• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
গোলাই

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ব্যবহৃত ছোটদের মিনি হাতিয়ার


বাদল বিহারী চক্রবর্তী জুলাই ৫, ২০১৭, ১২:১২ পিএম
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ব্যবহৃত ছোটদের মিনি হাতিয়ার

ঢাকা : কানাডার মনট্রিল নগরীর একটি অ্যাপার্টমেন্টে পুরনো কাগজ ঘাটতে গিয়ে আলমারির মাথায় উঠিয়ে রাখা বহুদিনের পুরনো বাক্সের ভেতর একখানা গোলাই খোঁজে পেল রায়হান। বালক রায়হান রোস্তম আলীর একমাত্র অষ্টম বর্ষীয় সন্তান। কৌতুহলবশত: গোলাইটি হাতে নিয়ে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে গোলাই-এর কাঠের হাতলে লেখাটা পড়ছে সে, ‘সোহেল মেমোরিয়াল গোলাই’।

উল্লেখ্য যে, রোস্তমের স্বদেশ ভূমির নিজ গাঁয়ের আঞ্চলিক ভাষায় গুলতিকে ‘গোলাই’ বলা হয়। খানিক পরে গোলাইটি পুরনো বাক্স হতে রায়হান নিজ স্কুলের ব্যাগে সযত্নে রেখে দেয়। কানাডার কোন জায়গায় এমন জিনিসের কী কাজে ব্যবহার হয়ে থাকে, রায়হানের তা জানা নেই। সন্ধ্যায় রোস্তম অফিস থেকে ফিরে এসে হাত-মুখ ধুয়ে যখন চা পান করছিলেন, রায়হানের কৌতুহলী প্রশ্ন, আচ্ছা আব্বা, ‘সোহেল মেমোরিয়াল গোলাই মানে কি ’, ওটা কি জিনিস?

ছেলের প্রশ্নে পিতা কিছুটা স্তম্ভিত। তাৎক্ষণিকভাবে অপ্রস্তুতের মতো ছেলেকে পাল্টা প্রশ্ন করেন রোস্তম, ‘কেন, কোথায় পেয়েছো সেটা?’ রায়হান তৎক্ষণাৎ দৌড়ে গিয়ে পাশের ঘরে রাখা পড়ার ব্যাগ হতে গোলাইটি এনে পিতার হাতে তুলে দিয়ে বলে, ‘এই যে এটা আমি আজ আলমারির উপরে রাখা পুরনো বাক্সের ভেতর পেয়েছি।’

কিছুটা কম্পিত হস্তে ছেলের হাত থেকে গোলাইটি রোস্তম নিজ হাতে নেন। গোলাই-এর একবার এ-পিঠ একবার ও পিঠ দেখছেন রোস্তম। সযত্নে গোলাইখানা হাতরানোর সময় মুহূর্তের মধ্যেই দু’ফোটা অশ্রু যেন গোলাই-এর ওপর ঝরে পড়ে। আব্বা, তুমি কাঁদছো কেন? আমি কি তোমায় দুঃখ দিলাম? ছেলেকে কাছে টেনে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরেন রোস্তম। না রে বাবা, দুঃখ দাওনি তুমি। এ বড় করুণ স্মৃতি বিজড়িত গোলাই। আমি চাইনা আমার কোনো আত্মজন বা পরিচিত কেউ এ যন্ত্রটি আর ব্যবহার করুক। রোস্তম ছেলেকে সতর্কতার সুরে কথাগুলো বলে যান। কৌতুহলী ছেলে নাছোড়বান্দা। কেন, বলনা আব্বা, এর কী করুণ ইতিহাস।

শোন তাহলে, তোমার হয়তো মনে আছে, আমি মাঝে মাঝে তোমায় বলে থাকি বাংলাদেশের যুদ্ধের ইতিহাস। ১৯৭১-এর ৭ই মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানের বিশাল জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠে আহ্বান, ‘ তোমাদের যার যা’ কিছু আছে, তা-ই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল ’। শুরু হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধ তথা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ। বাংলার শহর, বন্দর, নগরের আনাচে-কানাচে এমনকি গাঁয়ের অভ্যন্তরে পাকিস্তানি কুখ্যাত সেনা বাহিনী তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকারদের সহায়তায় নির্মম অত্যাচার, বাড়ি-বাড়ি অগ্নিসংযোগ আর গণহত্যার মতো অপারেশন চালিয়ে যাচ্ছিল। বাবার কথা শেষ না হতেই বাবার কথার সমর্থনেই, রায়হান বলে, জি, তোমার মুখে মাঝে-মাঝেই শোনে থাকি দেশের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের কথা। শোনেছি তোমার ছোট মামা আর তাঁর আব্বার শহীদ হওয়ার কথা। কিন্তু গোলাই-এর সাথে মুক্তিযুদ্ধের কি সম্পর্ক। গোলাই-এর কথাতো কিছু বললে না আব্বা। রায়হানের যেন জানার পিপাসা রয়েই গেল।

চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে রোস্তম ছেলেকে শুধান, ‘বলছি, শোন, নয় মাসের যুদ্ধ চলাকালীন প্রায় এক কোটি লোক তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়। সে সময় বাঙালি রাজনৈতিক নেতা, লেখক, কবি, কলা-কুশলী, গায়ক, অভিনয়শিল্পী ও বুদ্ধিজীবিদের অনেকেই আশ্রয় নেন কলকাতায়। সেখানে তাঁদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সংগঠিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। এই সম্প্রচার কেন্দ্র হতে মুক্তিযোদ্ধা ও অসহায় বাঙালিদেরকে প্রেরণাদায়ক বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্যে তখনকার প্রখ্যাত সাংবাদিক এম.আর আক্তার মুকুলের তৈরি ও স্বকণ্ঠে পাঠ করা ‘চরম পত্র’ শোনার জন্যে মানুষ অধীর আগ্রহে রেডিওর কাছে বসে থাকতো। সাংবাদিক মুকুল সে সময় মুক্তিযোদ্ধাদেরকে ‘বিছুয়া’ আর পাকিস্তানি সেনাদেরকে ‘মছুয়া’ বাহিনী নাম দিয়েছিলেন’।

শোনে রায়হান উৎফুল্লিত হয়ে বলে ‘বাহ্,’ বেশ মজার নাম তো! ‘বিছুয়া’ আর ‘মছুয়া’। রোস্তম আরও বলেন, সে সময়কার পুরো নয় মাস আমি, আমার ছোট মামা, কাজি সোহেল রহমানের সাথেই ঘুরে বেড়াতাম। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, অসহযোগ আন্দোলন। তখন আমি ছোট মামাকে বললাম, মামা, চল আমরা বিছুয়া-মছুয়া খেলা করি। ছোট মামার বয়স ছিল প্রায় বার আর আমি তোমার মতো বয়সী।

তারপর কিভাবে খেলা করলে! রায়হানের প্রশ্ন। মামা নিজে ‘মছুয়া’ সেজে আমাকে ‘বিছুয়া’ আখ্যাটি দেয়ার মাজেজা আমি কিছুটা বড় হয়ে বুঝতে পেরেছিলাম। একদিন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে মুকুল সাহেব তাঁর চরম পত্রে ঢাকাই ভাষায় বলছেন, ‘খাইছেরে খাইছে। ঢাকার গৈবী আওয়াজ থাইক্যা জব্বর খবর আইছে। বিছুয়া বাহিনীর হাতে মাইর খাইয়া মছুয়ারা দিশাহারা হইয়া ...’। এমন রসাত্মক ও চেতনাদায়ক সম্প্রচারে মানুষ উদ্বুদ্ধ হতেন। কিন্তু গোলাই? পিতার মুখে যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস শোনার পর রায়হানের অতৃপ্ত কণ্ঠ।

হ্যাঁ সেদিন ছিল ১৭ই নভেম্বর, বেলা প্রায় বারোটা। আমরা মানে, আমি আর ছোট মামা তখন গোলাই দিয়ে মুখোমুখি যুদ্ধ খেলা শুরু করি। আমাদের বাড়ির পাশেই প্রকাণ্ড এক বহিরাঙ্গন। বৈশাখে বা অগ্রহায়ন মাসে ধান মাড়াই হয় সেখানে। রোস্তম আরও বলেন, আমাদের দু’জনের মধ্যবর্তী দূরত্ব প্রায় ৫০/৬০ মিটার বজায় রেখে মামা ও আমি ক্রলিং করার ভঙ্গিতে গোলাই দিয়ে মাটির তৈরি ছোট ছোট গোলাকার গুলি ছুড়তাম। আমাদের বয়সের তুলনায় দূরত্বটা বেশিই ছিল। তাই কারও গায়ে গুলি সজুরে লাগার ভয় ছিলনা। যেহেতু বাংলার নানা প্রান্ত থেকে বিছুয়াদের জয়লাভের খবর আর, অপরদিকে মছুয়াদের পরাজয়ের খবর আসছে প্রতিদিন, সেহেতু মামা চাননি তাঁর এ ছোট্ট ভাগ্নেটির পরাজয়। তাই, পরাজয়ের গ্লানি আমাকে না দিয়ে তিনি নিজে সেটি হজম করে নিয়েছিলেন। কিন্তু সেদিনের সে যুদ্ধ খেলা বেশিক্ষণ চলতে পারেনি।
কেন? সেদিন কি-

