• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
ধারাবাহিক উপন্যাস

মধ্য রাতের নদী (পর্ব-০৮)


সাহিত্য সংস্কৃতি ডেস্ক আগস্ট ২০, ২০১৬, ০৪:৪৬ পিএম
মধ্য রাতের নদী (পর্ব-০৮)

গোপাল চলে গেলে মাতব্বর বারান্দার ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে। বাড়ির দক্ষিণ পাশটা খোলা। বারান্দায় বসেই বিশাল এলাকা জুড়ে সবুজ ফসলী মাঠ দেখা যায়। সেদিকে তাকালে কিছুক্ষণের জন্যও মন মিশে যায় প্রকৃতির মাঝে। মাতব্বরের কুটিল মনটাও কেমন করে। এবার জোয়ারের পানি বেশি বাড়ে নাই। প্রতি বছরই জোয়ারের পানি যখন নেমে যায় তখন এই বিশাল ধানের মাঠ নষ্ট হয়ে যায়। এবার পানি তেমন ক্ষতি করেনি। তার আগেই নেমে গেছে পানি।

মাতব্বরের ছোট্ট মেয়েটা পেছন থেকে এসে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে। ডাকে : -বাবা। মাতব্বর দুই হাত দিয়ে মেয়েকে পেছন থেকে সামনে টেনে আনে। মেয়েটার মুখের দিকে তাকালেই কেমন হয়ে যায় মাতব্বর। মনটা কেমন করে উঠে। চোর, ডাকাত, মতব্বর, ঘুষখোর এসব মানুষের চেহারাতে কমনীয়তা কখনো ছুঁয়ে যেতে পারে না। তাদের সন্তানদের মুখেও পড়ে বাবার অপরাধের ছোঁয়া। কিন্তু মাতব্বরের এই মেয়েটার চেহারা এত সুন্দর, তার মুখের সমস্ত অবয়বে এত কমনীতার ছোঁয়া যে মেয়েটা সামনে এলেই মাতব্বর এর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে বলে : আমার চরিত্রের কিছুই মাইয়াটার কোথাও নাই। কেউ দেখলে কইতেই পারব না এইটা মাতব্বরের ময়ে। মাতব্বরের মত একটা বদ মাইনসের ময়ে এত সুন্দর হইল কেন? এ কার পূণ্যের ফল।


-বাপজান, আমি তোমার সামনে আসলেই তুমি আমার মুখের দিকে চাইয়া কি দেখ?
-দেখি। আল্লায় আমার এই কইন্যাটারে এত সুন্দর বানাইল কেন?
-আমি কি খুব সুন্দর বাপজান।
-খুব সুন্দর। ইস্কুলে যাও নাই আইজ?
-গেছিলাম। ছুটি দিয়া দিছে।
-কেন? ছুটি দিল কেন?
-আমগ ইস্কুলের এক ছাত্র মেট্রিকে ভাল পাশ দিছে। হেই খুশিতে ছুটি দিয়া দিছে।

মাঝি এখন বেশীর ভাগ সময়টাই বৌ-এর পাশেই কাটায়। মাতব্বরের নৌকাও নদীতে ভাসায় না, বাইরেও কোথাও যায় না। যে বৌ-এর দিকে এক সময় চোখ তুলে তাকায়নি মাঝি, এখন সে বৌ-এর আঁচল ছাড়তেই বড় ভয় মাঝির। কেন এমন হচ্ছে নিজেই বুঝতে পারে না মাঝি। মাঝি ইদানিং লক্ষ করছে নলীনি যখন চোখের আড়াল হয় তখন নিজের অজান্তেই রুশনি এসে সামনে দাঁড়ায়। ওর সব কষ্টকে মাঝির বুকে ঢেলে দিয়ে মাঝিকে তছনছ করে দিয়ে যায়। বুকের ভেতর দিন দিন রুশনি এত গভীর একটা ক্ষত সৃষ্টি করে চলেছে যে মাঝি চেয়েও এর থেকে মুক্তি পাচ্ছে না। তাই কি মাঝি ইদানিং এত বেশী বৌ পাগল হচ্ছে। ভেবে পায় না মাঝি।

