• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
ধারাবাহিক উপন্যাস

মধ্য রাতের নদী (পর্ব-০৫)


সাহিত্য সংস্কৃতি ডেস্ক আগস্ট ১৩, ২০১৬, ০৪:০৬ পিএম
মধ্য রাতের নদী (পর্ব-০৫)

আজ এতটা বছর পার হয়ে গেল, এর মাঝে রুশনীর চেহারায়ও ভুলে গিয়েছিল প্রায় রতন মাঝি। রুশনীর সাথে রতন মাঝির বয়সের পার্থক্য এত বেশী যে বিয়ের কথা পাকা হওয়ার আগে রতন মাঝি রুশনীর সাথে মেয়ের মতই আচরণ করত। এই ঘাটে তখন ছোট্ট রুশনী কতদিন বায়না ধরেছিল রতন মাঝির নৌকায় চড়তে। রতন মাঝি চোখ লাল করে ধমক দিয়ে নাও নিয়ে নদীতে চলে গেলে রুশনী কাদা তুলে ছুড়ে মেরেছিল রতন মাঝির দিকে।

বিয়ের কথা পাকা হওয়ার পর থেকে রুশনীর মুখ আর একদিনও দেখেনি রতন মাঝি। বিয়ে ভেঙ্গে যাবার পর মাঝি পাড়ায় এ নিয়ে অনেক আলোচনা সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু রতন মাঝির কানে কোনও কথাই পৌঁছায়নি। তবে সন্ধ্যায় ডেরায় ফিরার সময় রতন মাঝি মাঝে মাঝেই দেখত হারু মাঝির বাড়ির পেছনে বড় তেতুল গাছটার আড়ালে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। রতন মাঝিকে নদী থেকে উঠে আসতে দেখলেই সে মুখ আবার নিমেষেই হারিয়ে যেত। কিন্তু ঐ মুখ কার, এ নিয়ে রতন মাঝির মনে কখনও প্রশ্ন জাগেনি।

কাল যখন ঘাট থেকে ডেরায় ঢুকলো রতন মাঝি তারপরই প্রথম অনুভব করল সেদিনের সেই ছোট্ট মেয়ে রুশনীকে। পাঁচ বছর ছ’মাস পর যে একজন পূর্ণ যুুবতী মেয়ে হয়ে উঠেছে। রুশনীকে আজ আবার দেখেই রতন মাঝির বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠে। কেন উঠে মাঝি নিজেও বুঝতে পারে না।

শান্ত নরম কণ্ঠে রুশনি আস্তে আস্তে বলে :
-মাঝি। কোন পাপ কর নাই এমুন কতা তুমি কও কেমনে মাঝি। একটা মাইয়্যারে হলুদ পরাইয়া, মেন্দি পরাইয়া বিয়ার সাজে সাজাইয়া, স্বপ্নের সাগরে ভাসাইয়া দিয়া খালি একটা নৌকার লোভে বিয়া কইরা আনছ আর একটা মাইয়ারে। হুনছি তোমারে নৌকা দিতে গিয়া হেই মাইয়ার বাপও ঘর বেইচ্যা দিছে।
একটু থেমে রুশনি আবার বলে :
-এরপরও কোনও পাপ তুমি কর নাই আল্লাহর কাছে, এমুন কতা তুমি কও কেমনে মাঝি।
মাঝি কিছু বলে না। এসব কথার উত্তরে কি বলা উচিত তা জানা নেই মাঝির। করুণ চোখ তুলে শুধুু তাকিয়ে থাকে রুশনীর মুখের দিকে।
ম্লান হেসে রুশনী আবার বলে :
-মনে কষ্ট লইও না মাঝি। কারো দুঃখের দিনে তার অপরাধের কতা, পাপের কতা মনে করাইয়া দিয়া দুঃখ আরও বাড়াইয়া দেওয়া অন্যায়। তবুও কইলাম, তুমি তোমার পাপের কতা জানতে চাইছিলা তাই কইলাম। মনে কষ্ট লইওনা মাঝি। মাঝি মাথা নিচু করে রুশনীর পাশ কেটে চলে যেতে নেয়। রুশনী পেছন ডাকে :
-হুইন্যা যাও মাঝি। মাঝি দাঁড়ায়।
-তোমার লগে বিয়ার কতা পাকা হওনের পর থেইক্যাই হেই যে ভালবাইস্যা ফালাইছি তোমারে, আইজও বড় ভালবাসি। তোমার সুখের দিনে তোমার সামনে আইতে বড় ভয় করছিল। আইজ তোমার দুঃখের দিনে আমি যদি তোমারে কিছু করবার চাই তুমি নিবা মাঝি?
-না।

মাঝি রুশনীর পাশ কেটে আবারও চলে যেতে নেয়। রুশনী মাঝির একটা হাত ধরে ফেলে। মাঝি হ্যাচকা টানে সে হাত সরিয়ে নিয়ে দ্রুত পালায় রুশনীর সামনে থেকে। পার বেয়ে উপরে উঠে হন হন করে হেঁটে যায় নিজের ডেরার পথ ধরে। একবার পেছন ফিরে তাকায়ও না। মাঝির হ্যাচকা টানে রুশনী কাদার উপর আছড়ে পড়ে। কাদার উপর বসেই ডুকরে ডুকরে কাঁদে। হৃদয়ের খুব গভীরে সেই যে আস্তানা গেড়ে বসে আছে মাঝি ওখান থেকে রুশনী কিছুতেই পারছেনা মাঝিকে সরিয়ে দিতে। এই মানুষটা রুশনীর জীবনটাকে তছনছ করে দিয়েছে। রুশনীর জীবনটাকে এক্কেবারে অর্থহীন করে দিয়েছে। তবু এত কেন মায়া লাগে মানুষটার জন্য। ভেবে পায় না রুশনী। রুশনী ইদানীং বাবা-মারও বিরক্তের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

