮৫৬ ফুট উঁচু ওই ভবন নির্মাণবিধি লঙ্ঘন করছে বলে অভিযোগ ছিল। কিন্তু আদালতের রায় শেষ পর্যন্ত ট্রাম্পের পক্ষে যায়। অ্যামি অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনীত ট্রাম্প বেশ কয়েকটি বইও লিখেছেন। ট্রাম্পের প্রথম বই ‘দ্য আর্ট অব দ্য ডিলিং’। ১৯৮৭ সালের নভেম্বরে এটি প্রকাশিত হয়। এখানে তিনি তার ব্যবসায়িক সাফল্যের ‘গোপন’ তথ্য বলেছেন দাবি করেন।

৪৮ সপ্তাহের মধ্যে বইটি নিউইয়র্ক টাইমস বেস্টসেলার তালিকায় ১৩টির মধ্যে এক নম্বরে চলে আসে। এটি মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার রয়্যালটি এনে দেয়। ১৯৯০ এর দশকে মার্লা ম্যাপলের সাথে প্রেম করতে গিয়ে ধরা পড়ার পর প্রথম স্ত্রীর সাথে ডিভোর্স হয় ট্রাম্পের। তখন প্রচুর টাকা চলে যায় তার। একই সময় পশ্চিমে মহামন্দার কবলে পড়ে ট্রাম্প অর্গানাইজেশন। ট্রাম্প দুই তৃতীয়াংশ সুদ সময়মতো দিতে ব্যর্থ হন। 

বাধ্য হয়ে ১৯৯১ সালে আটলান্টিক সিটির ট্রাম্প তাজমহলকে দেউলিয়া ঘোষণা করেন। পরের বছর ট্রাম্প প্লাজাও দেউলিয়া হয়। তখন তার ব্যবসায়িক বুদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এতোদিনে মর্যাদা ধুলায় লটিয়ে পড়ার জোগার হয়। এমন একটি গল্পও চালু আছে যে, তখন রাস্তার এক ফকিরের সাথে আলোচনায় ট্রাম্প তাকে বলেন, আমার চেয়ে তোমার সম্পদ ৯০০ মিলিয়ন ডলার বেশি। এতোটাই ঋণগ্রস্ত ছিলেন ট্রাম্প। তবে ব্যবসায়িক বুদ্ধির চমক আবারো দেখিয়েছেন ট্রাম্প। তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে ঘুরে দাঁড়াতে হয়।

১৯৯০ এর দশকে দেউলিয়া হয়ে গেলেও বেশ কিছু সাহসী পদক্ষেপ নেন। বিক্রি করে দেন ব্যক্তিগত বিলাসতরী এবং ট্রাম্প এয়ারলাইন্স। ব্যাপক বিনিয়োগ করেন বিনোদন জগতে।
বিনোদন জগতে সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটান ডোনাল্ড ট্রাম্প। ১৯৯৬ সাল থেকে পরবর্তী দুই দশক তার কোম্পানির ঝুলিতে জমা পড়ে মিস ইউনিভার্স, মিস ইউএসএ ও মিস টিন ইউএসএ প্রতিযোগিতা আয়োজনের কৃতিত্ব।

এই সময় তিনি দ্বিতীয় বই ‘দ্য আর্ট অব দ্য কামব্যাক’ প্রকাশ করেন। এটিও বেস্টসেলার তালিকায় চলে আসে। দাপটের সাথে ফিরে আসেন ধনকুবের ট্রাম্প।

২০০৪ সালে এনবিসি টেলিভিশনে ‘দ্য অ্যাপ্রেন্টিস’ নামে একটি ব্যতিক্রমী রিয়েলিটি শো শুরু করেন ট্রাম্প, যেখানে প্রতিযোগীদের পুরস্কার ছিল তার প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপকের চাকরি। এখানে প্রতিযোগীদের নানা কাজে দক্ষতা প্রমাণ করতে হতো। মূলত দক্ষ কর্মী খোঁজার একটি কৌশল ছিল এটি। টানা ১৪টি সিজন ওই শো উপস্থাপনা করেন ট্রাম্প। সেই প্রতিযোগিতা তার প্রতিষ্ঠানগুলোকে ২১ কোটি ৩০ লাখ ডলার এনে দিয়েছিল। সঙ্গে পেয়ে যান টিভি সেলিব্রেটি তকমাও।

