• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
ধারাবাহিক উপন্যাস

মধ্য রাতের নদী (পর্ব-০৬)


সাহিত্য সংস্কৃতি ডেস্ক আগস্ট ১৫, ২০১৬, ০৬:০১ পিএম
মধ্য রাতের নদী (পর্ব-০৬)

সখিনাপুর গায়ের কথা মনে পড়ে। সেই সখিনাপুর গ্রাম। যেখানে নলীনির জীবনের সতের বছর পার হয়েছে। কেমন আছে সে গ্রাম! কেমন আছে সে গ্রামের মানুষেরা। সুফিয়া, কারিমা, ফাতিমা, জ্যোছনা কেমন আছে ওরা সবাই! ওরা কি এখনও সেই গ্রামেই আছে! নাকি নলীনির মত সবাই হারিয়ে গেছে জীবনের নির্দিষ্ট গতিতে। গ্রামের দণি পারে নদীর ধার ঘেঁষে সেই কালিমন্দির! কালিমন্দিরের সামনে শতাব্দীর পরিচয়বাহী সেই বটগাছ, বটগাছের তলায় পুকুর।

নলীনির বয়স যখন দশ-এগার তখনও সুফিয়া, কারিমা, ফাতিমা সবাই একসাথে হয়ে মাঠে ছাগল খোঁটা দিয়ে বট গাছের নিচে খেলতে বসত তারা। বটগাছের গোড়ায় অসংখ্য কোটরে একেকজন এক একজনের পুতুলের বাড়ি বানিয়ে একজন আরেক জনের কাছে পুতুল বিয়ে দিয়েছে। খেলা শেষে সবাই ঝপাৎ ঝপাৎ করে লাফিয়ে পড়েছে বটগাছের নিচে পুকুর পারে। ডুবের পর ডুব দিয়ে চোখ মুখ লাল করে তবে পুকুর থেকে উঠছে।

শতাব্দীর স্বাক্ষর বহনকারী এই বটগাছ নিয়ে এলাকাবাসীর মনে কুসংস্কারের শেষ নেই। এর গোড়ায় বিরাট বিরাট অজগর লুকিয়ে থাকে, গভীর রাতে ওরা বের হয়ে মন্দিরের দেবীর পায়ে মাথা নুইয়ে নমস্কার করে, নির্জন সময় গাছের নিচে কাউকে একা পেলে গাছের ভূতেরা এসে আছর করে। আরও কত কি। কিন্তু দশ এগার বছরের নলীনিদের মনে এসব কুসংস্কার কখনো ভয় ধরাতে পারেনি। ওরা ওদের নিয়মেই তার নিচে বসে খেলা শেষ করে পুকুরের পানিতে ডুবের পর ডুব দিয়ে নিজেদের মনতৃপ্তি ঘটিয়েছে।

কেমন আছে এখন সেই কালীমন্দির! সেই বটগাছ! সেই পুকুর! সখিনাপুর গ্রামের ভেতর দিয়ে এঁকে বেঁকে চলে যাওয়া সেই রাস্তা! ওরা কি সব ভুলে গেছে সে গ্রামের একজন নলীনিকে! যার সাথে একদিন ওদের আত্মার সম্পর্ক ছিল। গ্রামের শেষ মাথায় লম্বা পাড়াটার একেবারে দণিপাশে নলীনিদের ছোট্ট বাড়িটা দাঁড়িয়েছিল। টিনের চালের নিচে মুলি দিয়ে বেড়া দেওয়া একটা ঘর। তার পাশেই ছোট্ট একটা রান্নাঘর। বাড়িটার চারধাারেই কলাগছের দেয়াল। প্রচুর কলা হতো গাছগুলোতে। আর সেই কলার ছড়ি বিক্রি করেই সংসার চলতো নলীনিদের। নলীনির বাবা মানুষের জমিতে কাজ করে সংসারে আটজনের কোন রকমে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাবার চেষ্টায় মগ্ন থাকত সারাদিন সারাবেলা। আর মা এত্তগুলো ছেলে মেয়েকে সামাল দিতে না পেরে সারাদিনই বকাবকি করত :

