• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বাঙালির প্রাণের মানুষ


শরীফা বুলবুল মে ৮, ২০১৭, ১২:৪৯ পিএম
বাঙালির প্রাণের মানুষ

ঢাকা: বাঙালির শিক্ষায়, নান্দনিক বোধ, সাংস্কৃতিক চর্চায়, দৈনন্দিন আবেগ-অনুভূতির অভ্যাসেও সারাক্ষণই জড়িয়ে আছেন যুগস্রষ্টা মহামানব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আছেন নিঃশ্বাসে-বিশ্বাসে, বুদ্ধি-বোধে-মর্মে-কর্মে। তাকে পাওয়া যায় প্রেম-ভালবাসায়, প্রতিবাদে, আন্দোলনের অঙ্গীকারে এবং স্রষ্টার আরাধনার নিবিষ্টতায়। বাঙালির গৌরবময় মহান মুক্তিযুদ্ধেও পাওয়া যায় তাকে আত্মশক্তিরূপে।

সর্বমানবিকতার পথে নিরন্তর পথচলা এই যুগস্রষ্টার মানবজীবনের এমন কোনো দিক নেই, যেখানে তার উপস্থিতি নেই। বিশেষ করে বাঙালির চেতনায়, মেধা ও মননে রবীন্দ্রনাথ সর্বব্যাপী। তিনি শুধু একজন কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, গীতিকবি ও নাট্যকার-ই নন; তিনি বিশ্বভাতৃত্ববোধের অপার আধারও। তিনি সবসময় মেলাতে চেয়েছেন বৈশ্বিকসব জাতিতত্ত্বাকে, কল্যাণ চেয়েছেন সাম্প্রদায়িক ঐক্য ও মানবিক সাম্যের পথে।

কবিগুরু ‘মনুষ্যত্বের প্রতিকারহীন পরাভবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে’- অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করে মানুষকে ডাক দিয়েছেন বিশ্বভ্রাতৃত্ত্বের প্রাণময় বিস্তৃত উঠোনে। আর এমন সব কারণেই হয়তো রোমান ক্যাথলিক সন্ন্যাসী ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় তাকে ‘বিশ্বকবি’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলো। সেই উপাধিকে এখনও ধরে রেখেছেন-রাজনৈতিক দর্শন, সমাজ চিন্তা, সমকাল-ভাবনা, স্বদেশ-অন্বেষায় অতুলনীয় সব অনুঘটকে। আর তাই কালান্তরেও আজও আমাদের শংকায়-সংকটে, সম্পদে-বিপদে বারবার ফিরে যেতে হয় কবিগুরুর কাছে।

দু-চার দশক কিংবা শতাব্দীও তো নয়, জন্মের দেড়শ বছর পেরিয়ে গেছে সেই কবেই। দীর্ঘ সময় পরিক্রমায় ম্লান হয়ে গেছে কত না কিছুই! পাল্টে গেছে মানচিত্র, জন্ম নিয়েছে নতুন দেশ। কিন্তু যুগের পর যুগ পেরিয়েও রবীন্দ্রনাথ দেদীপ্যমান। অন্ধকার যতই আসুক না কেন, তার আলোর কাছে সবকিছুই ম্লান। ধ্রুপদী এই আলো পথ দেখায়, এগিয়ে নিয়ে যায়। কবিগুরু তাই প্রতিক্ষণের, প্রতিদিনের।

কবিগুরু আমাদের দিয়েছেন কথা, সুন্দর দেখার দৃষ্টি ও জন্মভূমিকে ভালোবাসার বোধ। আপন মহিমায় আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন কেমন করে বাসনা করতে হয় লালন, আশায় বাঁধতে হয় বুক এবং মানুষ ও প্রকৃতিকে করতে হয় আপন। কল্পনার প্রজ্ঞা দিয়েছেন, দিয়েছেন সৃষ্টির প্রেরণা। আর এসবের সঙ্গে রয়েছে সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের বন্দনা বাণী।

বস্তুত এজন্যই বিশ্বকবি চিরদিনই আমাদের লোক। যাকে আমরা খুঁজে পাই আনন্দের বারতায়, দুঃখের যাতনায়। খুঁজে পাই প্রেম-ভালোবাসায়, প্রতিবাদের ভাষায় আর দেশমাতৃকার জন্য আপনাকে উৎসর্গ করার ব্রত বোধে। আর তার সঙ্গে একাত্ম হয়ে আমরা আজ বলতে পারি ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমায় পরে ঠেকায় মাথা’।

কবিগুরুর গান-কবিতা, বাণী এই অঞ্চলের মানুষের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তির ক্ষেত্রে যেমন প্রভূত সাহস যুগিয়েছে; ঠিক তেমনই তার রচনাসমূহ আমাদের বাঁচতে শেখায়-স্বপ্ন দেখায়, প্রাণের সঞ্চার করে। তার লেখা ‘আমার সোনার বাংলা/ আমি তোমায় ভালোবাসি,..’ বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও প্রেরণা যুগিয়েছিল তার অনেক গান। তার লেখা ‘জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে- গানটি ভারতের জাতীয় সংগীত।

আমাদের বারবার কাছে ডাকা এই মহামনিষী-কবি হিসেবে বিশ্বব্যাপী খ্যাত হলেও ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। একাধারে একজন সংগীতজ্ঞ, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, চিত্রশিল্পী, দার্শনিক, প্রাবন্ধিক, শিক্ষাবিদ ও সমাজ সংস্কারক। পৃথিবীর সাহিত্য, সংস্কৃতি, সভ্যতা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের পরিবর্তনকে তিনি আত্মস্থ করেছিলেন।

