• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
বিশ্ব মা দিবস

তুই মায়ের বমি ধরে রাখলি?


জাকিরুল আহসান মে ১৪, ২০১৭, ০৭:২৭ পিএম
তুই মায়ের বমি ধরে রাখলি?

ঢাকা: আমি ডান দিকে বসা। বাম দিকে বসা বড় আপু। সামনে পানির গ্লাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছোট আপু। মাঝখানে গা এলিয়ে বসে আছেন মা। কিছুক্ষণ আগে তাকে খাওয়ানো হয়েছে। ডাক্তার বলেছেন খাওয়ানোর পর কমপক্ষে ২০ মিনিটি বসিয়ে রাখতে। তাই প্রতিবার খাওয়ানোর পর মাকে বসিয়ে রাখি।

কিন্তু আজ যেন মা কেমন করছে। খাওয়ার পর কোনো কথা বলছে না। ২/১ মিনিট পরই মায়ের চোখ দুটি বড় হয়ে গেল, মনে হচ্ছিল এখনই দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বড় আপু ডাক্তার ডাক্তার বলে চিৎকার করতে লাগলো। মায়ের মুখ দেখে বুঝতে পারলাম, মা বমি করবেন। ডান হাতটা এগিয়ে দিলাম তার মুখের সামনে। যাতে কোনোভাবেই তার গায়ে বমি না লাগে। মা আমার হাতেই বমি করলেন।

বমি করার পর মনে হলো খারাপ কিছু ঘটছে না। চোখ দুটি স্বাভাবিক হয়ে আসলো। মায়ের মুখ ধুয়ে দিতে লাগলেন বড় ও ছোট আপু। আর মুখে বলে যাচ্ছিলেন, তুই মায়ের বমি ধরে রাখলি? এটা পারলি কেন জানিস? ছোটবেলা মা সন্তানের বমি এভাবে ধরতে পারে, তার ঘৃণা লাগে না। মা যখন বুড়ো হয়ে যায় তার বমিও ধরতে সন্তানের কষ্ট হয় না। 

আমি বললাম, ঠিক বলেছেন, আমার কোনো ঘৃণাই লাগলো না। সত্যিই কোনো ঘৃণা লাগে না। ওই হাত পরিষ্কার করে দুপুরের খাবার খেলাম। এপ্রিল মাসের শেষ দিকে ধানমন্ডির ইবনে সিনা হাসপাতালে একদিনের ঘটনা এটি।

এপ্রিলের ৩/৪ তারিখ হঠাৎ খবর এলো মা খুব অসুস্থ। ৭ এপ্রিল মাকে নিয়ে বাবা ঢাকার উদ্দেশ্যে লঞ্চে উঠলেন। খুব সকালে হাসপাতালে যেতে হবে, তাই সময় নষ্ট করতে চাইলাম না। রাত ১২টার দিকে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু ঘুম আসছে না। এপিঠ ওপিঠ করতে থাকলাম। মায়ের এমন অসুস্থতার খবর শুনে নানান চিন্তা ভিড় করলো মাথায়। কোন ডাক্তার দেখাবো, সকালে ডাক্তার পাবো কি না, মা সুস্থ হবেন কি না... ইত্যাদি। কোনোভাবেই ঘুমোতে পারলাম না। ফজরের আজান কানে আসতেই বিছানা ছাড়লাম। দ্রুত ফ্রেশ হয়ে চলে গেলাম সদরঘাট।

মা আমাক দেখেই বললেন, আমার লাশ নিবি বাবা? শুনে মনটা অনেক ছোট হয়ে গেল। বুঝলাম মা খুব বেশি অসুস্থ। বড় ভাইয়া আগেই চলে গেলেন হাসপাতালে। মাকে প্রথমে ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কল্যাণপুরে ভর্তি করা হয়। ভর্তি করানোর পর জানতে পারি মা ব্রেন স্ট্রোক করেছেন। কিন্তু ওখানে নিউরোলজির কোনো ডাক্তার নেই। একজন মিডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের তত্বাবধানে চিকিৎসা শুরু হলো। তিন দিন পর মনে হলো মায়ের অবস্থার কিছুটা অবনতি হচ্ছে। চিকিৎসার চেয়ে এখানে ইন্টার্ন শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার গুরুত্ব বেশি। মনে হলো মায়ের সঠিকভাবে চিকিৎসা হচ্ছে না। এ নিয়ে আমরা ভাই-বোন সবাই চিন্তিত।

এরই মধ্যে চতুর্থ দিন সেবিকারা (নার্স) নির্ধারিত স্যালাইন পুশ করতে ভুল যান। দিনে তিনটি বমির ইনজেকশন দেয়ার কথা, একটিও দেননি। মায়ের খিঁচুনি শুরু হলে বিষয়টি আমার ছোট বোনের কাছে ধরা পড়লো। এমনিতেই অবস্থার অবনতি, তার মধ্যে নির্ধারিত ওষুধ না পাওয়ায় মায়ের অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে গেল। আমার বোন তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। চিৎকার করে সব একজায়গায় করলো।