ছেলের কথা শেষ না হতেই রোস্তম বলতে থাকেন, ‘পাকি সেনারা এদেশীয় বাঙালি রাজাকারদের সহায়তায় প্রতিদিন গাঁয়ে গাঁয়ে অপারেশানে বের হতো। সেদিনও আমাদের গাঁয়ের তিন দিক থেকে ওরা নিরবে ঘিরে ফেলে। আমি বাবা-মার সাথে মড়া গাঙ পার হয়ে দক্ষিণ দিকে অন্য এক গাঁয়ে গিয়ে আত্মগোপন করে জীবন রক্ষা করেছিলাম। ছোট মামা, নানা-নানীর সাথে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে একটি পাহাড়ি ঝোপের পাশ দিয়ে পালাতে চাইছিলেন। কিন্তু অদৃষ্টের অলক্ষ্যে ছিল বিধির মুষ্ঠাঘাত। সেখানে সামনা-সামনি হয়ে পড়লেন পাকি সেনাদের। অনন্যোপায় হয়ে নানা-নানীর সাথে ছোট মামাও নিকটেই একটি প্রকাণ্ড পাহাড়ে চুপটি করে বসেছিলেন। কয়েক জন সৈন্য সেখানে গিয়েই নির্বিচার গুলি চালাল। সাথে-সাথেই সেই পগারে আরও তিন জনের সাথে নানা-ছোট মামাও মৃত্যুর কোলে ঢলে পরলেন। যে প্রেরণা ও চেতনায় মামা একটি গোলাই আমাকে দিয়ে অন্যটি নিজের হাতে রেখে ঘণ্টা খানেক আগেই যুদ্ধের নমুনায় মেতে ওঠেছিলেন, সেই একঘণ্টার ব্যবধানেই শুধুমাত্র একটি বুলেটের আঘাতেই প্রাণবিহীন নিথর দেহভার হয়ে পড়ে রইলেন সেই উদার বান্ধব মামা, কাজি সোহেল রহমান। গোলাইটি তখন ও তাঁর হাফপ্যান্টের পকেটেই ছিল অক্ষত অবস্থায়।

পরদিন গাঁয়ের অনেকেই মামাদের বাড়ি এসে সমাহিত করলেন নানা-মামাকে। নানার অগণিত ভক্ত ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানালেন। ফুল দিলেন মামার কবরেও। সবার মতো আমিও সেদিন বাবার সাথে নানা ও মামাকে অশ্রুসিক্ত ফুলেল বিদায় জানালাম। সেদিন ছোট মামার পকেট থেকে গোলাইখানা বের করে আর বাইরে আনতে চাননি কেহ। তাঁর ডান হাতের কাছেই রেখে দিলেন সবাই। রয়ে গেল আমার ব্যবহৃত গোলাই। সে গোলাই দিয়ে আর কী করবো, কার সাথে যুদ্ধ খেলা খেলবো? তাই, সেদিনের মামার স্মৃতিকে চির স্মরণীয় রাখার নিমিত্তেই আমার এ গোলাই-এর নাম দিয়েছিলাম ‘সোহেল মেমোরিয়াল গোলাই’। তার পর থেকে এ গোলাই এ আর হাত দিইনি। আমার হাত কেঁপে ওঠে আর দু’চোখ ছেপে জল আসে।

পিতার মুখে গোলাই-এর স্মৃতি বিজড়িত ইতিহাস শোনে বালক রায়হানের চক্ষুও ছলছল করে উঠে। অশ্রুসিক্ত চোখে রায়হান বলল, ‘ এ গোলাইটা আমি আবারও সেই পুরোনো বাক্সে উঠিয়ে রাখছি আব্বা, ওটা থাক সারা জীবনের জন্য, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে ’।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!