• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০
মানছে না নিয়ম

বেপরোয়া চালক কেড়ে নিচ্ছে তাজা প্রাণ


বিশেষ প্রতিনিধি ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০১৭, ০৬:৩৮ পিএম
বেপরোয়া চালক কেড়ে নিচ্ছে তাজা প্রাণ

ঢাকা: প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটছে। এতে পঙ্গুত্ব বরণ করছেন শত শত মানুষ। অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানো, মাত্রার চেয়ে বেশি মালামাল বহন এবং ওভারটেকিং-ই এসব দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ।

মোটরযান আইন অনুযায়ী মহাসড়কে যানবাহনের সর্বোচ্চ গতিসীমা ৮০ কিলোমিটার নির্ধারণ করে দিয়েছে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল। শহর ও লোকালয়ের সড়কগুলোতে এ গতিসীমা সর্বোচ্চ ৪০ কিলোমিটার। এজন্য যানবাহনগুলোতে গতি নিয়ন্ত্রক যন্ত্র (স্পিড গভর্নর) রাখাও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এ যন্ত্রের ওপর নির্ভর করেই মোটরযানের ফিটনেস সনদ দেয়া হয়। চালকদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে ২৪৩টি ব্ল্যাকস্পটে। চালকদের প্রশিক্ষণ দিতে বলা হয়েছে। এমনকি দুর্ঘটনার জন্য শাস্তিরও বিধান রয়েছে।

কিন্তু এসব নিয়ম-কানুনের কিছুই মানছেন না যান মালিক ও চালকরা। নির্বিঘ্নে ফিটনেসবিহীন গাড়ি নামছে পথে। অনভিজ্ঞ চালককে নিয়োগ দিচ্ছেন মালিকপক্ষ। অন্য বাসের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে এবং দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছাতে ৮০ কিলোমিটার গতির জায়গায় ১২০ কিলোমিটার পর্যন্ত গতিতে চলছে গাড়ি। সড়কের বাঁক সোজাকারণ ও সক্ষমতা অনুযায়ী সড়ক সম্প্রসারণেও সরকারের কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। এমনকি যাত্রী-পথচারীরাও চলাচলে অসতর্ক। ফলে সড়কপথে দুর্ঘটনা কমানো যাচ্ছে না। থামছে না মৃত্যুর মিছিল।

পরিসংখ্যান বলছে, গত বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে দেশে মোট ২০৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ২৪৭ যাত্রী। আহত হন ৩৭২ জন। অথচ মাত্র এক বছরের ব্যবধানে চলতি বছর সে সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। শুধু জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ছিল ২২৬টি এবং তাতে প্রাণ হারান ৩৭৪ জন। আহত হন ৯১৫ জন। এর আগে গত দুই ঈদযাত্রায় দৈনিক গড়ে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৫ জন।

সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সরকার কী করছে বা করণীয় কী-জানতে চাইলে দুর্ঘটনা রোধে নিজেদের অক্ষমতার কথা স্বীকার করলেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এম এ এন সিদ্দিক। তিনি বলেন, বেপরোয়া গাড়ি চালানো বন্ধে ও অতিরিক্ত ট্রিপ বন্ধে রাজধানীর টার্মিনালগুলোতে গত দুই ঈদের আগেও অভিযান চালানো হয়েছিল। কিন্তু তাতে সফলতা হওয়া যায়নি। সাম্প্রতিক দুর্ঘটনায় পড়া যানবাহনের মালিক ও চালককে বিআরটিএতে (বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি) ডাকা হয়েছে। দোষী ব্যক্তিদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।

কিন্তু দুর্ঘটনা কমাতে সরকারের সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য নেই বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক। তিনি বলেন, এভাবে দুর্ঘটনা কমানো যায় না। সড়ক দুর্ঘটনার প্রকৃত তথ্যই তো দেশে কারো কাছে নেই। বাংলাদেশের জনসংখ্যার ঘনত্ব খুব বেশি। পথচারীরা এখন ঝুঁকির শেষ সীমানায়। দিন দিন জনসংখ্য ও গাড়ি যত বাড়বে, দুর্ঘটনার আশঙ্কাও তত বাড়বে।

বাড়ছে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি : জাতিসংঘ ২০১১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এক দশকে সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস দশক হিসেবে ঘোষণা করেছে। এ সংক্রান্ত নথিতে সইও করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু কমছে না সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি। উল্টো উদ্বেগজনক হারে তা বেড়েই চলছে। এমনকি দেশের অভ্যন্তরীণ রেকর্ড ভেঙে বাংলাদেশের সড়কগুলো এখন হয়ে উঠেছে এশিয়ায় অন্যতম প্রাণঘাতী। বাংলাদেশে যানবাহন কম হলেও দুর্ঘটনা বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৫ সালের প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতি বছর ২১ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়। 