নলীনি মাটির শাঙ্কিতে করে ভাত বেড়ে দেয়। কাছে বসে পাখা দিয়ে বাতাস করে । মাঝি খায়। বৌ-এর দিকে তাকায় না। হঠাৎ করেই মাঝির বুকের ভেতর প্রশ্ন খেলে যায় : আমি কি তাইলে ভালবাসার নাম কইরা বৌরে প্রতারণা করতাছি। রুশনীরে ভুলবার জন্যই কি আমি দিন দিন বৌ-এর এত কাছাকাছি আসতাছি। মাঝি বৌ-এর দিকে তাকায়। মাঝির অন্যমনস্ক মুখের দিকে তাকিয়ে নলীনি জানতে চায় :
-কি ভাবতাছেন অমন কইরা? নলীনির মুখের দিকে তাকিয়ে মাঝি বোকার মত প্রশ্ন করে :
-বৌ, তুই কি রুশনীরে সন্দেহ করস?

মাঝির এই আকস্মিক প্রশ্নে নলীনি একেবারে বোকা হয়ে যায়। সাথে সাথেই এই অদ্ভুত প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায় না। মাঝি কি বলছে এসব? কেন বলছে? মাঝির ইদানিং হঠাৎ হঠাৎ চমকে যাওয়া, অন্যমনস্কতা নলীনি লক্ষ করেছে, তবে জীবনের নতুন ভালবাসায় তার কারণ কখনো মনের ভেতর দোলা দেয়নি। মাতব্বরের নৌকায় কাজ করছে না। এজন্যও মাঝির অন্যমনস্কতা। নলীনির এটাই স্থির বিশ্বাস। মাঝির মনে কোথাও রুশনী আছে এ রকম প্রশ্ন নলীনির কখনোও চিন্তাতেই আসেনি। মাঝির রুক্ষতা রুশনির নিরবতা এ রকম মনে হওয়ার কোন কারণের উদ্ভব ঘটায়নি। আজ হঠাৎ এক নতুন ভাললাগার জোয়ারে মাঝি একি বলছে!
নলীনি অবাক হয়ে মাঝির মুখের দিকে তাকিয়ে বলে :
-আপনি এইডা কি কইলেন? রুশনীরে সন্দেহ করমু কেন? এবার মাঝিও অপ্রস্তত হয়ে যায়। মাঝি একি বলেছে? কেন বলেছে? নিজের দুর্বলতা এভাবে প্রকাশ পাচ্ছে কেন? মাঝি কি বলবে বুঝতে পারে না। তড়িঘড়ি করে যা মুখের সামনে পায় তুতলায়ে তুতলায়ে তাই বলে ফেলে।
-না, না। মাইনে তুইতো হুনছস্ রুশনীর লগে আমার বিয়া ঠিক অইছিল।
-হুনছি।
-তর মন খারাপ অয় নাই হুইন্যা।
-অইছে।
-আমি জীবনে অনেক পাপ করছি বৌ।
-পাপী যহন তার পাপ নিজের মুখে স্বীকার করে তহন আর তা পাপ থাকে না।
-এত কিছু জাইন্যাও তুই আমারে হাছাই ভালবাসস বৌ?
-বাসি। হাছাই ভালবাসি।

নিজের দুর্বলতা না জানি আবারও প্রকাশ পেয়ে যায় তাই মাঝি আর আগায় না। দ্রুত পাতের ভাত শেষ করে। হাত ধুয়ে দড়ি থেকে গামছাটা টেনে কাঁধের একপাশে ফেলে বাইরে নেমে যায়? জ্যোৎস্না এখনো কাটেনি। তবে ম্লান হয়ে এসেছে। জ্যোৎস্নার ভেতর দিয়ে উদাস ভাবে হাঁটে মাঝি। মাঝি বের হয়ে গেলে নলীনির বুকে হঠাৎ করে একটা কাটার খচ্ খচ্ শব্দ হয়। ভাবে : মাইনসের জীবনে যহন পাপ বোধ জন্মায় তহন তা চতুর্দিক থেইক্যাই জন্মায়। মাঝির জীবনেও কি তাইলে রুশনির প্রতি তার পাপ বোধ জন্মাইছে! হের বুকের মধ্যিখানে কি তাইলে রুশনিও ভালোবাসার জায়গা দখল করতাছে! চাঁদের ম্লান আলোর নিচে হাঁটে মাঝি। আনমনা হয়ে হাঁটতে হাঁটতে হারু মাঝির ঘরের পেছনের তেতুল গাছ তলা পার হতে যাবে অমনি পরিচিত নারী কন্ঠের ডাকে থেমে যায় মাঝি। বুকের ধুক্ ধুক্ করে উঠে।

