• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

থামছে না বখাটের উৎপাত


নিজস্ব প্রতিবেদক অক্টোবর ২০, ২০১৬, ১০:৫১ পিএম
থামছে না বখাটের উৎপাত

আট মাসে যৌন হয়রানির ঘটনা ১৬৯টি

দেশে বিভিন্ন স্থানেই আবারও বখাটেদের উৎপাত বেড়েছে। একের পর এক ঘটছে উদ্বেগজনক ঘটনা। এসব ঘটনা বেড়ে যাওয়ার জন্য বিচারহীনতাই দায়ী বলে মনে করছেন সমাজ-বিশেষজ্ঞ ও গবেষকরা। মনোবিশ্লেষকরা বলেছেন, সমাজে যেকোনো ধরনের অসংগতি বাড়লে এ ধরনের ঘটনা বেড়ে যায়।

একের পর এক ঘটনা ঘটলেও দৃষ্টান্তযোগ্য প্রতিকার নেই কেন এ প্রশ্নে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলেছে, তাদের দিক থেকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকা হয়। যদিও মামলাগুলো তদারকির দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা থেকে মানবাধিকার সংস্থা বলেছে, যাদের আটক করা হয়, তাদের বিচারে দেরি হওয়ার সুযোগ নিয়ে নানা সামাজিক সমঝোতা করা হয়। ফলে শাস্তি নিশ্চিত করা যায় না।

রাজধানীর মিরপুরে বিসিআইসি কলেজের দুই ছাত্রীকে (যমজ বোন) গত বুধবার পিটিয়েছে বখাটেরা। হামলায় যমজ বোনের একজনের পা ভেঙে গেছে। কলেজ ছুটির পর তারা বাড়ি ফিরছিলেন। এ সময় কলেজের কাছেই বখাটেরা তাদের ‘ফার্মের মুরগি’ বলে উত্ত্যক্ত করে। দুই বোন এর প্রতিবাদ করায় বখাটেরা তাদের বাঁশ দিয়ে বেধড়ক পেটায়।

কেবল রাজধানীতেই নয়, মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে এক বখাটের প্রেম নিবেদনে সাড়া না দেয়ায় তাহমিনা আক্তার নামে এক এসএসসি পরীক্ষার্থীকে ছুরিকাঘাতে গুরুতর জখম করা হয়েছে। ওই কিশোরীকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। গত ১৮ অক্টোবর বিকেলে ওই স্কুলছাত্রীর বাড়িতে এ ঘটনা ঘটে। হামলাকারী যুবকের পরিচয় সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে তাহমিনার সহপাঠীদের কাছ থেকে জানা গেছে, তাহের নামে এক বখাটে কিছুদিন আগে তাকে প্রেম নিবেদন করেছিল।

গত ৩ অক্টোবর সিলেটে খাদিজা আক্তার নার্গিস নামে সরকারি মহিলা কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্রীকে কুপিয়ে আহত করে ছাত্রলীগ নেতা বদরুল আলম। দীর্ঘদিন ধরে সে খাদিজাকে উত্ত্যক্ত করে আসছিল। ঘটনাস্থলে উপস্থিত কেউ কেউ খাদিজাকে কোপানোর দৃশ্য মুঠোফোনে ধারণ করেন। সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

বর্তমানে খাদিজা রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ ইউনিটে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। ইতিমধ্যে তার দ্বিতীয় দফা অস্ত্রোপচার হয়েছে। বদরুল নিজের দোষ স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে।

মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার নবগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী নিতু মণ্ডলকে (১৪) বিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে গত ১৮ সেপ্টেম্বর সকালে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। সে ওই গ্রামের নির্মল মণ্ডলের মেয়ে। হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে পালানোর সময় গ্রামবাসী ঘাতক মিলন মণ্ডলকে আটক করে পুলিশে দেয়। পরে জানা যায়, মিলন মণ্ডল প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে প্রায়ই ওই স্কুলছাত্রীকে যাওয়া- আসার পথে হয়রানি করত।