১২৮১ বঙ্গাব্দে ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘অভিলাষ’ তার প্রথম মুদ্রিত কবিতা। এরপর থেকে কবিতা, গল্প, সাহিত্য, উপন্যাস, সমালোচনা, চিঠিপত্র, প্রবন্ধ, সংগীত, চিত্রকলা যেখানেই তিনি হাত দিয়েছেন পেয়েছেন সফলতার শীর্ষস্থান। প্রায় একক চেষ্টায় তিনি বাংলা সাহিত্যকে আধুনিকতায় উজ্জ্বল করে বিশ্বসাহিত্যের সারিতে জায়গা করে দিয়ে প্রতিভার অনন্য স্বাক্ষর হিসেবে রেখে গেছেন ৫৬টি কাব্যগ্রন্থ, ১১৯টি ছোটগল্প, ১২টি উপন্যাস, ২৯টি নাটক, ৯টি ভ্রমণ কাহিনী, প্রায় ২২৩২টি গান ও দেশ-বিদেশে দেয়া নানা বক্তৃতার মাধ্যমে।

রবীন্দ্রনাথের কাব্যসাহিত্যের বৈশিষ্ট্য ভাবগভীরতা, গীতিধর্মিতা চিত্ররূপময়তা, অধ্যাত্মচেতনা, ঐতিহ্যপ্রীতি, প্রকৃতিপ্রেম, মানবপ্রেম, স্বদেশপ্রেম, বিশ্বপ্রেম, রোমান্টিক সৌন্দর্যচেতনা, ভাব, ভাষা, ছন্দ ও আঙ্গিকের বৈচিত্র্য, বাস্তবচেতনা ও প্রগতিচেতনা। রবীন্দ্রনাথের গদ্যভাষাও কাব্যিক। ভারতের ধ্রুপদি ও লৌকিক সংস্কৃতি এবং পাশ্চাত্য বিজ্ঞানচেতনা ও শিল্পদর্শন তার রচনায় গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। কথাসাহিত্য ও প্রবন্ধের মাধ্যমে তিনি সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে নিজ মতামত প্রকাশ করেছিলেন। সমাজকল্যাণের উপায় হিসেবে তিনি গ্রামোন্নয়ন ও গ্রামের দরিদ্র জনসাধারণকে শিক্ষিত করে তোলার পক্ষে মতপ্রকাশ করেন। এর পাশাপাশি সামাজিক ভেদাভেদ, অস্পৃশ্যতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধেও তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের দর্শনচেতনায় ঈশ্বরের মূল হিসেবে মানব সংসারকেই নির্দিষ্ট করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ দেববিগ্রহের পরিবর্তে কর্মী অর্থাৎ মানুষ ঈশ্বরের পূজার কথা বলেছিলেন। সংগীত ও নৃত্যকে তিনি শিক্ষার অপরিহার্য অঙ্গ মনে করতেন। রবীন্দ্রনাথের গান তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি।

আজ থেকে ১৫৬ বছর আগে ১২৬৮ বঙ্গাব্দের পঁচিশে বৈশাখ এবং ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ৬ মে (বাংলা বর্ষপঞ্জি পরিবর্তনে এখন বাংলাদেশে ৮ মে) কলকাতার জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যিনি জীবন ধরে কোটি কোটি বাঙালির স্বপ্ন আর হৃদয়ের আবেগ স্পন্দিত করে তুলেছেন তার বিপুল সাহিত্যকর্মে। যার সৃষ্টিতে ঠাঁই পেয়েছে প্রেম-বিরহ-প্রকৃতি-সংগ্রাম-মানুষের জীবনের খুঁটিনাটি সব বিষয়। তাই বাঙালির মন-মনন, চিন্তা-অভিব্যক্তিজুড়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ। হয়ে উঠেছেন বাঙালির প্রাণের মানুষ।

রবীঠাকুর

বিশ্বকবি বাঙালির জীবনে অপরিহার্য ও অবিচ্ছেদ্য এক অংশ। ভৌগলিক সীমা ছাড়িয়ে তার সৃষ্টি জায়গা করে নিয়েছে বিশ্ব দরবারে। তার সৃষ্টির আলোয় আলোকিত শুধু বাংলাদেশ নয়, সমগ্র বিশ্ব-জগৎ।

অথচ এই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে এখনও চলছে নানা ধরনের অপপ্রচার। এই অপপ্রচারের শুরুটা হয়েছিল পাকিস্তান আমলে। পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী চেয়েছিলো বাঙালির জাতিস্বত্তাবোধকে দমিয়ে রেখে চিরকালধরে শোষণ করতে। এরই কৌশল হিসেবে বাঙালির দৈনন্দিন আবেগ-অনুভূতির অভ্যাসের সাথে জড়িয়ে যাওয়া কবি রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল।

কবির বিরুদ্ধে পাকিস্তানী শোষকদের অভিযোগ ছিলো, তিনি হিন্দু। অবাক করা বিষয় হলো- পাকিস্তানীরা সেই সময়ে যেভাবে ‘কবিকে-প্রজাপীড়ক জমিদার, শোষক শ্রেণীর প্রতিভূ, মুসলমানবিদ্বেষী, ভাষা সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাসী ইত্যাদি’-হীন প্রচারণা চালিয়ে বাঙালি বিভক্ত করতে উঠে পড়ে লেগে ছিলেন। ঠিক সেইভাবে একাত্তরের পরপরই (এদেশীয় কিছু কুলঙ্গার) বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশকালকে রুদ্ধ করার জন্য এই অপপ্রচারগুলো মিথ হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে। পঁচাত্তরের পরে কবিগুরু বিরুদ্ধে এই অপপ্রচার আরও বৃদ্ধি পায়। এখনও এই অপপ্রচার থেমে নেই।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক

সোনালীনিউজ/এন

Wordbridge School
Link copied!