রুশনীর দিকে পেছন দিয়েই দাঁড়ায় রতন মাঝি। রুশনী সামনে আসে। তেতুল গাছের পাতাদের ফাঁক দিয়ে জ্যোৎস্নার ম্লান আলো এসে পড়ে রুশনীর মুখের উপর। সে মুখের দিকে তাকিয়ে ণিকের জন্য হলেও হৃদ স্পন্দন থেমে যায় মাঝির। বড় অদ্ভুত লাগে সে মুখ মাঝির কাছে। মনে হয়, এমন একটা মুখ যুগ যুগ সাধনা করলেও খুঁজে পায়না কেউ। আল্লাহ যেন খুব যত্ন করে নিজের হাতে গড়েছেন এ মুখ। মাঝির খুব ইচ্ছে করে দুই হাত দিয়ে ঐ মুখটা একবার তুলে ধরে। কিন্তু কিভাবে? ঐ মুখ তো মাঝির জন্যই অপেক্ষা করেছিল। আজও শুধু মাঝির জন্যই অপেক্ষা করে আছে। মাঝি নিজেই তো দূরে ঠেলে দিয়েছে। এখন কোন লজ্জায় ঐ মুখ তুলে ধরবে মাঝি। এ যে ভাবাও অন্যায়। রতন মাঝি রুশনীর পাশ কেটে মাথা নিচু করে চলে যেতে নেয়।

-যাইওনা মাঝি। শুইন্যা যাও। রুশনী মাঝির পায়ের কাছে বসে পড়ে মাঝির পা দু’টো খপ করে জড়িয়ে ধরে। কাতর অনুনয়ে বলে :
-কও মাঝি, আমার একটা কতা রাখবা তুমি! রুশনীর এই আকস্মিক আচরণে মাঝি বিমুঢ়ের মত দাঁড়িয়ে পড়ে। মাঝি স্পষ্ট বুঝতে পারে ওর বুকের ভেতর ধুক্ ধুক্ আওয়াজটা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। মাঝি যেন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে সে আওয়াজ। কি কথা বলতে চায় রুশনী!
মাঝির পা ঝাকিয়ে রুশনী আবার বলে :
-মাঝি কও, খালি একটা কথা রাখবা তুমি।

মাঝি ভেবে পায় না কি কথা বলতে পারে রুশনী। মনে মনে বলে : রুশনীর জীবনে যেই কতা দিয়া আমি রাখি নাই আইজ একটা কতা রাইখ্যা যদি তার কিঞ্চিত পাপ মুক্তি হয় তবে রুশনী যা কয় তাই রাখমু আমি। রুশনীর জীবনে যে কতার বরখেলাপ আমি করছি তার থেইক্যা বড় কোন কথা তো আর নাই এই পৃথিবীতে।
-রাখবা না মাঝি? মাঝির গলা কাঁপে। তারপরও দৃঢ় ভাবে বলে :
-রাখমু। ক তর কি কতা। রুশনী মাঝির পা ছেড়ে দাঁড়ায়। শাড়ীর আঁচলের গিট খুলে একটা পুটলি বের করে আনে। মাঝির একটা হাত টেনে নিয়ে পুটলিটা দেয় মাঝির হাতে।
-এইডা লও।
-এর মধ্যি কি আছে?
-কিছু টেকা। তুমি একটা নাও কিনবা মাঝি। মেঘনার বুকে আবার নতুন নাও ভাসাইবা।
মাঝি এক্কেবারে পাথর হয়ে যায়। তাই বলে এত বড় শাস্তি। মাঝির করুণ মুখটা আরও করুণ হয়। আস্তে আস্তে বলে :
-শোধ লইবার চাস?
-না মাঝি। এমন কতা কইয়ো না।
-তয় এই টেকা ফিরাইয়া ল। রুশনী মাঝির হাত দুটো চেপে ধরে করুণ ভাবে বলে :