একটু কিছুতেই মা রেগে গিয়ে বলেন : -মরতে পারস না। বিয়া বইবি না সমাজে বাঁচবি কেমনে। স্বামী ছাড়া মাইয়া মাইনসের জীবনে গতি নাই।
বাবা বলেন : -কপালে দুঃখ আছে। দুঃখ না থাকলে কেউ এমুন করে। রুশনীর তখন খুব বলতে ইচ্ছে করে : মাগো! বাবাগো! রতন মাঝির লগে যেদিন বিয়া ভাইঙ্গা গেল সেইদিন থেইক্যাই তো আমার দুঃখের কপাল শুরু হইয়া গেছে। মনডার ভিত্তে যে কত্ত কষ্ট। একবার যদি তা কাউরে দেখাইতে পারতাম। হালকা হইতাম তয়। এত কষ্ট বুকে চাইপ্যা বাঁচতে আমারও ভালা লাগে না।
বড় ভাইয়ের বৌ-ও ইদানীং কথায় কথায়ই খোটা দেয় : -আমরা কয়দিন বয়াইয়া বয়াইয়া খাওয়ামু। মাইনসের দশ বিয়া ভাইঙ্গা এক বিয়া অয়। রুশনী কোন উত্তর করে না। নিরব প্রতিবাদে এক সময় সংসারের সব কাজগুলো নিজের হাতে তুলে নেয়।

নলীনি মিয়াদের বাড়ির ঝাড়–দেওয়া, মাঝাঘঁষার কাজগুলো শেষ করে চুলায় রান্না চড়ায়। একচুলায় ভাতের হাঁড়িতে চাল ধুইয়ে দিয়ে অন্য চুলায় তরকারী চড়াবার প্রত্তুতি নেয়। মেচ জ্বেলে কুপি ধরায়। শোলা দিয়ে কুপি থেকে আগুন নিয়ে চুলার ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়। এমন সময় স্বয়ং মিয়ার ঘরে নলীনির ডাক পরে। শাড়িটাকে গুছিয়ে পড়ে নিয়ে ভয়ে ভয়ে নলীনি গিয়ে দাঁড়ায় মিয়ার সামনে। হাসিব মিয়া মাতব্বর বালিশে হেলান দিয়ে বিছানাতে আধশোয়া অবস্থায় বসেছিল। নলীনি ঘরে ঢুকলে উঠে বসে। তার চিরাচরিত নিয়মে রমণী দেহের উপর কুৎসিৎ চোখ ঘুড়িয়ে নিয়ে ঠোঁটের ফাঁকে কুৎসিৎ হাসি ফুটিয়ে বলে :
-মাঝিরে কইছিলা বৌ। আমার লগে দেহা করণের কতা।
-জ্বে, জ্বে না।
-কেনও কও নাই বৌ।

নলীনির মুখটা মলিন হয়। আজ এতটা বছর পরে নাও হারাইয়া মাঝির জীবনে, নলীনির জীবনে সুখ এসেছে। আবার এত তারাতারিই নাও পেয়ে যদি সে সুখ হারিয়ে যায়। ভয় করে নলীনির। করুণ ভাবে বলে : -মাতব্বর সাহেব, আপনি অন্য মাঝি লন। মাঝি পাড়ায় তো মাঝির অভাব নাই।
-না বউ, তোমার মাঝিরেই আমার বেশী পছন্দ। ঋষ্ট পুষ্ট যোয়ান পুরুষ। তাছাড়া বুঝলা বৌ, জমানা পাল্টাইছে। বড় বড় আইন হইছে দেশে। আইন এত কড়া হইছে তাই ভাবলাম বাণিজ্য অহন নদীর উপর দিয়াই ভালা হইব। কেউ ধরতে আইবতো ধপাস কইরা পানিতে ফালাইয়া দিয়া খালাস।
-বুদ্ধিটা কেমুন বৌ।
-জ্বে। ভালা।
-ভালা হইতেই হইব। দেখন লাগবো না বুদ্ধিটা কার মাথার। নলীনি মাতব্বরের পা জড়িয়ে ধরে।
-মাতব্বর সাহেব। নাও হারাইয়া আমাগ জীবনে সুখ আইছে। এত্ত তারাতারি নাও পাইয়া সেই সুখ আমরা হারাইতে চাইনা। আপনে অন্য মাঝি লন মাতব্বর সাহেব।
-আরে কর কি কর কি। পাও ছাইড়া দেও। পায়ে ময়লা লাগবো। আমার আবার পাও ধুইতে বড় কষ্ট লাগে।

নলীনির বুকের ভেতরটা দলে মুচড়ে যায়। ভাবে : এইসব মাইনসের লগে সম্মান কইরা কতা কইয়া লাভ কি। সম্মান কইরা কতা কইলেও তো হেগ মন গলবো না। সম্মানের মর্যাদা যারা দেয়না হেগরে সম্মান কইরা দরকার কি। মাতব্বরের পা ছেড়ে দিয়ে নলনি উঠে দাঁড়ায়। শান্তস্বরে কঠিনভাবে বলে :
-রতন মাঝি আপনের নাওতে কাম করবো না। বলেই নলীনি চলে আসতে নেয়।
-দাঁড়াও বৌ। নলীনি দাঁড়ায়।
-তুমি কার সামনে দাঁড়াইয়া কথা কইতাছ জান।
-জানি।
-কার লগে?
-এই গেরামের মাতব্বরের লগে।
-জানই যহন তহন কথা বালা কইরা কইবা। আর শোন মাঝির বৌ, রতন মাঝিরেই আমার চাই। রতন মাঝির মত এমন যোয়ান পুরুষ মাঝি ছাড়া আমার নাওয়ের হাল আর কেউ ধরতে পারবো না। তাই আমিই আমার লোক দিয়া রতন মাঝির নৌকার তলা ঝাঝড়া কইরা দিছি।

নলীনি মাতব্বরের মুখের দিকে বোকার মত তাকিয়ে থাকে। কী বলছে এসব মাতব্বর। এসব কি সত্যি বলছে? নলীনি কী এসব সত্যি শুনছে? নলীনি কিছু বলতে গিয়েও পারে না। মুখে কথা এসে আটকে যায়। অবাক বিস্ময়ে মাতব্বরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