মরতে পারস না তরা। এক জাঙ্গাল জন্ম দিছে। মোরদ নাই খাওয়ানের তারপরেও।
নলীনির ছাগল বিক্রী করেই বিয়ে হয়েছিল নলীনির। মাঝিকে নলীনির বাবা নৌকা দেবে এই শর্তেই মাঝি বিয়ে করেছিল নলীনিকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একদিনের প্রস্তুতিতে এলাকাবাসীর কাছে যথেষ্ট সাহায্য সহযোগিতা পেয়েও নৌকা কেনার টাকা জোগাড় হয়নি। নলীনির নীরিহ বাবা ভেবেছিলেন বাকী টাকা আস্তে আস্তে জমিয়ে সপ্তাহ দু’য়েকের মধ্যেই মেয়ে জামাইকে নাও কিনে দেবেন। কিন্তু ফিরা যাত্রায় নলীনি গিয়ে কান্নাকাটি করে যখন বলল :

-নাও দিতে পারবানা ত বিয়া দিছিলা ক্যান। খাওয়াইতে পারবা না কইলেই পারতা মইরা যাইতাম। নলীনি পিঠ থেকে কাপড় সরিয়ে বাবার দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে যখন বলেছিল :
-দেখো! দেখো নাও এর ছবি আইক্যা দিছে আমার পিঠে তোমাগর জামাই। ভালা কইরা দেখো।

তখন কোন উপায় না দেখে নলীনির বাবা একমাত্র ঘরের চাল বিক্রি করে মেয়ে জামাইকে নাও দিতে বাধ্য হয়েছিল। আর সে নাও নিয়ে সেই যে নলীনি এসে ঢুকেছিল এই মাঝি পাড়াতে আর কখনো মনেই করেনি সেই সখিনাপুর গায়ের কথা। মাঝির বকা খেয়েছে, মার খেয়েছে তবু সখিনাপুর গায়ের নাম মুখে আনেনি।

ভেবেছে : জীবন যদি এইখান থেইক্যাও তাড়াইয়া দেয় আমারে তবে অন্য কোথাও গিয়া জীবনের নতুন ঠিকানা খুঁজমু। সখিনাপুর আর নয়। অন্য কোন সখিনাপুর যামু আমি। আমার লইগ্যা বাজানে গাছতলায় রাত কাটানোর আশ্রম বসাইছে। হেই জায়গায় কোন মুখে ফিরা তাকামু আমি।

কখনো কখনো এসব ভাবতে ভাবতে বুক ভেঙ্গে গেছে নলীনির। তবু চোখে পানি আসতে দেয়নি। পাথর বেঁধে থেকেছে বুকে। নতুন সময়ে ছোট ভাই বোনগুলো এলে ওদেরকে কুকুরের মত তাড়িয়ে দিয়েছে। ওরা চলে গেলে কষ্টে ভেঙ্গে পড়েছে। এখন আর কেউ আসে না। কেমন আছে ওরা! কত দিন দেখা হয়না ওদের কে। জীবন কি জীবনকে এমন করেই প্রতারণা করে! নলীনির খুব ইচ্ছে হয় সখিনাপুর যেতে।