-মাঝি। আইজ পরায় ছয়ডা বছর বুকের মধ্যি কি যে যন্ত্রণা! কি যে কষ্ট! হে কাউরে বইলা বুঝান যাইব না। এই ছয়ডা বছরে কত কষ্ট কইরা যে সময় কাটছে আমার। কষ্ট ভুইল্যা থাহনের লাইগ্যা মাইনসের বাড়িত কাম করছি। নলী ভরছি। আরও কত্ত কি করছি। এগুলি কইরা কইরা এই টেহা জমাইছি। তোমার জন্যিই জমাইছি এইডা মনে কইরো না। আইজ মনে অইলো এই টেহা দিয়া যদি আমার ভালবাসার পুরুষের কিছুডাও উপকার অয় তবে মনে বড় শান্তি পামু। রুশনী মাঝির হাত ছেড়ে দিয়ে আবার পা দু’টো চেপে ধরে। বলে :
-তুমি না কইরো না মাঝি। আমার যন্ত্রণা থেইক্যা কিছুডা মুক্তি দেওনের জন্যি হইলেও এই টেহা তুমি লও। নতুন নাও কিন। তুমি আবার মেঘনায় তোমার নিজের নাও ভাসাইবা আমি দেইখ্যা শান্তি পামু মাঝি।

মাঝি কিছু বলে না। এসব কথার কি উত্তর হতে পারে মাঝির জানা নেই। উদাস ভাবে তেতুল গাছের ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে থাকা চাঁদটার দিকে তাকিয়ে থাকে। চাঁদটা মেঘেদের সাথে খেলায় মত্ত। একবার ওদের আড়ালে লুকাচ্ছে আবার বেরিয়ে আসছে। মাঝিকে নিরুত্তর থাকতে দেখে রুশনী মাঝির পা ঝাকিয়ে বলে :
-কও মাঝি। তুমি টেহা লইবা। আবার নিজের নাও ভাসাইবা ঐ মেঘনার বুকে। মাঝি কও। ---তুমি না কতা দিছ আমারে? রাখবানা তোমার কথা? রতন মাঝি দুই হাত দিয়ে রুশনীকে পায়ের কাছ থেকে তুলে আনে। এই প্রথম রুশনীর চোখে চোখ রেখে বলে :
-আমি তরে এত্ত বড় একটা কষ্ট দিছি, তর জীবনডারে তছনছ কইরা দিছি। তুই আমারে ঘৃণা করতে পারস না?
-পারি না মাঝি। একটুও পারি না। বিয়ার কতা পাকা হওনের পর থেইক্যা হেই যে তোমারে ভালবাইস্যা ফালাইছি আর ভুলবার পারি না তোমারে। ঘৃণা করবারও পারি না। মাঝির খুব ইচ্ছে করে রুশনীরে একবার, শুধু একবার বুকের মধ্যিখানে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু পারে না। টাকার পুটলিটা হাতে নিয়ে শুধু বলে :
-আমি কাইলই বন্দরে গিয়া নতুন নাও কিন্যা আনমু। মাঝি হনহন করে রুশনীর সামনে থেকে পালাতে চায়। রুশনী আবার পেছন ডাকে।
-আরেকটা কতা মাঝি। মাঝি কান্ত-বিষণ পা দু’টিকে বড় কষ্টে আটকে রেখে ফিরে দাঁড়ায়। কিছু বলে না। তেতুল গাছের ফাঁক দিয়ে চাঁদটার দিকে তাকিয়ে রুশনী বলে :
-এইডা তোমার কাছে আমার একটা আবদার। না রাখো তো আপত্তি করমু না।
-রাখমু রুশনী। ক, কি আবদার তর?
-সামনের অমাবস্যার মাঝ রাইতের নদীতে তোমার নতুন নৌকাত কইরা আমারে লইয়া ভাইস্যা বেড়াইবা একবার। আমার অনেক দিনের ইচ্ছা তোমার পাশে বইসা মেঘনায় ঘুইরা বেড়ামু। একটা আর্তশ্বাস চেপে মাঝি বলে : -তর ইচ্ছা আমি পূরণ করমু রুশনী।