মাতব্বর হাসতে হাসতে বলে :
-অত অস্থির হইও না বৌ। অত অস্থির হওনের কিছু নাই। আমি নাও নষ্ট করছি আবার আমিই নাও দিমু। তবে তফাৎ হইল এই, আগে ছিল মাঝির নিজের নৌকা, অহন কাম করবো আমার নৌকায়। আমার নৌকায় আমার কাম করবো। ভাল টেকা-পয়সা দিমু। আগে যা পাইত তার দুই গুণ দিমু। দরকার হয় তিনগুণ দিমু।
-কি কও বৌ, রাজী হইব না মাঝি। নলীনির সমস্ত গা জ্বলে যায়। দিশেহারা হয়ে মাতব্বরের মুখে থু থু ছিটিয়ে চলে আসতে নেয়। পেছন থেকে মাতব্বর প্রি হাতে সজোরে টেনে ধরে নলীনির শরীর আঁচল। 
নিতান্তই দীন দরিদ্র মাঝির বৌ ব্লাউজ পেটিকোট ছাড়াই আটশাট করে পেঁচিয়ে শাড়ী পরে সম্ভ্রম রক্ষা করে চলে। মাতব্বরের বেপরোয়া হাতের হ্যাঁচকা টানে নলীনির শাড়ীর আঁচল কোমর অব্দি খুলে আসে। বাকীটুকু নলিনীর দু’হাতের করুণ আহবানে আটকে থাকে নলীনির হাতেই। অর্ধনগ্ন নলীনির বুকের দিকে স্থির দৃষ্টিতে কিছুণ তাকিয়ে থাকে মাতব্বর। 

তারপর দাঁত বের করে হেসে বলে :
-অত তেজ দেখাইওনা মাঝির বৌ। আইজ খালি বুকটা উদাম করলাম, ফের যদি তেজ দখাওতো সারা শইলডা উদাম কইরা ফালামু।
-আর হ। মাঝিরে কইবা আইজই যেন আমার লগে দেহা করে। নলীনির শাড়ীর আঁচল ছেড়ে দিয়ে মাতব্বর ঘর ছেড়ে চলে যায়। নলীনি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। চোখে কান্নারা এসে ভীড় করেনা। বুকের ভেতরে কোন স্পন্দনও শুনতে পায়না। বহুণ পর বুক ছিড়ে একটা আর্তশ্বাস বের হয়ে আসে শুধু। হঠাৎ করেই নলীনির চীৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয় :
-দেখে যাও মানুষ, তোমরা দেখে যাও। এইমাত্র একজন সমাজ সেবক সমাজের হিতকল্পে একজন নলীনির সামনে কি সুন্দর আচরণ করে গেল। দেখে যাও তোমরা। কিন্তু কিছুই বলা হয় না।

ক্লান্ত পা দুটিকে টেনে টেনে লম্বা বারান্দাটা পেরিয়ে নলীনি গিয়ে ঢুকে রান্না ঘরে। কোনও রকমে রান্নার কাজ শেষ করে শাড়ীর আঁচলের নীচে ভাতের থালা ঢেকে নিয়ে হেঁটে চলে মাঝি পাড়ার পথ ধরে। সবুজ ধানক্ষেতের আল ধরে হাঁটতে হাঁটতে ভাবে : এতদিন মাইনসের কাছে খালি হুনছি মাতব্বরগর নোংরামির কতা। আইজ তার বাস্তব দেখলাম। সমাজের কোন মাতব্বরই কি ভালা হয় না? মাতব্বর মানেই কি নোংরা মানুষ? মাঝি ঘরে নেই। কোথায় গেছে কে জানে। মাঝির মনের অশান্তি দূর করার জন্য কোথায় গিয়ে বসে আছে কে খবর রাখে তার। নলীনি ছোট্ট উঠান পেরিয়ে দরজার ঝাপ সরিয়ে ডেরায় ডুকে। ঘরের কোনায় ভাতের থালাটা নামিয়ে ঢেকে রেখে চৌকিটার উপর লম্বা হয়ে শুয়ে পরে।
মাথার উপর ছনের একাচালা ছাউনি। বৃষ্টির দিনে তারই ফাঁক দিয়ে টাপ টপ করে গড়িয়ে পরে পানি। ছনের ছাউনির দিকে তাকিয়ে কত কি ভাবে নলীনি।

ওরা জীবনের কোন বিপর্যয়ের পথে পা রেখেছে আজ। এতটা সময় পর সুখ এলো ওদের জীবনে। তাও কি বালুর ঢিবির মত ধ্বংস হয়ে যাবে? মাঝি ঘরে এলে কি বলবে নলীনি মাঝিকে। কেমন করে সে মাঝিকে পাঠাবে ঐ পিশাচটার সামনে। কিন্তু না পাঠিয়েই বা উপায় কি। সে যদি শুধু নলীনির তি করে তাতে নলীনির কিছু আসবে যাবে না। কিন্তু মাঝি? মাঝির মলিন মুখটার দিকে তাকালেই এখন নলীনির বুকের ভেতরের সমস্ত জায়গাটুকু কেমন এলোমেলো হয়ে যায়। 

যে মাঝির মুখের উপর নলীনি কখনো রুতা ছাড়া দেখেনি অন্য কিছু, যে মাঝির বুকের ভেতর দয়া-মায়ার লেশ মাত্র ছিলনা কখনো, সে মাঝি এখন কেমন করে ঝড় ঝড় করে কেঁদে ফেলে ছোট্ট ছেলের মত। মাতব্বর যদি মাঝির কোন তি করে। তখন নলীনির কি হবে। আর মাথার উপর এই যে একটা ছাদ একেও যদি শেষ করে দেয় তখন কোথায় শোবে নলীনি। কোথায় শোবে মাঝি। কোথায় গিয়ে তারা সারাদিনের কন্তি ঘুচাবার সন্ধান পাবে।
অস্থির লাগে নলীনির। আর মাতব্বরের সামনে নলীনির আজ যে দুর্দশা হয়েছে তাকি কখনো বলা যাবে মাঝিকে? কিংবা অন্য কাউকে? কিছু ভেবে পায় না নলীনি।