-ও বুজান কি ভাবতাছো এমন কইরা? পেছন থেকে হারু বৌ-এর ডাকে তন্ময়তা ভাঙ্গে নলীনির। আর্তশ্বাস চেপে বলে নলীনি :
-কে। হারু বৌ। কোন সময় আইলি।
-কো-ও-ন সময়। কি ভাবতাছিলা এমনে বুজান?
-কমু তরে?
-কওনা বুজান। এবার শব্দ করেই দীর্ঘ একটা আর্তশ্বাস ফেলে নলীনি বলে :
-শুনছি দেশে কত্ত বড় বড় লেখক আছে। হেরা মাইনসের দুঃখের কাহিনী, সুখের কাহিনী লইয়া গল্প লেখে। হেই গল্প পইড়া বড় লোকেরা আনন্দ পায়। অবসর সময় কাটায়। ভাবতাছিলাম, ইমুন একজন লেখকের দেখা যদি পাইতাম।
-দেখা পাইলে কি কইতা?
-কইতাম!
-কি কইতা?
-কইতাম! কইতাম আমাগ এই মাঝি পাড়ার মাইনসেরে লইয়া একটা গল্প লেখত। রতন মাঝিরে লইয়া, আমারে লইয়া, মাতব্বরে লইয়া একটা গল্প লেইখ্যা দিত।
-বুজান, তুমি যে মইধ্যে মইধ্যে কইত্বে এত শিক্ষিত শিক্ষিত কতা কও বুঝিনা। তোমারে মাঝির বৌ বানাইয়া আল্লায় বে-ইনসাফ করছে।
-হরে হারু বৌ।
-বুজান হুনছনি, জোয়ার আইতাছে। চমকে উঠে নলীনি বলে :
-জোয়ার আইতাছে?
-তুমি চমকাইয়া গেছো বুজান! আমার ডর করে না। অভ্যাস হইয়া গেছেগা।
হারু মাঝি নদীতে নাও ভাসাইয়া দিছে?
-আইজ ভাসায় নাই। শইলডা বলে ভালা ঠেকতাছে না। কেমনে ঠিক থাকবো কও। -শইলডাওতো একটা মেশিন। হেই সক্কালবেলা নাও ভাসায়। সারাদিন রইদে পুইরা মেঘে বিজ্যা নদীতে ভাইস্যা আবার সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে। একটু দম নিয়ে হারুর বৌ আবার বলে :
-তোমার তো বুজান দিন খুলছে। আল্লায় তোমার দিকে চউখ তুইল্যা চাইছে। বিস্ময় ভরা চোখে হারু বৌয়ের দিকে তাকিয়ে নলীনি বলে :
-কই! আমিতো দেখতাছি না।

সৌভাগ্যির কতা লুকান লাগেনা বুজান। আল্লায় নারাজ অয়। মাঝি পাড়ায় রাষ্ট্র হইয়া গেছে মাতব্বরে রতন মাঝিরে নাও দিছে। খালি নাওই দেয় নাই অনেক টেহাও দিব। দুইদিন পরে দেহা যাইব তোমাগ ছোনের ডেরা সইরা হেন টিনের চাল উঠছে। এর উত্তর কি হ’তে পারে নলীনি জানে না। শুধু করুণ একটা আর্তশ্বাস চেপে যায় ম্লান হেসে।

সূর্যের প্রচণ্ড উত্তাপের সাথে পাল্লা দিয়ে রতন মাঝি দাঁড় টেনে চলে। ঘামে ভিজে গেছে সমস্ত শরীর। কোমর থেকে গামছা খুলে গা মোছে মাঝি। তারপর গামছাটাকে আবার কোমরে বেঁধে দাঁড়ে হাত রাখে। নদীর নির্লিপ্ত ঢেউয়ের সাথে নিজেকে একাকার করে দিয়ে দাঁড় টেনে যায় মাঝি।

এ পর্যন্ত মাঝি শুধু মানুষ পার করছে। নদীর এ পার থেকে ও পার। ও পার থেকে অন্য কোন পার। কখনো মানুষ নিয়ে লম্বা পাড়ি জমাতে হয়েছে পানির উপর মাঝিকে। তিন চার ঘন্টার রাস্তা নদীর উপর শক্ত হাতে দাঁড় টেনে চলেছে মাঝি। ক্লান্তিতে সমস্ত শরীর ভেঙ্গে গেছে। হাতে ফোসকা পড়ে গেছে। তবু দাঁড় থেকে হাত সরাতে পারেনি। কারণ, মাঝির নৌকায় ভাসমান অনেকগুলো মানুষের জীবন তখন একমাত্র রতন মাঝির দাঁড়ের উপরই ভেসে চলেছে।

আল্লায় মাইনষের জীবন কত্ত ভাবে পার করে। এই একই আসমানের নিচে কেউ জীবন পার করে ড্রেনের বিত্তে জুঠা ভাত ফালাইয়া, আবার কেউ জীবন পার করে ড্রেনের ভিত্তেত্তনে সেই জুঠা ভাত উঠাইয়া খাইয়া। বয়ে যাওয়া পানির দিকে তাকিয়ে নির্লিপ্ত ভাবে দার্শনিকের মত এসব কথা ভাবে মাঝি।

