• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
বিজয়ের মাস ডিসেম্বর

টগবগিয়ে ফুটছে দেহের রক্ত


নিজস্ব প্রতিবেদক ডিসেম্বর ৪, ২০১৬, ১০:২১ এএম
টগবগিয়ে ফুটছে দেহের রক্ত

চার ডিসেম্বর, ১৯৭১। শরৎ-হেমন্ত পেরিয়ে শুরু শীতের মৌসুম। গ্রামবাংলাজুড়ে শীত নামে। কিন্তু মুক্তিপাগল বাঙালির শীত নেই। হানাদারবাহিনীকে পরাজিত করতে দেহের রক্ত টগবগিয়ে ফুটছে। একাত্তরের রক্তক্ষরা এই দিনে চারদিক থেকে বীর বাঙালির বিজয়, আর পাকহানাদার বাহিনীর পরাজয়ের খবর আসতে থাকে। দেশের বিভিন্ন স্থানে পর্যুদস্ত হতে থাকে উর্দুভাষী হানাদাররা। এখন মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভারতীয় বাহিনী। প্রতিটি দিনই শত্রুর পরাজয়ের ক্ষণ গণনা চলছিল। একেকটি দিনে রচিত হচ্ছিল বাঙালির বীরত্বগাথার নতুন নতুন ইতিহাস। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও মহান মুক্তিযুদ্ধের সেসব বীরত্বগাথা আমাদের নতুন করে বাঁচার আশা জাগায়।

মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর অবস্থা এতটাই শোচনীয় হয়ে পড়ে যে, উপায়ান্তর না দেখে ঘটনা ভিন্ন খাতে পরিচালিত করতে ডিসেম্বরের ৩ তারিখ বিকেলে তারা ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এ সময় কলকাতায় অবস্থান করছিলেন। অবিলম্বে তিনি দিল্লি ফিরে যান। মধ্যরাত্রির কিছু পরে ৪ ডিসেম্বর এক বেতার বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘এতদিন ধরে বাংলাদেশে যে যুদ্ধ চলে আসছিল তা এখন ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করেছে।’

পরদিনই ভারতের সামরিক বাহিনী বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। ৪ ডিসেম্বর থেকে ভারতীয় স্থলবাহিনীর সম্মুখ অভিযান শুরু হয় চারটি অঞ্চল থেকে। এর পরই দখলদার পাক-হানাদারদের পরাজয় অনিবার্য হয়ে ওঠে। নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে পাকিস্তানিরা সশস্ত্র যুদ্ধের পাশাপাশি কূটনৈতিক যুদ্ধও শুরু করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্রের দোসর হয়ে ওঠে। কিন্তু তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অকৃপণ সহযোগিতায় সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়। ৪ ডিসেম্বর তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে প্রশ্ন তোলে। কিন্তু ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের কারণে সেই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়িত হয়নি।

একাত্তরের এই দিন সকালে নয়াদিল্লিতে প্রবাসী সরকার এবং ভারতীয় প্রতিরক্ষা দফতরের প্রধানরা আলোচনায় বসে দেখলেন, যৌথ বাহিনী ঠিক ঠিকই এগিয়েছে। প্রথমত, তারা কোথাও শহর দখলের জন্য অগ্রসর হয়নি। দ্বিতীয়ত, কোথাও পাকিস্তানি ঘাঁটির সঙ্গে বড় লড়াইয়ে আটকে পড়েনি। তৃতীয়ত, পাকিস্তানি সমরনায়করা তখনো বুঝতে পারেনি ভারতীয় বাহিনী ঠিক কোন দিক দিয়ে ঢাকায় পৌঁছতে চাইছে। বরং তখনো তারা মনে করছে, ভারতীয় বাহিনী সীমান্তের মূল পাকিস্তানি ঘাঁটিগুলোর ওপর আক্রমণ চালাবে। চতুর্থত, ব্যাপক বিমান এবং স্থল আক্রমণে শত্রু পক্ষকে একেবারে বিহ্বল করে দেয়া গিয়েছিল। পঞ্চমত, পাকিস্তানি বিমানবাহিনীকে অনেকটা ঘায়েল করে ফেলা হয়েছে। তাদের বিমান ঘাঁটিগুলোও বিধ্বস্ত। ষষ্ঠত, পাকিস্তানের প্রধান নৌবন্দরগুলো, অর্থাৎ চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, চালনা, চাঁদপুর এবং নারায়ণগঞ্জে জাহাজ বা স্টিমার ভেড়ানোর ব্যবস্থাও অনেকটা বিপর্যস্ত। সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী তাই যুদ্ধের দ্বিতীয় দিনেও একই লক্ষ্যে এগিয়ে চলল।