অনেক রাত পর্যন্ত তেল চিটচিটে বালিশটায় মাথা রেখে এপাশ ওপাশ করে কাটায় মাঝি। ঘুম আসে না। জীবনের কোন সঠিক নির্দেশনা খুঁজে পায় না। এ কেমন সুখের স্বাদ এসেছে মাঝির জীবনে। কৃত আপরাধের পাপ বোধ মানুষকে এভাবে আক্রমণ করতে পারে এ উপলদ্ধি মাঝির আগে আসেনি কেন। তাহলে এতবড় অপরাধ মাঝি কখনোই করতো না। জীবনের গতি এমন করে পাল্টে গেল কেন? নিয়মের ছাচে গড়া রতন মাঝির জীবন হঠাৎ করে এমন অনিয়মে পা রাখলো কেন? জীবনের এক বিপর্যয়, এক সর্বনাশ মাঝির জীবনে সত্যিকার জীবনের উপলব্দি এনে দিল। কিন্তু সে উপলব্দি চতুর্দিক থেকে এভাবে এল কেন? ছটফট করে মাঝি? আর ভাবে : রুশনীর জীবনডা আমার জন্যি নষ্ট হইয়া গেল। এত সুন্দর একটা শরীর, এত সুন্দর একটা মুখ, এত সুন্দর একটা মন। সেই মুখ, সেই শরীর, সেই মন, সব আমার জন্যি, আমার জন্যি জীবনের লগে প্রতারণা করল রুশনীর সাথে। এত্ত বড় পাপ আমি করছিলাম কেমনে?

অসহ্য অস্থিরতা মাঝির বুকের মধ্যে সমুদ্রের গর্জন বইয়ে দেয়। বউ ঘুমিয়েছে অনেকক্ষণ। কান্ত শরীরে বেশীক্ষণ জেগে থাকতে পারে না বৌ। তাই শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। বৌ ঘুমিয়ে পড়াতে মাঝিরও ভাবতে সুবিধা হচ্ছে। বৌ জেগে থাকলে হাজারটা প্রশ্ন করে বসত এতক্ষণে মাঝির এই অস্থিরতাকে ঘিরে। কি জবাব দিত মাঝি? কিন্ত জবাব তো একটা দিতেই হবে। কাল না হয় পরশু। পরশু না হয় তার পরদিন। জবাব তো দিতেই হবে। রুশনীকে মাঝি বলেছে কালই বন্দরে গিয়ে নতুন নাও কিনে আনবে। আর সাত-আট দিন পর অমাবস্যা। সেই অমাবস্যার মাঝ রাতের নদীতে রুশনীকে পাশে বসিয়ে মেঘনায় নাও ভাসাবে মাঝি।
কাল যখন নাও কিনে আনবে তখন বৌ এর কাছে কি বলবে মাঝি! কোথায় পেল নাও কিনার টাকা। বৌ এর এ প্রশ্নের কি উত্তর দেবে মাঝি। ভয়ংকর অস্তিরতা মাঝিকে তছনছ করে দেয়। এদিকে ক’দিন ধরে ভাসায়নি মাতব্বরের নাও।

মাঝি চৌকি থেকে নেমে দরজার ঝাপ সরিয়ে উঠোনে নেমে আসে। দু’পা সামনের দিকে ছড়িয়ে একটা কলাগাছে হেলান দিয়ে মাটিতে বসে মাঝি। গভীর একটা আর্তশ্বাস চাপে। উদাস মনে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে ভাবে : জীবনের এই কোন বিপর্যয়ের মধ্যি দাঁড়াইছি আমি? জীবনের কোন চোড়াগলিতে পা ঢুকছে আমার? এইসব আমার কোন পাপের শাস্তি?