মাত্র দশ পনেরো দিনের ব্যবধান। এর মাঝে মাঝির জীবনটা এক্কেবারে ওলট পালট হয়ে যায়। ছকে বাঁধা জীবন থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো দূরে-বহুদূরে। জীবনে ঘটল চরম বিপর্যয়। জীবনের চরম সুখের স্বাদও এর মাঝেই প্রথম অনুভব হলো। আবার এরই মাঝে রতন মাঝি এখন মানুষ রেখে নৌকা বোঝাই করে মাল বয়ে নিয়ে যায়। কেশবপুর গ্রামের মাতব্বর হাসিব মিয়ার আড়তের মাল। নৌকার ভেতরে বড় বড় বস্তায় কি আছে জানেনা মাঝি। কোথায় বয়ে নিয়ে যাবে তাও জানেনা। মাঝি শুধু দাঁড় টেনে যায়। নৌকায় বসা আরেকজন মানুষ মাঝিকে যে দিকে বলে সেদিকেই নাও ঘুড়িয়ে নিয়ে যায়। নিজের নাও হারিয়ে মাঝি এখন মাতব্বরের নৌকার দাঁড় টানে। এইখানে মাঝির নিজের কোন স্বাধীনতা নেই।

সব কিছুর ফাঁক গলিয়ে রুশনীর মুখটা উঁকি মারে। করুণ বিষন্নতার গভীরে ডুবে থাকা এক মুখ। জীবনের এই বিপর্যয় না ঘটলে কি মাঝি কখনো জানত রুশনীর মনের কথা! রুশনী যে মাঝিকে বুকের মধ্যখানে বসিয়ে পূজা করছে একি জানতে পারতো মাঝি কখনো?
রুশনীর সাথে বিয়ে ঠিক হওয়ার আগে এই মেঘনার ঘাটেই কত ঝগড়া হযেছিল মাঝির রুশনীর সাথে। মাঝির দশ বছরেরও ছোট রুশনী দু’চোখে দেখতে পারত না মাঝিকে। মাঝি একদিন দুপুরবেলা ঘাটে নাও ভিড়িয়েছিল। ঘাটে নাও বেঁধে ডেরায় ডুকতে যাবার পথে রুশনী কোত্থেকে দৌড়ে এসে সামনে পড়ে। মাঝিরে দেখেই রুশনী ঝাঁঝিয়ে উঠে বলেছিল :

-আইজ সরাডা দিনঅই বুঝি আলিক্কি। মাঝি খপ করে রুশনীর হাত ধরে ফেলে বলেছিল :
-এই ছেমরি। তুই আমারে দেখলেই এমন করস কেন।
-তোমারে আমি দুই চক্ষে দেখবার পারি না তাই।
-আমি কি তর বাড়া ভাতে ছাই দিছি? দেখস কেন?
-অত খেপ দেখাও কেন? জন্মের সময় বাপ-মাও মুখে মধু দিছে না?
-তর বাপ মাও আইসা দিয়া গেছে। জানস্ না তুই? এর উত্তরে ঝামটা মেরে রুশনী বলেছিল :
-আমার বাপ-মাও এর আর খাইয়া কাম নাইত। তোমার মুখে মধু দিয়া সোহাগ করতো।
আর আজ?

বিয়ের পর মাঝি সন্ধ্যায় ঘাটে নৌকা বেঁধে ডেরায় ফিরে যাবার সময় প্রায়ই দেখত হারু মাঝির ঘরের পেছনের বড় তেতুল গাছটার নিচে রুশনী দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু মাঝিকে আসতে দেখলেই দ্রুত গাছের আড়াল হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাঝি সেদিকে লক্ষ্যই করেনি। হন্ হন্ করে হেঁটে চলে গেছে নিজের ডেরার পথ ধরে। রুশরী কি তাইলে আমারে দেখনের লাইগ্যাই ঐহানে এমন কইরা দাঁড়াইয়া থাকত! আজ প্রথম একথা ভাবে মাঝি। করুণ একটা আর্তশ্বাস চাপে। এই প্রথম নিজের অপরাধের জন্য অস্বস্তি বোধ করে রতন মাঝি।