ওই সময়ই ট্রাম্পের কণ্ঠে ‘ইউ আর ফায়ারড’ ডায়ালগটি বেশ আলোচিত হয়ে ওঠে। দ্য অ্যাপ্রেন্টিস বিভিন্ন দাতব্য সংস্থার জন্য ১ কোটি ৫০ লাখ ডলার সংগ্রহ করেছিল বলেও রিপাবলিকান নির্বাচনী শিবিরের দাবি। ট্রাম্পের একটি চেইন শপের ব্যবসাও আছে- বিশ্বজুড়ে টাই থেকে শুরু করে বোতলজাত পানীয় বিক্রি করছে ওই কোম্পানি।

১৯৯৯ সালের ২৫ জুন ৯৩ বছর বয়সে মারা যান বাবা ফ্রেডারিক ক্রিস্ট ট্রাম্প। রেখে যান আড়াইশ থেকে ৩০০ মিলিয়ন ডলারের সম্পদ। তার শেষকৃত্যে সাড়ে ছয়শ মানুষ হয়েছিল। খুব ভেঙে পড়েছিলেন ট্রাম্প। তাকে সান্ত্বনা দিয়ে চিঠি লিখেছিলেন স্বয়ং জন এফ কেনেডি জুনিয়র। এর আগে ১৯৮১ সালে অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে মারা যান বড়ভাই ফ্রেড জুনিয়ন। এই সব সম্পত্তির অংশীদার হন ট্রাম্প।

প্রথম বিয়ের চার মাসের মাথায় ট্রাম্প একটি বিতর্কিত শিক্ষা ব্যবসা শুরু করেন। খোলেন ট্রাম্প ইউনিভার্সিটি। এখানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিতে সাধারণ মানুষের জন্য রিয়েল এস্টেট পড়ানোর নামে ট্রাম্পের ব্যবসায়িক সাফল্যের কৌশল পড়ানোর হতো। পড়ে তা শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে ধারাবাহিক অভিযোগের ভিত্তিতে আইনি জটিলতা ও প্রতারণা কেলেঙ্কারিতে পড়ে বন্ধ হয়ে যায়।

২০০৬ সালে যুক্তরাজ্যে বিতর্কিত হন ট্রাম্প। তিনি স্কটল্যান্ডে গিয়ে মায়ের সম্মানে একটি গল্ফ কোর্ট নির্মাণের উদ্যোগ নেন। এ সময় স্থানীয় জনগণ এবং পরিবেশবাদীদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে। তবে ২০১০ সালে তিনি এটি নির্মাণের অনুমতি পান এবং ২০১২ সালে তা উন্মুক্ত হয়।

ফোর্বসের তথ্য অনুযায়ী, এ ধনকুবেরের সম্পদের পরিমাণ বর্তমানে ৩৭০ কোটি ডলারের উপরে। ট্রাম্প অবশ্য দাবি করেন, ওই অংক কোনোভাবেই হাজার কোটি ডলারের কম হতে পারে না। ট্রাম্প এ পর্যন্ত বিয়ে করেছেন তিনবার। তার ভাষায়, প্রথম স্ত্রী চেক অ্যাথলেট ও মডেল ইভানা জেলনিকোভা উইঙ্কেল মেয়ারই ছিলেন তার কাছে সবচেয়ে ‘প্রিয়’। ট্রাম্প-ইভানা দম্পতির তিন সন্তান- ট্রাম্প জুনিয়র, ইভাঙ্কা ও এরিক। ১৯৯০ সালে তাদের বিচ্ছেদ হয়।