পশ্চিম দিক থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিফৌজের সব কয়টা গ্রুপ সামনে এগিয়ে চলল, কিন্তু কোথাও তারা সোজাসুজি পাকিস্তানি ঘাঁটিগুলোর দিকে এগুলো না। মূল বাহিনী সর্বদাই ঘাঁটিগুলোকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলল এবং ঘাঁটিতে অপেক্ষমাণ পাকিস্তানি বাহিনী যাতে মনে করে যে, ভারতীয় বাহিনী তাদের দিকেই এগিয়ে আসার চেষ্টা করছে, সেজন্য প্রতি পাকিস্তানি ঘাঁটিতে অবিরাম গুলিবর্ষণও চলতে থাকল। এ উদ্দেশ্যে প্রতি পাকিস্তানি ঘাঁটির সামনে ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর কিছু কিছু সদস্য রেখে যাওয়া হলো।

মূল ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী যে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, পাকিস্তানিরা তার খবরও পেল না। ভারতীয় বাহিনী যে যশোর, হিলি, সিলেট, কুমিল্লা, ফেনী প্রভৃতি স্থানের পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত ঘাঁটির দিকে না গিয়ে সোজা চলে যাচ্ছে, তা তারা কোনোভাবেই বুঝতে পারল না। বরং ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর গোলাবর্ষণের বহর দেখে তখনো তারা মনে করছে, ভারতীয় বাহিনী তাদের দিকেই এগোনোর চেষ্টা করছে। সেজন্য তারা তখনো মূল সড়কগুলো আগলে বসে রইল। সীমান্তের কাছাকাছি পাকিস্তানি বাহিনী তখনো অধিষ্ঠিত একমাত্র কুষ্টিয়া ছাড়া। দর্শনা যে মুহূর্তে ৪নং পার্বত্য ডিভিশনের কামানের পাল্লার মধ্যে এসে গেল পাকিস্তানিরা তখনই শহর ছেড়ে আরো পশ্চিমে পালাল।

এদিকে তখনো ভারতীয় বিমান ও নৌবাহিনীর জঙ্গি বিমানগুলো বারবার ঢাকা, চট্টগ্রাম, চালনা প্রভৃতি এলাকায় সামরিক ঘাঁটিগুলোর ওপর আক্রমণ চালাতে থাকে। ঢাকায় সেদিনও জোর বিমানযুদ্ধ হয়, কিন্তু সেদিনই প্রায় শেষ বিমানযুদ্ধ। অধিকাংশ পাকিস্তানি বিমান ঘায়েল হলো। বিমানবন্দরগুলোও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলো। আসলে সেদিনের পূর্ব পাকিস্তানে পাক বাহিনীর বিমানশক্তিও ছিল সামান্যই। তাদের তেমন কোনো যুদ্ধবিমান ছিল না। যে কয়েকটি মিগ জঙ্গি বিমান ছিল, যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে মিয়ানমার হয়ে সেগুলোকে পশ্চিম পাকিস্তানে সরিয়ে নেয়া হয়। সেইসঙ্গে কয়েকজন জেনারেলও সরে পড়েন। এরপর তাদের পরাজয় বা আত্মসমর্পণ ছিল সময়ের ব্যাপার।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এমটিআই


 

Wordbridge School

জাতীয় বিভাগের আরো খবর

Link copied!