ভাবে : নিজের অজান্তেও যদি কেউ কোন সময় কোন অপরাধ করে তবে জীবনের কোন না কোন সময় সেই অপরাধের পাপ বোধ তারে আক্রমণ করে। করেঅই। যে পাপবোধ এখন মাঝির মনকে ঘুণ পোকার মত কুটকুট করে কামড়াচ্ছে শুধু। কোমর থেকে গামছাটা খুলে আবার গা মোছে মাঝি। মাঝির নৌকার পাশ কেটে একটা ইঙ্গিনের নৌকা বট্ বট্ আওয়াজ তুলে দ্রুত গতিতে চলে যায় সামনের দিকে। পেছনে আরও একটা ইঙ্গিনের নৌকা এগিয়ে আসার বট্ বট্ আওয়াজ শোনা যায়।

ইঙ্গিনের নৌকা যেইভাবে ভাসছে নদীতে এতে কইরা আমাগর মত দাঁড়টানা মাঝিগর ভবিষ্যৎ কি? রুশনীর ভাবনার ফাঁক গলেই চলে যাওয়া ইঙ্গিনের নৌকার দিকে তাকিয়ে মনে হয় মাঝির। দূরে পাল তোলা একটা নৌকা দেখা যায়। সে নৌকার মাঝি মনের সুখে গান ধরেছে। বাতাসের সাথে মিশে সে গানের করুণ সুর পানির উপর দিয়ে ভেসে ভেসে রতন মাঝির কানে এসে ধাক্কা খেয়ে যায়। বড় ভাল লাগে মাঝির। মাঝিরও ইচ্ছে করে ঐ পাল তোলা নৌকার মাঝির মত গলা ছেড়ে একটা গান ধরতে। সেই গানের ভেতর দিয়ে বুকের সব যন্ত্রণা বাতাসের সাথে মিশিয়ে দিয়ে নিজেকে হালকা করতে। কিন্তু পারে না। রতন মাঝি গান গাইতেই জানে না।

সব কষ্টের ফাঁক দিয়ে রুশনীর কষ্টটাই এখন বুকের ভেতর গুমরে গুমরে উঠে মাঝির।
ঘাটে যাওয়ার জন্য কাপড় চোপড় নিয়ে হারু বৌ নলীনির ডেরার দাওয়ায় আসে। নলীনি ঘরের ধার লেপে। প্লাস্টিকের বদনা থেকে পানি ঢেলে মাটি গুলিয়ে ধারের বিভিন্ন জায়গা থেকে খসে পড়া জায়গায় লাগায়। হারু বৌ বলে :


-নলীনি বুজান আর কত্ত দেরী?
হইয়া গেছে।
-গরমে গাও জইল্যা যাইতাছে। জলদি চল।
-আমারও অসইহ্য গরম লাগতাছে।
-বুজান আমার ইচ্ছা করে সুবুজটারে আসমানতনে খুইল্যা ফালাইয়া দেই। নলীনি হাসে। বলে : -যহন একাধারে দুই-তিন দিন আকাশ কান্দে, মাঝি পাড়া কাদার তলায় ডাইব্যা যায় তহন কিছু করতে ইচ্ছা করে না।
-করে। তহন ইচ্ছা করে :
-কি জানি ইচ্ছে করে -এ, কি জানি ইচ্ছা করে বুজান বুঝি না। নলীনি বদনা থেকে পানি ঢেলে হাত ধোয়। হাত ধুতে ধুতে বলে :
-হইয়া গেছে। খাড়া, ঘরতনে কাপড়ডা লইয়া আই।

মেঘনার ঘাটে এখন অনেক মানুষ। শরীরের সমস্ত উত্তাপ নদীর পানিতে ঢেলে দিয়ে সবাই নিজেকে ঠাণ্ডা করার জন্য ছুটে এসেছে। নলীনি আর হারু মাঝির বৌও নামে। ডুবিয়ে ডুবিয়ে গোছল করে দু’জন। শাড়ীর আঁচলে গা মাঝে নলীনি পানিতে দাঁড়িয়েই।