শোয়া থেকে উঠে বসে নলীনি। খানিক বসে থেকে তারপর চৌকি থেকে নেমে উঠোনে এসে দাঁড়ায়। তারপর নিজের অজান্তেই হাঁটতে হাঁটতে মেঘনা ঘাটে চরে আসে। ভর দুপুরে ঘাটে এখন প্রচুর মানুষ। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা লাফালাফি করে গোছল করছে। মাঝি বৌরাও এসেছে গোছল করতে। সব কান্তি, সব অস্থিরতা মেঘনার পানিতে ধুইয়ে নিয়ে আবার তারা ফিরে যাচ্ছে ডেরায়।

নলীনি পার বেয়ে নেমে পাতা পানিতে এসে দাঁড়ায়। ছোট ছোট ঢেউ নলীনির পা ছুঁয়ে যায়। নলীনির খুব ইচ্ছে করে মনের সব অস্থিরতা মেঘনার ঢেউয়ের মাঝে মিশিয়ে দিয়ে নিজেকে হালকা করতে।
-বুজান কি ভাবতাছ পানির দিকে চাইয়া? নলীনি ফিরে তাকিয়ে দেখে হারু বৌ। কিছু বলে না। ম্লান হাসে শুধু। হারু বৌ হাতের কাপড় ঘাটে রেখে পানিতে নেমে যায়। হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে আঁচলে সাবান মেখে গা ঘঁষে।গায়ে সাবান ঘষতে ঘষতে বলে :
-খাড়াইয়া রইছ কেন বুজান। নাইম্যা পর। কি ঠাণ্ডা পানি। শরীর জুড়াইয়া যায়। অহন যাই। পরে গা ধুমু।

নলীনি আবার ফিরে আসে ডেরায়। ভেতরের অস্থিরতা কমেনা এতুটুকুও। দাওয়ায় মাটির উপরেই সামনের দিকে পা ছড়িয়ে বসে থাকে। গামছার একপাশে একটা পুটলি বেঁধে সেটা কাঁধের একপাশে ফেলে রতন মাঝি আঙ্গিনায় ঢুকে। নলীনিকে দাওয়ায় বসে থাকতে দেখে নলীনির পাশে বসে। গামছাটা নলীনির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে :
-হারু মাঝির নাও বাইয়া বাজার থেইক্যা চাইল আর কেস্কি মাছ আনছি। মজা কইরা মাছের চরচরি পাক কর। এক লগে বইয়া কেস্কি মাছের চরচরি দিয়া ভাত খামু। আজ প্রায় আট দিন পর মাঝি রোজগার করে বাজার করে নিয়ে এসেছে। নতুন সুখের এই দিনে নলীনির উচ্ছ্বাসে ভেঙ্গে পরার কথা। কিন্তু নলীনি শত চেষ্টায়ও পারেনা মনের অস্থিরতা সরিয়ে সেখানে ক্ষীণ আনন্দের ধারা বয়ে দিতে। নিস্পৃহভাবে নলীনি বাজার গুছিয়ে রান্না চড়ায়।

মাঝি নদী থেকে গোছল করে আসে। নলীনির রান্না এখনও শেষ হয়নি। রান্না ঘরে গিয়ে একটা পিঁড়ি টেনে মাঝি বসে নলিনীরি পাশে। বলে : -বুঝছস বৌ। তরে যে আমি কষ্ট দিছি এতদিন আল্লায় আমারে হেই শাস্তিই দিছে। আমি তরে আর কষ্ট দিমু না। নলীনি কিছু বলে না। মুখের মলিনতাও কাটে না তার। নিঃশ্বব্দে রান্না শেষ করে ডেরা ঘরটার মেঝেতে পাটি বিছিয়ে মাঝিকে ভাত বেড়ে দেয়। পাশে বসে পাখা দিয়ে বাতাস করে গরম ভাতের উপর।
তুইঅ খাইয়া ল। মাঝি বলে।

নলীনি নিস্পৃহভাবে উত্তর দেয় : -আমার অহন মন চাইতাছে না।
-এতদিন পরে আইজ পরথম বাজার কইরা আনলাম। তুই খুশী হস নাই বউ?
হইছি। তয় তর মন এত ভার কেন?
-আমার ভালা লাগতাছে না। মাঝি নলীনির বিমর্ষ মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে জানতে চায় : -তর কি হইছে বৌ? নলীনি আর নিজেকে চেপে রাখতে পারে না। ঝর ঝর করে কেঁদেই ফেলে।

মাঝি কিছু বুঝতে পারে না। এতটা বছর এত কষ্টের ভিড়েও মাঝি কখনও নলীনিকে কাঁদতে দেখেনি। মাঝির এত্ত বড় একটা সর্বনাশ হয়ে গেল তাতেও নলীনির চোখে পানি আসেনি। আর সেখানে আজ এই সুখের দিনে কি এমন হয়ে গেল যাতে নলীনি কাঁদছে। মাঝির হাতে ভাতের লোকমা থেকেই যায়। মুখে আর দেয়া হয় না। অবাক হয়ে বৌ-এর দিকে তাকিয়ে আবার জানতে চায় : 
-বৌ তর কি হইছে? কান্দস্ কেন? আঁচল দিয়ে চোখ মুছে নলীনি বলে :
-আমার বড় ডর করে।
-কেন?
-আল্লায় যদি আমাগো এই সুখ ছিনাইয়া লয়। মাঝি হেসে ফেলে। বলে :
-আরে দূর! তর যে পাগলামি। অনেক কষ্টের পরে আল্লায় আমাগরে সুখ দিয়ে। হেই সুখ এতো সহজেই কাইড়া লইবো না। তাই যেন করে আল্লায়। একটা আর্তশ্বাস চেপে নলীনি বলে। 