১৯৯৩ সালে মডেল মার্লা ম্যাপলসকে বিয়ে করেন ট্রাম্প। ছয় বছর পর ২০ লাখ ডলারের বিচ্ছেদের আগে তাদের ঘরে আসে কন্যাসন্তান টিফানি। মেলানিয়া নউসের সঙ্গে ট্রাম্পের বিয়ে হয় ২০০৫ সালে। বয়সে ২০ বছরের ছোট মেলানিয়ার ঘরে একটি ছেলে আছে ট্রাম্পের, তার নাম ব্যারন উইলিয়াম ট্রাম্প। ডোনাল্ড ট্রাম্পের নাতি-নাতনীর সংখ্যা সাত।
তিন সন্তান ডোনাল্ড জুনিয়র, ইভাঙ্কা ও এরিক ‘ট্রাম্প অর্গানাইজেশন’ এর নির্বাহী সহ-সভাপতি হিসেবে বাবাকে সাহায্য করে যাচ্ছেন। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী অবশ্য ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই।

১৯৯৯ সালে রিফর্ম পার্টির পক্ষ থেকে ২০০০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মনোনয়ন আদায় করেন। তখন বলেছিলেন অপরাহ উইনফ্রেকে রানিং মেট হিসেবে বেছে নেয়ার ঘোষণা দেন। এসময় তিনি বাজেট ঘাটতি কমাতে বিত্তবানদের উপর ১৪.২৫ শতাংশ কর আরোপের কথা বলেন। তবে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে পরে তিনি সরে দাঁড়ান।

ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার স্বপ্নের কথা প্রথম বলেন ১৯৮৭ সালে। ১৯৯৯ সালে শুরু হয় তার চেষ্টা। তবে ক্যালিফোর্নিয়া প্রাইমারিতে রিফর্ম পার্টির হয়ে বাজেভাবে হারার পর তিনি প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন। ২০০৮ সালে বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ‘বার্থার’ আন্দোলনের জনপ্রিয় মুখপাত্রে পরিণত হন ট্রাম্প। ওই আন্দোলনে ওবামার জন্মস্থান নিয়ে ধারাবাহিকভাবে প্রশ্ন তোলা হয়। ত্যক্ত বিরক্ত ওবামা এক সময় যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইয়ে তার জন্মের সপক্ষে সনদ প্রকাশ করেন।

২০১৫ সালের জুনে ট্রাম্প রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থিতা চেয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়ার মনোনয়ন দৌড়ে শামিল হন। ২০১৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে রিপাবলিকান পার্টিতে যোগ দেয়া ট্রাম্প দলের সবচেয়ে বড় দাতা ও তহবিল সংগ্রাহকে পরিণত হন।
‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ ব্যানারে ট্রাম্প আমেরিকার অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা, মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল তোলা এবং মুসলিম অভিবাসীদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে সাময়িক নিষেধাজ্ঞার কথা বলে আসছেন। নির্বাচনের আগে হিলারির সঙ্গে মুখোমুখি বিতর্কের মধ্যেই ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ আনেন বেশ কয়েকজন নারী।

এতোসব বিতর্কের কারণে ট্রাম্পের উপর থেকে সমর্থন তুলে নেন অনেক প্রভাবশালী রিপাবলিকান সিনেটর। ট্রাম্প তাদের ‘বিশ্বাসঘাতক’ আখ্যায়িত করে বলেন, নির্বাচনে জয়ী হয়ে তিনি দেখিয়ে দেবেন, ‘কী করে জিততে হয়’। তিনি সত্যি সত্যি দেখিয়ে দিলেন। তিনি এখন আর শুধু মার্কিন ধনকুবেরই নন, হিলারি ক্লিনটনকে হারিয়ে দেশটির ৪৫তম মার্কিন প্রেসিডেন্টও। তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, সিএনএন, রয়টার্স, ডোনাল্ড ট্রাম্প ডটকম ও বায়োগ্রাফি ডটকম

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি

Wordbridge School
Link copied!