এর ঠিক আগের মাসে ২৪ আগস্ট বেলা পৌনে ১২টার দিকে রাজধানীর কাকরাইলের উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের সামনে দর্জি মাস্টার ওবায়দুল খান নামের বখাটে ছুরিকাঘাত করে সুরাইয়া আক্তার রিসাকে। ইস্টার্ন মল্লিকা শপিং কমপ্লেক্সের বৈশাখী টেইলার্সে ড্রেস তৈরির অর্ডার দিতে গেলে রিসার নম্বর পায় এই বখাটে। পরে সেই রিসিট থেকে মোবাইল নম্বর নিয়ে ওবায়দুল রিসাকে ফোনে উত্ত্যক্ত করত। ফোন নম্বরটি অভিভাবকরা বন্ধ করে দিলে ওই বখাটে স্কুলে যাওয়ার পথে রিসাকে উত্ত্যক্ত করত। একপর্যায়ে ছুরি মারলে দুদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে রিসা মারা যায়।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর উপজেলার স্কুলছাত্রী কণিকা রানী ঘোষসহ তার তিন বান্ধবী চলতি বছরের ২৭ মে সকাল সোয়া ৯টার দিকে মহিপুর মোড়ে প্রাইভেট পড়ে বাড়ি ফিরছিল। এ সময় পথে মহিপুর ডিগ্রি কলেজের পাশের সড়কে বখাটে আব্দুল মালেক পেছন থেকে তাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে ধারালো অস্ত্র দিয়ে ওই চার ছাত্রীকে কোপাতে থাকে। এ সময় কণিকা রানী ঘোষ মাটিতে পড়ে গেলে তার শরীরের একাধিক স্থানে হাঁসুয়া দিয়ে আঘাত করে মালেক। এতে কণিকার ডান হাতের কবজি কেটে ঝুলে যায়। বখাটে মালেকের উপর্যুপরি হাসুঁয়ার আঘাতে অন্য তিনজন তারিন আফরোজ, মরিয়ম ও তানজিমাও গুরুতর আহত হয়। তাদের চিৎকারে স্থানীয় লোকজন ছুটে এসে তাদের উদ্ধার করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর হাসপাতালে নিয়ে আসে। এ সময় কর্তব্যরত চিকিৎসক কণিকা রানী ঘোষকে মৃত ঘোষণা করেন।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যমতে, গত আট মাসে সারা দেশে বখাটেদের উৎপাতে যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছে ১৬৯টি। এসব ঘটনায় আত্মহত্যা করেছেন তিনজন নারী। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করায় খুন হয়েছেন তিনজন ছাত্রী।

শুধু তা-ই নয়, যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করায় পাঁচজন পুরুষকেও খুন করেছে বখাটেরা। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করে লাঞ্ছিত হয়েছেন ৮২ জন নারী ও ১৬ জন পুরুষ। এসব ঘটনায় আঘাতের শিকার হয়েছেন ৫৭ জন পুরুষ। বখাটেদের উৎপাতে স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়েছে চার ছাত্রীর। এ পরিসংখ্যান শুধু পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত আট বছরে সারা দেশে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৩৮ হাজার ৪৯৮টি। এর মধ্যে যৌন নির্যাতনের ঘটনা ৫১৭টি, অপহরণের ঘটনা এক হাজার ৫৪৫, উত্ত্যক্তের শিকার হয়েছেন তিন হাজার ৭৮০ জন নারী। উত্ত্যক্তের  কারণে আত্মহত্যা করেছেন ১৩৮ জন। দেশজুড়ে বখাটেদের উৎপাত আরো ভয়ংকর।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বলেন, ‘সব ঘটনা কিন্তু পত্রিকায় আসে না। এর বাইরেও রয়েছে অসংখ্য নারী নির্যাতন ও ছাত্রী নিপীড়নের ঘটনা। বাবা-মা আত্মসম্মানের ভয়ে অনেক ঘটনা প্রকাশ করেন না। সামাজিক অপবাদ শুনতে হবে এ ভয়ে চেপে যান।

তিনি বলেন, বখাটেদের উৎপাত এখন অনেক বেড়ে গেছে। কারণ আমাদের সমাজের নৈতিক অবক্ষয় ঘটেছে। সমাজের এ ব্যাধি দূর করার জন্য অপরাধীর কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

মনোরোগ বিশ্লেষক কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময়কেন্দ্রের চিকিৎসক ডা. রায়হানুল ইসলাম বলেন, সমাজে মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে নানা ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়। যখন এ ধরনের ঘটনায় বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হবে, তখন সে মানসিকভাবে অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে এবং সে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি সহানুভূতিশীলতা হারিয়ে ফেলে।

যৌন হয়রানি ও এর সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতবিষয়ক গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের শিক্ষক জোবাইদা নাসরিন বলেন, কোনো ঘটনার পর মুহূর্তের প্রতিবাদ এবং পরে ভুলে যাওয়ায় এ ধরনের পরিস্থিতি বারবার ঘটানোর পরিপ্রেক্ষিত তৈরি হয়। তিনি বলেন, ঘটনাগুলোকে সামাজিক অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করতে না পারাই বারবার এ ধরনের সহিংস পরিস্থিতি তৈরির বড় কারণ।

উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের উপকমিশনার ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, আমাদের এখানে অপারেশনাল কাজ বা মনিটরিং হয় না। কিন্তু ওভার অল যৌন হয়রানির ঘটনা বেড়েছে।


সোনালীনিউজ/ঢাকা/আকন

Wordbridge School

জাতীয় বিভাগের আরো খবর

Link copied!