গা মাঝতে মাঝতে হারু বৌ বলে : -বুজান। মাতব্বরের বাড়ি আর কামে যাইবা না। মন চায় না হারু বৌ।
-অবশ্য অহন না গেলেও ক্ষতি কি। মাঝি তো ভালাই কামাই করে। নলীনি এ কথার কোনও উত্তর খুঁজে পায় না। প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্য বলে :
-কি পাক করছস আইজ।
-কলমি শাক আর ডেঙ্গা দিয়া শুটকি।
-কলমি পাইলি কই।
-পোলাডায় তুইল্যা আনছে।
-ওরা গোছল শেষে যে যার ডেরায় চলে আসে। নলীনি দাওয়ায় দাঁড়িয়ে লম্বা চুলগুলো ঘাড়ের এপাশ ওপাশ করে ঝাড়ে। কলাপাতা দিয়ে বানানো দক্ষিন পাশের বেড়ার উপর শাড়ীটা মেলে দেয়। ছোট একটা বাটিতে কলমি শাক নিয়ে হারু মাঝির বৌ আসে।
লও বুজান। শাক দিয়া ভাত খাইও। তোমার মাঝির জন্য রাইখ্যা একটু।
আমি যে তরে কিছু দিবার পারি নারে হারু বৌ।
-রাস্তার কিনারতনে ঘাস তুইল্যা পাক কইরা তোমারে দিলাম হেইজন্য আমারে তোমার কিছু দেওন লাগবো না বুজান।

-আরও কম কইরা আনলি না কেন? পোলা, মাঝি হেরা খাইবো না। রাত অনেক হয়ে গেছে। নলীনি কুপি জালিয়ে বসেই থাকে। মাঝি আসেনা। আজ কদিন ধরে মাঝি মাতব্বরের নাও ভাসিয়েছে মেঘনায়। এর মাঝে একদিনও এত দেরী হয়নি। নলীনির জীবনে সুখ এলেও এ সুখের প্রাচীরে এত শেওলা কেন? শেওলা সরিয়ে এ প্রাচীরকে কিভাবে ধবধবে একটা উজ্জ্বল রঙ্গে উন্মুক্ত করবে ভেবে পায়না নলীনি। মাতব্বরের নাওয়ে মাঝি দাঁড় টানছে এটা মনে হলেই সমস্ত শরীর শিরশির করে উঠে নলীনির।

কান্ত শরীরটাকে টেনে নিয়ে মাঝি ঢুকে ডেরায়? নলীনি জানতে চায় :
-এত রাইত হইল যে আইজ। মাঝি একটা আর্তশ্বাস ফেলে।
-নাও লইয়া অনেক দূরে গেছিলাম।
-আমি তো ভাইব্যা অস্থির।
-অহন কি আর নিজের নাও আছে যে যহন ইচ্ছা তহন ঘাটে নাও বাইন্দা ঘরে ফিরমু। ভাত দে। নলীনি পাটি বিছিয়ে ভাত বেড়ে দেয়। মাঝি খায়। পাশে বসে নলীনিও খায়।
-কলমী শাক পাইলি কই।
-হারু মাঝির বৌ দিয়া গেছে। মুখে আরেকটা লোকমা ঢুকাতে গিয়েও তা নামিয়ে আনে নলীনি। মাঝির মুখের দিকে করুণভাবে তাকিয়ে থেকে বলে :
-মাতব্বরের নাও আর কয়দিন বাওন লাগবো কিছু কয় মাতব্বর?
-না।
-আমার খালি ডর করে। দু’চোখ থেকে কান্না গড়িয়ে পড়ে নলীনির। মাঝি নলীনির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলে :
-কেন? এত ডর করে কেন?
-আমার খালি মনে অয় আমাগর সুখের উপরে দিয়া চিল ঘুরতাছে। যহন তহন থাবা মাইরা সব শেষ কইরা দিতে পারে।
-অনেক কষ্টে যে জিনিস পাওয়া যায় তা অত্ত সহজে হারায় না বৌ। আমাগ এই সুখও হারাইবো না। রতন মাঝির কথাগুলো অদ্ভূত ভাল লাগে নলীনির। মনে মনে বলে : খোদা, আমি আর কিছু চাই না, খালি এই সুখটুকুন চাই। কাইরা লইওনা খোদা।