আমরা ওই দিন বিকেলেই মাকে ধানমন্ডির ইবনে সিনা হাসপাতালে ডাক্তার আবদুল হাই-এর তত্ত্বাবধানে নিয়ে এলাম। শুরু হলো চিকিৎসা। ডাক্তার এমআরআই রিপোর্ট দেখে জানালেন অবস্থা খুবই খারাপ। খুব বড় ধরনের স্ট্রোক করেছেন তিনি। এসব রোগী ভালো হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। জানার পর থেকে বড় বোন, ছোট বোন, ভাইয়াসহ সবাই মাঝে মাঝে কান্না করতেন। আল্লাহ যেন মাকে অন্তত বাঁচিয়ে রাখেন, সেই দোয়া করতেন সবাই। ২৬ দিন ‍চিকিৎসার পর ডাক্তার জানালেন কোনোমতে বেঁচে গেছেন মা। তবে এসব রোগীর ঝুঁকি থেকেই যায়। তারপরও মা বেঁচে আছেন এতেই যেন সবাই খুশি।

২৬টি দিন ও রাত ছিল আমাদের কাছে সমান। কোনো রাতেই একটানা ঘুম হয়নি। মায়ের স্যালাইন চলছে কি না, বমি করলো কি না, কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না, তা নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম আমরা ভাই/ বোন। এতে কখনো রাগ হয়নি মায়ের ওপর। হাসপাতাল থেকে অফিস, আবার অফিস থেকে হাসপাতাল.. এভাবেই কেটেছে আমার। আর বড় ভাইয়া ২৬ দিনে অফিস করেছেন সর্বোচ্চ ৬ দিন। মায়ের পাশেই বসে থাকতেন সারাক্ষণ। ছোট বোন ২৪ ঘণ্টা নিয়োজিত ছিলেন মায়ের সেবায়।

গত ৪ মে থেকে মা বাসায় আছেন। বিছানায় শুয়ে থাকেন, উঠে বসার মতো শক্তি নেই। সব কিছুতেই অন্যের সাহায্য নিতে হয়। এত দিন বড় বোন ছিলেন, মায়ের পাশে। মায়ের মল-মুত্র পরিষ্কার করা থেকে শুরু করে সব করতেন। ১৩ মে কর্মস্থলের ছুটি শেষ তাই বাড়িতে চলে গেছেন। এখন মূলত দেখাশোনার দায়িত্বটা আমাকেই পালন করতে হয়। সঙ্গে আমার স্ত্রী ও বড় ভাইয়া আমাকে সহায়তা করেন। মাঝে মাঝে বড় ভাবির সাহায্য নিই।

প্রতিদিন অফিস থেকে বাসায় ফিরতে রাত সাড়ে ১১টা। গিয়েই মায়ের মুখটা দেখি। এরপর নিজে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিই। মায়ের হাত-পায়ের ব্যায়াম (শরীর চর্চা) করিয়ে শুয়ে পড়ি। মায়ের খাট যেখানে, তার পাশেই ফ্লোরে আমার বিছানা। রাতে মায়ের ডাক শুনলেই লাফিয়ে উঠি। মায়ের কথা শুনি, তিনি যা বলেন তা করার চেষ্টা করি, আবার বিছানায় যাই। এভাবেই রাতে ৪/৫ বার উঠতে হয়। সকাল ৭ টায় ওষুধ, হালকা খাবার (নাকের নল দিয়ে খাওয়াতে হয়)। ১০ টার দিকে সামান্য খাবার দেয়া, ১২ টার পর শক্ত খাবার খাওয়ানো, মাথায় পানি দেয়া, ওষুধ খাওয়ানো, কিছুক্ষণ বসিয়ে রাখা। এরপর আবার শুইয়ে দেয়া- এসব করতে করতে দুপুর একটা, দেড়টা। গোসল করে অফিসের দিকে দৌড়। কোনো মতে বিকেল ৩ টার মধ্যে অফিসে পৌঁছানো।

এভাবেই যাচ্ছে দিন। মায়ের সব কাজগুলো করি, কিন্তু কষ্ট হয় না, মল-মুত্র পরিষ্কার করলেও ঘৃণা হয় না। এসব নিয়েও চিন্তা হয় না, চিন্তা হয় মা আর কতদিন এভাবে কষ্ট করবেন তা নিয়ে। তবুও স্বপ্ন দেখি মা আবার একা একা চলতে পারবেন, আবার বাবা বলে ডাকবেন। বলবেন, কী খাবি বাবা, বলতো?

সোনালীনিউজ/এন

Wordbridge School
Link copied!