আপনের কি হইছে?
-কে! বউ তুই! চমকে উঠে বলে মাঝি।
-কি হইছে আপনের? মাঝি নিজেকে সামাল দেয়।
-তুই ঘুমাস নাই?
-ঘুমাইছিলাম। হঠাৎ জাইগ্যা দেহি আপনি নাই পাশে। তাই উইঠ্যা আইলাম।
পোয়াতি তুই। এত রাইতে বাইরে আইছস খারাপ হইতে পারে। মাঝির লুকোচুরি আচরণ বুঝতে পারে নলীনি। এই লুকোচুরির আড়ালে মাঝির অস্থিরতা নলীনির বুকটাকে কুকড়ে দেয়। ভাবে : আমার স্বামীর এই অস্থিরতার জন্যি কে দায়ী। মাতব্বর না রুশনী? মাতব্বরের কতা মনে হতেই ভয়ে বুক কাপে নলীনির। মতব্বর বড় ভয়ংকর মানুষ। মাঝিরে মাতব্বরের নৌকায় যাইতে মানা কইরা মাঝির আরেকটা সর্বনাস কি খুব তারাতারি ডাইক্যা আনছি আমি! ভয়ে দুরু দুরু করে বুক কাঁপে নলীনির। মাঝির প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে নলীনি পাল্টা প্রশ্ন করে :

-আপনের কি হইছে আমারে কইবেন না?
-এত অস্থির হইছস কেন? কইলামতো হয় নাই কিছু।
-হইছে। আপনের মুখ দেইখ্যাই বুজতে পারি আমি। নলীনি মাঝির একটা হাত চেপে ধরে।
-আমারে কন। দেইখ্যেন ভালা লাগব আপনের। আপনি যহন আমারে অসহ্য কষ্টের মইধ্যে রাখছেন তহনও আমি আপনেরে ভালবাসছি।
-আর অহন আপনিও আমারে ভালবাসেন। অহনও আমি আপনেরে আগের মতই ভালবাসি। আপনের দুঃখের পাশে আমি যদি না খাড়াই তবে আর কে খাড়াইবো কন।

আন্তরিকতার ঝড় বয়ে যায় নলীনির কন্ঠে। সেই ঝড়ে বিধ্বস্ত হয় মাঝির বুকের ভেতর।
মাঝির খুব বলতে ইচ্ছে করে সব কষ্টের কথা। সব যন্ত্রণার কথা। কিন্তু পারে না। জীবনে কিছু কিছু কথা থাকে যা কখনো খুব আপনজনকেও বলা যায় না। বৌ এর মুখটার দিকে তাকিয়ে ভাবে : আল্লায় পিরথীবির বেবাক মাইয়া মাইনসেরে এত্ত ভালা বানাইছে কেন?
মাঝিরে চুপ থাকতে দেখে নলীনি আবার বলে :
-চলেন। ঘুমাইতে চলেন।
-বউ।
-হু! রতন মাঝি ভয় মিশ্রিত কন্ঠে অসংলগ্ন ভাবে বলে :
-পরের নাও না বাইয়া একটা নতুন নাও কিন্যা ফালাইলে কিমুন অয়।
-কিমুন অয় মাইনে! খুব ভালা অয়! আনন্দে গদগদ হয়ে উত্তর দেয় নলীনি। নলীনির সহজ-সরল উত্তরে মাঝিও সহজ হয়।
-তাইলে একটা নতুন নাওই কিন্যা ফালাই।
-হাছাই কইতাছেন?
-হ, বউ।
-কি যে খুশি লাগতাছে। কিন্তু নাও কিনার টেকা পাইবেন কই? মাঝি এ প্রশ্নের জন্য তৈরী থাকলেও এর উত্তর ঠিক করে রাখেনি। ক্ষণিক ভেবে নিয়ে বলে :
-ধার নিমু। পরে আস্তে আস্তে ধার শোধ দিয়া দিমু।
-আমাগরে ধার দিব কেডা?
-দিব। একজনের লগে কতা অইছে।
-কবে কিনবেন নতুন নাও?
-ভাবতাছি কাইলই বন্দরে গিয়া নাও কিন্যা আনমু। নলীনির মুখটা উচ্ছ্বাসে ভরে উঠতে গিয়েও আবার মলিন হয়। মাতব্বরের কথাগুলো মনে পড়ে। মাতব্বর স্পষ্টই নলীনিকে বলেছে তার লোকই রতন মাঝির নৌকার তলা ঝাঝড়া করে দিয়েছে। যদি আবার তাই করে। ভয়ে বুক কাঁপে নলীনির। বিধ্বস্ত কন্ঠে আস্তে আস্তে বলে :
-নাওডা আর কয়দিন পরে কিনলে অয় না?
-না রে বৌ। মাতব্বরের নাও বাইতে তুই না করছস। অহন আরেক জনের নাও বাইলে মাতব্বর উল্টা খেপবো না। তাছাড়া আর কয়দিন পরে নাও কিনলে বাঁচমু কেমনে?