মাতব্বরের কথা বলবে কিনা নলীনি ভেবে ঠিক করতে পারে না। বলবে না বলবে না ভেবেও নলীনি তারপরও বলতে বাধ্য হয়। আস্তে আস্তে বলে : -মাতব্বর আপনেরে আইজই একবার দেহা করতে কইছে।
-মাতব্বর!
-হ।
-মাতব্বর আমারে দেহা করতে কইছে কেন?
-আমারে কয় নাই কিছু। মাঝি ভাত খায়।
-মাতব্বর যদি আপনেরে নাও দিতে চায় আপনি নিয়েন না। কাতর অনুনয় ভরে বলে নলীনি।
-তাই কইছে নাকি মাতব্বর। গলা শুকিয়ে যায় নলীনির। ঢোক গিলে বলে :
-আমারে কয় নাই কিছু।

কোমরে গামছাটা বেঁধে উদাস ভাবে হাঁটতে হাঁটতে মাঝি পাড়া ছেড়ে বের হয়ে আসে রতন মাঝি। কেশবপুর গ্রামে ঢুকতে যাবার মুখে শিমুল গাছের তলায় এসে থামে। গাছটার ঝাকড়া মাথার দিকে তাকায়। মৃদুমন্দ বাতাসে ঢেউ খেলছে গাছের উপরটা। দীর্ঘ একটা আর্তশ্বাস ফেলে গাছের গোড়ায় হেলান দিয়ে বসে মাঝি। সূর্যটা হেলে গেছে পশ্চিম দিকে। সূর্যটাকে বিদায় জানাতে পৃথিবীর যেন বড় কষ্ট। তাই পশ্চিমাকাশকে রক্তিম রাগে রাঙিয়ে দিয়ে পৃথিবীও কেমন মলিন রুপ ধরে আছে। সেই মলিনতার মাঝে মাঝি স্পষ্ট করুণ একটা মুখের ছবি দেখতে পায়। 

নিজের অজান্তেই ফিসফিসিয়ে বলে মাঝি :
-এইডা কার ছবি? রুশনী? না নলীনি? আমার দিকে এমন কইরা চাইয়া আছে কেন?
বিয়ের একটা দিন পর রুশনী ধীরে ধীরে নয়, এক্কেবারে গর্কির মত প্রচণ্ড গতিতে এসে মাঝির বুকে আস্তানা গেড়ে বসেছে। মাঝির মনের ভেতরটা এলোমেলো করে দিচ্ছে। মাঝি যতই রুশনীকে মনের আড়ালে রাখতে চায় রুশনী যেন ততই স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠছে মাঝির মনের মাঝে।

নিজের পাপের জন্য অস্থির লাগে মাঝির। কোথায় গেলে জীবনে এই অস্থিরতা শেষ হবে, স্বস্তি খুঁজে পাওয়া যাবে, কেমন করে পাওয়া যাবে এসব চিন্তা মাঝিকে বিপর্যস্ত করে তোলে।
আমার জন্যই রশনীর জীবন আইজ বিপর্যস্ত। অর্থহীন। কিন্তু কি আছে আমাতে? রুশনী আমারে ঘৃণা করেনা কেন? কেন ওর বুকের এত্ত গভীরে স্থান দিয়া রাখছে আমারে? আমারে ভুইল্যা যায় নাই কেন? কেন সে আমারে ঘৃণা করেনা। ঢেউ খেলে যাওয়া শিমুল গাছের ঝাকড়া মাথার দিকে তাকিয়ে বিড় বিড় করে বলে মাঝি।

সূর্যটা আস্তে আস্তে নেমে গিয়ে কখন যে হারিয়ে গেছে ঐ আকাশের তলায় ল্যই করেনি মাঝি। চারিদিকে সন্ধ্যার ীণ অন্ধকার নেমে আসে। দূরে কেশবপুর গ্রামের ঘরে ঘরে সন্ধ্যার আলো জ্বলে উঠেছে। গাছগাছালির ফাঁক-ফোকর দিয়ে তার অস্তিত্ব এই শিমুল গাছ তলায় বসেও দেখে মাঝি। হঠাৎ মনে পড়ে বৌ কইছিল মাতব্বরের লগে দেহা করনের কতা।
মাতব্বর হঠাৎ কইরা আমার লগে দেহা করতে চায় কেন? মাঝির কপালে নতুন চিন্তার ভাঁজ পড়ে। মাঝি উঠে দাঁড়ায়। কোমর থেকে গামছা খুলে গা মোছে। তারপর আবার গামছাটাকে কোমরে বেঁধে নিয়ে হেঁটে চলে মাতব্বরের বাড়ির রাস্তা ধরে। মাতব্বর যে মাঝির জন্যই অপেক্ষা করছিল। উঠানে গিয়ে দাঁড়াতেই বারান্দার ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে থাকা মাতব্বর উঠে বসে।

-আস মাঝি আস।
-আমারে নাকি ডাইক্যা পাঠাইছেন।
-ডাকমু না! কওকি মাঝি। আমার-ইতো যাওয়ার দরকার আছিল। তোমাগর দুর্দিনে আমি না গেলে আর কে যাইবো কও। কিন্তু ভাগ্য মন্দ। এত কামের ঝামেলা সময়ই করতে পারলাম না। মাতব্বর তার চিরাচরিত নিয়মে ছাগলের মত দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে চাগিয়ে চাগিয়ে কথাগুলো বলে। মাঝি কিছু বলে না। বারান্দার লম্বা বেঞ্চিটার একপাশে বসে। মাতব্বর আবার হেলান দিয়ে বসে চেয়ারে। বলে :
-তোমার ইমুন একটা সর্বনাশ কেডা করলো কিছু বুঝতে পারলা মাঝি?
-আল্লায় করছে মাতব্বর সাহেব। আমি পাপ করছিলাম। আমার এই সর্বনাশের মধ্যে দিয়া আল্লায় আমারে পাপ শুদ্ধি কইরা সুন্দর জীবনের পথ দেখাইছে।