মাঝি পাড়ায় জোয়ারের পানি ঢুকেছে। মেঘনার পার উপচে এমন ভাবে পানি ঢুকে পড়েছে যে সমস্ত মাঝি পাড়াটা দেখে মনে হয় গাছপালা, ডেরাঘরগুলো পানির উপর ভাসছে যেন। মাঝি পাড়ার ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো সেই পানির উপর লাফালাফি করে সারাদিন খেলা করে। ঘরে বসেই বর্শি ফেলে মাছ ধরে। আর তাদের মায়েরা ভয়ে অস্থির হয়। যে যার সন্তানকে সারক্ষন চোখে চোখে রাখে। কে জানে কার বুক কখন খালি হয়। কার সন্তানের লাশ কখন ভেসে উঠে ঐ মেঘনার বুকে।

প্রতিবছরই মেঘনার বুক ভরে মাঝি পাড়ায় যখন পানি ঢুকে তখন একাধিক বাচ্চা মরে ভেসে উঠে সেই পানিতে। মেঘনার সাথে মাঝি পাড়ার সীমানা চিহ্নিত করতে না পেরে বাচ্ছাগুলো খেলতে খেলতে কখন যে পরে যায় মেঘনার বুকে কেউ টেরই পায় না। পরে যখন লাশ হয়ে ভেসে উঠে তখন সেই লাশ নিয়ে তার বাবা মার সে কি কান্না। সে কান্না ভারী করে তোলে সমস্ত মাঝি পাড়াকে, মাঝি পাড়ার আবহাওয়াকে। শুধু যে ছোট্ট বাচ্ছাগুলো লাশ হয়ে ভেসে উঠে তাই নয়, দু’একজন বড় মানুষও তাদের ভাগ্যকে বিসর্জন দেয় এই মেঘনায়।

গত বছরের আগের বছর মেঘনার পানি উপচে যখন মাঝি পাড়া তলিয়ে গেল পানির নিচে তখন হঠাৎ একদিন রুস্তম মাঝিকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। সারাদিনভর খোঁজা হল রুস্তম মাঝিকে। কোথাও পাওয়া গেল না তার দেখা। পরদিন সকালবেলা দেখা গেল মেঘনার বুকে ভেসে উঠেছে রুস্তম মাঝির লাশ। পানি খেয়ে পেট ফুলে বালিশ হয়ে গিয়েছিল তার। নৌকায় করে রতন মাঝি, হারু মাঝি আরও দু’একজন মাঝি নদী থেকে তুলে আনে সে লাশ। কান্নাকাটি হৈ চৈ-এ সমস্ত মাঝি পাড়া একাকার। লাশ দাফন করা নিয়েও দেখা দিল মহা ঝামেলা। লাশ কোথায় দাফন করা হবে। কোথায় কবর দেয়া হবে। মাটি নেই। কোথাও একচিলতে মাটি নেই। শেষে স্থির হলো লাশ দাফন করে ভেলায় করে ভাসিয়ে দেয়া হবে। তাই করা হলো শেষ পর্যন্ত।

হারু মাঝির ঘর থেকে চৌকি বের করে তার উপর লাশ রেখে গোছল করানো হলো। রতন মাঝি নৌকা নিয়ে বন্দরে গিয়ে দাফনের কাপড় কিনে আনল। তারপর রুস্তম মাঝিকে দাফন করা হলো। শেষে কলাগাছের ভেলা বানিয়ে সেই ভেলায় রুস্তম মাঝিকে শুইয়ে ভাসিয়ে দেয়া হলো মেঘনার বুকে। মেঘনার ঢেউয়ের তালে তালে ভেলায় শুইয়ে রুস্তম মাঝি ভেসে চলে জীবনের চরম ঠিকানায়। পানির উপর দাঁড়িয়ে তার বউ সন্তানের আহজারিও ভেসে চলে সেই ভেলার সাথে সাথে। তারপর তা হারিয়ে যায় প্রকৃতির দুর্বোধ্যতার আড়ালে।

এবারও মেঘনা উপচে মাঝি পাড়ায় যখন পানি ঢুকল ভয়ে জড়সড় হলো সবাই। কে জানে কার বুক খালি হয় কখন। যে সব মাঝিদের ঘরে চৌকি নেই তারা নাওয়ের ভেতরেই বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে দিন কাটায়। নাও এ বসেই খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষে ঘুমিয়ে পড়ে। যাদের ঘরে চৌকি আছে রাতের বেলা চৌকিতে ঘুমাতেও তাদের বড় ভয়। কেঁচো, সাপ এদের খেলা চলে সারক্ষন। সাপেরা পানির ওপর মাথাটা ভাসিয়ে দৌড়ে দৌড়ে বেড়ায়। আর কেঁচোরা অনেকে একসাথে মিলে কোলাকুলি করে যেখানে সেখানে জটলা পাকিয়ে বসে থাকে।