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট-এআরআই) হিসাবমতে, সর্বশেষ গত ঈদুল আজহার আগে ও পরের ১০ দিনে ৫৮টি দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ১৩১ জন। আর বাংলাদেশে যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্যমতে, প্রায় একশটি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। নিহত হয়েছেন প্রায় ২৫০ জন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণা অনুযায়ী, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির দিক থেকে এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। বাংলাদেশের ওপরে আছে চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম। কিন্তু এই দেশগুলোর প্রতিটিতে যানবাহনের সংখ্যা বাংলাদেশের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। আর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম।

দুর্ঘটনার ১১ কারণ ও ৪ অনুষঙ্গ : নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট ও ব্র্যাকের গবেষণাগুলো দুর্ঘটনার জন্য ১১ কারণ ও চারটি অনুষঙ্গ চিহ্নিত করেছে। কারণগুলো হলো- বেপরোয়া গাড়ি চালানো, চালকের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের অভাব, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, একই সড়কে বিভিন্ন গতির যান চলাচল, সড়কের ধারে ঝুঁকিপূর্ণ কর্মকাণ্ড, সড়কের নকশায় ত্রুটি, ট্রাফিক আইনের দুর্বল প্রয়োগ ও সড়ক-মহাসড়কে ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালনে উদাসীনতা, সড়ক নিরাপত্তার বিষয়ে সচেতনতার অভাব ও পথচারীর ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ, চালকের অন্যমনস্কতা, দুর্ঘটনা ঘটিয়ে চালকদের পার পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি ও অপ্রতুল শাস্তির বিধান, মোটরযান আইনের দুর্বলতা ও অনুপযুক্ত সড়ক। অনুষঙ্গ চারটি- চালক, যানবাহন, সড়ক ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ।

এ ব্যাপারে অধ্যাপক ড. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, বর্তমানে মহাসড়কগুলোতে ভারী যানবাহন বেড়ে যাওয়ায় গাড়িগুলোর আয়তন বাড়ছে। কিন্তু সড়কের স্থান বাড়ছে না। সড়কের বাঁকগুলো সঠিক না হওয়া, বাঁকের অপর পাশের কিছু না দেখতে পাওয়া, স্পিড ব্রেকার বা সড়কের সাইনগুলো না থাকাও সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। দেশের হাইওয়েগুলোর সঠিক মান নেই। হাইওয়েগুলো দুই লেনের হওয়াতে ওভারটেক করতে গিয়ে অন্য দিকের গাড়ির সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটছে।

বিআরটিএর তথ্য অনুযায়ী, দেশে ভারী যানবাহনের প্রায় আড়াই লাখ চালক রয়েছেন। এর মধ্যে ১ লাখ ৯০ হাজার লাইসেন্স পেয়েছেন পরীক্ষায় অংশ না নিয়ে। একইভাবে বাংলাদেশে নিবন্ধিত প্রায় ২৭ লাখ যানবাহনের মধ্যে অন্তত ৪ লাখের ফিটনেস সনদ নেই। আর সনদভুক্ত যানগুলোও সনদ পেয়েছে পরিদর্শন বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই। আর পারিপার্শ্বিক অবস্থার মধ্যে রয়েছে অসম গতির যান ও গ্রামীণ সড়ক হঠাৎ করে মহাসড়কের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়াও দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট, এআরআই) পরিচালক সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, দুর্ঘটনার মূল কারণ যানবাহনের অতিরিক্ত গতি। দেশের সড়কের যে সক্ষমতা তাতে ৬০-৭০ কিলোমিটারের বেশি গতি তোলার কোন সুযোগই নেই। অথচ চালকেরা ১০০-১২০ পর্যন্ত গতিতে যাত্রীবাহী বাস চালাচ্ছেন। এটা ধরার যন্ত্র নেই, দোষী ব্যক্তি শাস্তিও পাচ্ছেন না। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে।

২৪৩ ব্ল্যাকস্পট : বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) হিসেবে, দেশের সড়কপথে ২৪৩টি দুর্ঘটনার স্থান বা ব্ল্যাকস্পট রয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীতে রয়েছে ৩৪টি। অবশিষ্ট ২০৯টি স্পটের অবস্থান বিভিন্ন রুটের মহাসড়কে। এসব স্পটে বছরে গড়ে ১১টি করে দুর্ঘটনা ঘটছে। অধিকাংশ স্পটে দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে গাড়ির বেপরোয়া গতি। অথচ সরকার দুর্ঘটনা কমাতে ১৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৪২টি ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক সোজা করার প্রকল্প নিলেও এখনো অনেক সড়ক ভাঙাচোরা, সংকেতও ঠিকভাবে নেই।


সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি/আকন

Wordbridge School
Link copied!