একটা আর্তশ্বাস ফেলে বলে মাঝি। মাতব্বর হাসে। দাঁত বের করে হেসে হেসে বলে :
-আল্লায় করে ঠিকঅই। তবে নিজে কিছু করে না। মাইনসেরে দিয়া করায়। বুঝলা মাঝি।
-তা ঠিকঅই কইছেন মাতব্বর সাহেব।
-অহন কিভাবে দিন কাটাইবা কিছু ঠিক করলা?
-অহনও করি নাই।
-আমি তোমারে একটা নাও দিমু। নিবা মাঝি?
-আ-আপনি আমারে নাও দিবেন? মাতব্বরের মুখের দিকে বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে বলে মাঝি।
-কেন দিমু না! তোমাগর দুঃখের দিনে আমি তোমাগরে না দেখলে আর দেখবো কেডা কও।
মাঝি মাতব্বরের কথার কোন অর্থ বুঝতে পারে না। হঠাৎ করে মাঝির জন্য মাতব্বরের এত দরদ কেন উঠলে উঠেছে তাও বুঝতে পারে না। তবে মাতব্বররা বিনা উদ্দেশ্যে কারো রে দরদ দেখায় না এটা জানে মাঝি। বিয়ের দু’তিন বছর আগে একদিন দুপুরবেলা ঘাটে নাও বেঁধে ডেরায় ফিরে আসছিল মাঝি। কিছুদূর আসতেই মাতব্বরের সাথে দেখা। মাতব্বর সাথে দু’তিন জন লোক নিয়ে ঘাটের দিকেই যাচ্ছিল। 

রতন মাঝিকে দেখেই দাঁড়িয়ে পড়ে বলেছিল :
-রতন মাঝি যে। চললা কই।
-ডেরায়।
-আমরা যে নদী পার হইতেই ঘাটে যাইতাছি।
-ঘাটে আরো নৌকা আছে মাতব্বর সাহেব। মাঝিও আছে।
-তুমি যাইবা না।
-আমার শইলডা ভালা ঠেকতাছে না। জ্বর জ্বর লাগতাছে।
-মাতব্বর নদী পার হইতে আইছে আর তোমার শরীর খারাপ করছে। এইডা কিমুন কতা কইলা মাঝি।
-আইজ আর নাও ভাসামু না মাতব্বর সাহেব। বড় কাহিল লাগতাছে শইলডা। মাতব্বর তার ছাগলের মত দাঁড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে তার চামচা রাশুর দিকে তাকিয়ে বলেছিল :
-মাঝির শরীর খারাপ করছে রাশু। মাঝি আইজ আর নাও ভাসাইবো না। কি কস রাশু।
মাতব্বরের চেলা যোয়ান রাশু চোখ লাল করে উত্তর দিয়েছিল : -মাঝির ঘাড়ে ভাসাইবো। মাতব্বরের সামনে খাড়াইলে মাইনসের শরীর ভালা হয় আর এই শালার শরীর খারাপ হইছে।

শেষ পর্যন্ত ওদেরকে দিয়ে মাতব্বর অসুস্থ মাঝিকে বাধ্য করে নদীতে নাও ভাসাতে। প্রচণ্ড জ্বরের ঘোরে সেদিন নদীতে নাও ভাসিয়ে রতন মাঝি মাতব্বরকে নদী পার করে দিয়েছিল। এসব কথা ভুলেনি মাঝি। আর সেই মাতব্বর আজ মাঝির জন্য এত দরদ দেখাচ্ছে। বিনা উদ্দেশ্যে!
-কি ভাবতাছ মাঝি?

-হু! তন্ময়তা ভাঙ্গে মাঝির। নলীনির করুণ অনুনয়ও মনে পড়ে মাঝির। এতটা দিন পর সুখ এলো। সেই সুখ আবার হারিয়ে যাওয়ায় ভয়ে নলীনির চোখের পানি মাঝির বুকের ভেতরটাকে এক্কেবারে এলোমেলো করে দেয়। মাঝি নিজেও আর হারাতে চায় না এই অমূল্য সম্পদকে। শুধুমাত্র একটা নাওয়ের তলা ঝাঝড়া হওয়াতেই যদি ওদের জীবনে এত সুখ আসে, জীবনের নতুন পথ খুঁজে পায় মাঝি, তবে আবার এত তারাতারিই সে নাও নিয়ে সুখ হারাতে চায় না মাঝিও।

রতন মাঝি খুব বিনীত হয়ে হাত কচলে বলে :
-মাতব্বর সাহেব, আপনের অনেক দয়া। আল্লায় আপনারে আরো দেক। দোয়া করি। তবে আমি কইছিলাম কি আমার অহন নাও এর দরকার নাই।
-কি কও মাঝি? বাড়া ভাত পায়ে ঠেলা ভালা না। একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে মাঝি বলে :
-হেইডা জানি। কিন্তু-মাতব্বর সাহেব...
মাতব্বর তার দাঁড়ি কচলিয়ে চাগিয়ে চাগিয়ে উত্তর দেয় :
-ঠিক আছে। এত তাড়াতাড়িই কিছু বলার দরকার নাই। বাড়িত যাও। বাড়িত গিয়া ভাব। তারপর মনস্থির কর। তবে বেশী সময় নিওনা। আগামী পরশু সন্ধ্যার মইধ্যে আমারে জানাইয়া যাইয়ো। মাঝি চলে আসতে নেয়। মাতব্বর ডাকে :
-আরেকটা কতা মাঝি। নিজের নাও বাইয়া তুমি যে টাকা পাইতা, আমার নাও বাইয়া তার দুইগুণ, তিনগুণ বেশীও পাইতে পার। টাকার চিন্তা কইর না।