প্রায় সব মাঝিরই ঘরের ভেতর পানি ঢুকে পড়েছে। শুধুমাত্র রতন মাঝির ঘরের ভেতরেই এখনও পানি ঢুকেনি। তবে ভিটার চুড়া ছুঁই ছুঁই করছে। আজ রাতে যদি সামান্য পানিও বেড়ে যায় তাহলেই রতন মাঝির ঘরের মেঝেটা ডুবে যাবে পানির ভেতর। নলীনি দরজার ঝাপ ফেলেনি। কুপি জ্বালিয়ে চৌকিটার উপর বসে আছে। পাশে রতন মাঝি। আকাশে আজ জ্যোৎস্না উঠেছে। সেই জ্যোৎস্না একচিলতে উঠোনটার উপরে জোয়ারের পানির উপর বিছিয়েছে এক মোহময় চাদর। চিক চিক করছে পানিগুলো।

নলীনি ওদের এই দুর্বিষহ জীবনের মাঝে দাঁড়িয়েও দরজা দিয়ে বাইরে উঠোনটায় জোয়ারের পানির দিকে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে থাকে। চাঁদের আলোর সাথে জোয়ারের পানির কোলাকুলিতে তাদের অদ্ভূত সুন্দর দেখে পুলকিত হয়। মোহগ্রস্তের মত সেদিকে তাকিয়ে বহুক্ষন ধরে মাঝিকে একটা কথা বলতে চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। লজ্জা এসে মুখে হাত চাপা দিয়ে রাখে।

রিটা আশরাফের ধারাবাহিক উপন্যাস ‘মধ্য রাতের নদী’-এর ৭ম পর্ব আসছে... চোখ রাখুন সোনালীনিউজ-এ

কথাসাহিত্যিক ড. রিটা আশরাফ
নরসিংদী জেলার সদর থানার চিনিশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই লেখালেখিতে হাতেখড়ি। নরসিংদী সরকারি কলেজে পড়ার সময় স্বরচিত কথাসাহিত্য প্রতিযোগিতায় বহুবার প্রথম পুরস্কার লাভ করেন। কথাসাহিত্য রচনায় প্রথম পুরস্কার লাভ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল থেকেও।
ড. রিটা আশরাফ বর্তমানে বেসরকারি এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের (এইউবি) বাঙলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং একই সঙ্গে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন দীর্ঘদিন থেকেই। তাঁরই সম্পাদনায় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য পত্রিকা। পেয়েছেন ভারতের বিশ্ববঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন সম্মাননা (২০১৪), ভিন্নমাত্রা সাহিত্য সম্মাননা (২০১০), গঙ্গা-গোবিন্দ সাহিত্য সম্মাননা (২০১৫), এশিয়ান ইউনিভার্সিটি সহিত্য পত্রিকা সম্মাননাসহ বেশ কয়েকটি পুরস্কার ও সন্মাননা।

রিটা আশরাফের প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে বালুচরে বসতি (উপন্যাস), নৈবেদ্যর নারী (উপন্যাস), বিবর্ণ স্বাধীনতা (উপন্যাস), একটু ভুলের অনুভূতি (উপন্যাস), তুতুলের খড়গোশ শিকার (শিশুতোষ গল্প), মামদোভূতের পুত (শিশুতোষ গল্প সংকলন) বাংলাদেশের স্বাধীনতা আনলো যাঁরা (গবেষণা), নজরুল সাহিত্যে তৎকালীন বিশ্ব (গবেষণা), নজরুলের কুহেলিকা : একটি সার্বিক পর্যালোচনা (গবেষণা), নজরুল সাহিত্যে উপমা (গবেষণা) ইত্যাদি।

মধ্য রাতের নদী (পর্ব-০৫)


সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি

Wordbridge School
Link copied!