ডেরায় কুপি জ্বালিয়ে বসে আছে নলীনি । মাঝির জন্য অপো করে। সেই কোন বিকেলবেলা মাঝি গিয়েছে এখনও ঘরে আসেনি। মাঝি পাড়া শুধু অন্ধকারেই হারিয়ে যায়নি, গভীর এক নিস্তব্ধতার মধ্যেও ডুবে গেছে মাঝি পাড়া। একমাত্র রতন মাঝির ঘরেই কুপির মিট মিট আলো জ্বলছে। সে আলো ডাঙ্গা বেড়ার ফাঁক- ফোঁকর দিয়ে হয়তবা আরো অনেক কিছুর ফাঁক-ফোঁকর গলিয়ে বহুদূর পর্যন্ত নিজের অস্তিত্ব প্রকাশ করে আছে। মাঝি অন্ধকারের ভেতর দিয়ে হেঁটে হেঁটে এসে ডেরায় ঢুকে। নলীনি উঠে গিয়ে ডেরার ঝাপ টেনে দিয়ে আসে। তারপর মেঝেতে পাটি বিছিয়ে মাঝিকে ভাত বেড়ে দয়। মাঝি চুপচাপ ভাত খেয়ে চৌকির উপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে। নলীনি সবকিছু গুছিয়ে ফু দিয়ে কুপি নিভায়। তারপর গিয়ে শোয় রতন মাঝির পাশে। রতন মাঝি এপাশ ওপাশ করে। নলীনি স্পষ্ট বুঝতে পারে মাঝির মনের অস্থিরতা। মাঝির গায়ে হাত রাখে।

-আপনের কি হইছে? 
-কিছু হয় নাই। বলেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাঝি।
-কিছু হয় নাই! নলীনির বুকের ভেতরটা কাঁপে।
-আপনেরে খুব অস্থির লাগতাছে কেন?
রতন মাঝি কেমন ঘোর লাগা হয়ে বলে :
-বৌ, আমাগ যদি অনেক টেহা অয় কোনদিন তয় আমাগ আর এত কষ্ট থাকবো না। আমরা তিন বেলা খাইতে পারমু। তরে নতুন শাড়ী কিন্যা দিতে পারমু। নলীনির বুকের ভেতরটা ধক করে উঠে। কিন্তু নিজেকে প্রচণ্ড শক্তি দিয়ে শান্ত রাখে।
-আপনি মাতব্বরের বাড়ি গেছিলেন?
-হ।
-মাতব্বর কি কইল?
কইল নাও দিব। হেই নাও বাইলে আগে আমি যা পাইতাম তার তিনগুণ টেহা দিব।
-আপনি কি কইলেন? ভর্য়াত কণ্ঠে জানতে চায় নলীনি।
-আমি কিছু কই নাই। মাতব্বর দুই দিনের সময় দিছে। কইছে ভাইব্যা জানাইতে।
নলীনির বুক চিড়ে একটা আর্তশ্বাস বের হয়ে আসে। নলীনি খুব ভালভাবেই জানে এতে ভাবাভাবির কিছু নেই। মাঝিকে মাতব্বরের নৌকায় কাজ করতেই হবে।

কিন্তু এর থেকে নলীনি মাঝিকে ক্যামন করে মুক্ত করে আনবে। মাতব্বর আজ যে আচরণ করেছে নলীনির সাথে তা কি কখনো বলতে পারবে মাঝিকে। মাতব্বরই যে মাঝির নৌকার তলা ঝাঝড়া করে দিয়েছে এটাই বা কেমন করে বলবে নলীনি মাঝিকে। এটা বললে মাতব্বর যদি সত্যি সত্যি কখনো নলীনির সারা শরীরটা উদোম করে ফেলে। মাথার ভেতরটা কেমন করে নলীনির। সবকিছু জেনে শুনে ক্যামন করে স্বামীকে পাঠাবে ঐ দুর্যোগের রাস্তায় ভেবে পায় না নলীনি। ওখান থেকে স্বামীকে উদ্ধার করে আনার কোন পথও দেখেনা চোখের সামনে। অসহ্য যন্ত্রণায় দু’হাত দিয়ে দু’পাশ থেকে মাথার চুলগুলো টেনে ধরে নলীনি। অন্ধকারের মাঝে রতন মাঝি দেখতে পায়না নলীনির যন্ত্রণা। অন্যপাশ ফিরে শোয় রতন মাঝি। একসময় ঘুমিয়ে যায়। কিন্তু নলীনি সারারাত ছাটফট করে। ঘুম আসেনা কিছুতেই।

রতন মাঝি আজ সকালে মাতব্বরের নাও ভাসিয়েছে মেঘনায়। এবার আর মানুষ পারাপার নয়। এবার পার করবে মাতব্বরের আড়তের জিনিসপত্র। দূর থেকে দূরে। মাতব্বরকে কাল সন্ধ্যায় মাঝির জানানোর কথা ছিল সে মাতব্বরের নৌকায় কাজ করবে কি না। কিন্তু সন্ধ্যা হওয়ার আগেই মাতব্বর একহাতে তার টেট্রনের লুঙ্গি উঁচু করে ধরে চটি জুতার চটচট আওয়াজ তুলে মাঝির ডেরায় এসে হাজির। নলীনি তখন ছোট্ট উঠোনটা ঝাড়ু দিচ্ছিল।

-মাঝি ঘরে নাই বৌ? নলীনি তাকিয়ে মাতব্বরকে দেখে। অগোছালো শাড়ী দ্রুত ঠিক করে আড়াল হতে নেয়।
-দাঁড়াও মাঝির বৌ। দাঁড়াও। পলাও কেন? নলীনি ঘোমটা টেনে আড়াল হয়ে দাঁড়ায়।
-মাঝি ঘরে নাই?
-জী না।
-গেছে কই?
-জানি না।
-আইজ সন্ধ্যায় মাঝির আমার বাড়ি যাওয়ার কথা আছিল। ভাবলাম, যদি না যায় তাই আমিই চইলা আইলাম। কাজটা ভালা করি নাই? কি কও বৌ?
-জী ভালাই করছেন।
-একটা পিঁড়া দেও। দাঁড়াইয়া থাকতে কষ্ট হইতাছে। নলীনি একটা পিঁড়ি এনে উঠানে পেতে দেয়। মাতব্বর নির্দিধায় বসে পিঁড়িতে।
-আইজ কামে যাও নাই বৌ? মাতব্বর নোংরা হাসি হাসে।

কাঁধের একপাশে গামছা ফেলে মাঝি ঢুকে। গামছার এক মাথায় ছোট্ট একটা পুটলি বাঁধা। পুটলিসহ গামছাটা বৌ এর দিকে এগিয়ে দেয়। নলীনি সেটা নিয়ে ডেরার মধ্যে ঢুকে যায়।
মাতব্বর সাহেব। কোন সময় আইলেন? এত ভাগ্যি আমার। কই বসাইয়া যে আপনেরে সম্মান করি।

-ব্যস্ত হইওনা মাঝি। আমি বসতে আসি নাই। সন্ধ্যাবেলা তোমার যাওয়ার কথা আছিল। ভাবলাম, যদি ভুইল্যা যাও তাই কষ্ট কইরা নিজেই আইসা পরলাম।
-ভালা করি নাই মাঝি?
-হ, খুব ভালা করছেন। 
-সন্ধ্যার মইধ্যে ঘাটে নৌকা বান্দা পরবো। কাল ফযর নামাজের সময় তুমি নাও ভাসাইয়া দিবা। তোমার কিছু করণ লাগবো না। নৌকায় আমার লোক থাকবো একজন। হেই তোমারে কইয়া দিব কোনদিকে নাও ভিড়াইবা। তুমি খালি শক্ত হাতে দাঁড় টাইন্যা যাইবা। মাঝি না করার বা কিছু বলার মত সময় পায় নাই। মাতব্বর দাঁড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে চলে যায়।

সূর্যটা ঠিক মাথার উপরে উঠে এসেছে। এর গায়ে এখন যৌবনের উদ্দাম তেজ। বিক্ষিপ্তভাবে সেই তেজ ছড়িয়ে দিচ্ছে মাঠে, ঘাটে, প্রান্তরে, গাছের ডালে, ঘরের চালে, মানুষের গায়ে। সে তেজের অসহ্য যন্ত্রণায় সবকিছু ছট ফট করছে। কিন্তু এত তেজ কেন ঐ সূর্যের বুকে। নাকি পৃথিবীর প্রতি তার আক্রোশ। কিসের আক্রোশ। দূর আকাশে থেকে সে কি দেখতে পায় না কত দুঃখে দিন কাটছে এই পৃথিবীর মানুষের। কত কষ্ট করে দিন পার করছে এই পৃথিবীর মানুষগুলো। 

তারপরও এত যন্ত্রণা ঢেলে দিয়ে পৃথিবীর এই দুঃখী মানুষগুলোকে আরও কেন কষ্ট দেয়। সে কি পারেনা তার আলো থেকে রুদ্রতাকে মুছে ফেলতে। পারেনা সে আলোর মাঝে শান্তির পরশ, সান্ত্বনার বারতা মিশিয়ে সমস্ত পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতে। দাওয়ায় দু’পা সামনের দিকে ছড়িয়ে দিয়ে বসে আকাশের দিকে চেয়ে আরও কত কি ভাবে নলীনি। সেই কোন কালবেলা পান্তা খেয়ে মাঝি যখন নদীতে নাও ভাসাতে যায় মেঘনার ঘাটে তখন মাঝির পেছনে পেছনে নলীনিও গিয়েছিল। মাঝি নাও ভাসিয়ে চোখের আড়াল হয়ে গেলে নলীনি সেখান থেকে এসে সেই যে বসেছে দাওয়ায় এখনও উঠার কোন নাম নেই।

রিটা আশরাফের ধারাবাহিক উপন্যাস ‘মধ্য রাতের নদী’-এর ৬ষ্ঠ পর্ব আসছে... চোখ রাখুন সোনালীনিউজ-এ

কথাসাহিত্যিক ড. রিটা আশরাফ
নরসিংদী জেলার সদর থানার চিনিশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই লেখালেখিতে হাতেখড়ি। নরসিংদী সরকারি কলেজে পড়ার সময় স্বরচিত কথাসাহিত্য প্রতিযোগিতায় বহুবার প্রথম পুরস্কার লাভ করেন। কথাসাহিত্য রচনায় প্রথম পুরস্কার লাভ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল থেকেও।
ড. রিটা আশরাফ বর্তমানে বেসরকারি এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের (এইউবি) বাঙলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং একই সঙ্গে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন দীর্ঘদিন থেকেই।
তাঁরই সম্পাদনায় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য পত্রিকা। পেয়েছেন ভারতের বিশ্ববঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন সম্মাননা (২০১৪), ভিন্নমাত্রা সাহিত্য সম্মাননা (২০১০), গঙ্গা-গোবিন্দ সাহিত্য সম্মাননা (২০১৫), এশিয়ান ইউনিভার্সিটি সহিত্য পত্রিকা সম্মাননাসহ বেশ কয়েকটি পুরস্কার ও সন্মাননা।

রিটা আশরাফের প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে বালুচরে বসতি (উপন্যাস), নৈবেদ্যর নারী (উপন্যাস), বিবর্ণ স্বাধীনতা (উপন্যাস), একটু ভুলের অনুভূতি (উপন্যাস), তুতুলের খড়গোশ শিকার (শিশুতোষ গল্প), মামদোভূতের পুত (শিশুতোষ গল্প সংকলন) বাংলাদেশের স্বাধীনতা আনলো যাঁরা (গবেষণা), নজরুল সাহিত্যে তৎকালীন বিশ্ব (গবেষণা), নজরুলের কুহেলিকা : একটি সার্বিক পর্যালোচনা (গবেষণা), নজরুল সাহিত্যে উপমা (গবেষণা) ইত্যাদি।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি

মধ্য রাতের নদী (পর্ব-০৪)

Wordbridge School
Link copied!