নলীনি এটা ভেবে দেখেনি। মাঝি ঠিকই বলেছে। কিন্তু নলীনি মাঝিকে কি করে বলবে যে মাতব্বরই তার নৌকার তলা ঝাঝড়া করে দিয়েছিল। নলীনি একথা মাঝিকে বলেছে মাতব্বর যদি কখনো তা জানতে পারে আর তখন যদি সত্যি সত্যি নলীনির সারা শরীরটাকে উদাম করে ফেলে মাতব্বর। নলীনি আর কিছু বলে না। বিশন্ন মুখে ডেরা ঘরটায় ঢুকে চৌকিটায় পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে। নলীনির পাশে খানিক বাদে মাঝিও গিয়ে শোয়। নিজেকে কিছুটা হলেও হালকা মনে করে মাঝি। বৌ-এর সাথে দু’একটা কথা বলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কে জানে আবার কখন কোন দিক দিয়ে মনের গোপন দুর্বলতা প্রকাশ পেয়ে যায়। সেই ভয়ে আর কিছু বলা হয় না।

মাঝি পাড়ার সব ডেরা ঘরগুলো শূন্য করে সবাই ছুটে আসে মেঘনার ঘাটে। রতন মাঝির নতুন নাও বাঁধা পড়েছে ঘাটে। সেই নতুন নাও দেখতে মেঘনার ঘাটে ঢল নামে মাঝি পাড়ার বউ, ঝি, ছেলেমেয়েদের। ঘাটে আজ আবার সারিবদ্ধ হয়ে এক কুড়ি সাতটা নৌকা বাঁধা পড়েছে। রতন মাঝির নতুন নাও দেখে একেক জন একেক রকম মন্তব্যে মুখর।

: রতন মাঝির ছাওয়াল রতন মাঝির কপাল ফিরাইয়া দিছে।
: মাতব্বরের নৌকায় কাম কইরা মাঝি কয়দিনেই কামাইছে ভালা।
: মাতব্বররে ভালা মানুষ কওনই লাগে তাইলে।

রতন মাঝি কোন উচ্ছ্বাস দেখায় না। নির্বিকার চিত্তে নৌকাটার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। কারো কোন মন্তব্যও ঢুকে না মাঝির কানে। সবার সাথে দর্শক হয়ে রুশনীও আসে। সবার থেকে আলাদা হয়ে দূরে দাঁড়িয়ে দেখে রতন মাঝির নতুন নাও। উচ্ছ্বাস ভরা অসংখ্য মন্তব্যের পর যে যার কুটিরে ফিরে যায়। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে রুশনী। আর ঘাটায় নাও এর পাশে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকে মাঝি। পাশে নলীনি। মাঝির বুকের ভেতর কষ্টরা গুমরে গুমরে কাঁদে। নলীনি ছোট্ট বাচ্চার মত নৌকাটাকে ধরে ধরে দেখে আর ডুকরে ডুকরে কাঁদে।

-কান্দস কেন বৌ?
-আনন্দে কান্দি। বড় দুঃখে মানুষ কান্দে। আবার বড় আনন্দেও মানুষ কান্দে।
-চল। ঘরে চল। একটা আর্তশ্বাস ফেলে মাঝি পারে উঠার জন্য পেছন ফিরলে চোখে চোখ পরে রুশনীর। করুণ দু’টি চোখ। মাঝি চোখ নামিয়ে আস্তে আস্তে পারে উঠে বউ-এর পাশাপাশি হেঁটে চলে নিজের ডেরার দিকে।

রিটা আশরাফের ধারাবাহিক উপন্যাস ‘মধ্য রাতের নদী’-এর ৯ম পর্ব আসছে... চোখ রাখুন সোনালীনিউজ-এ

কথাসাহিত্যিক ড. রিটা আশরাফ
নরসিংদী জেলার সদর থানার চিনিশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই লেখালেখিতে হাতেখড়ি। নরসিংদী সরকারি কলেজে পড়ার সময় স্বরচিত কথাসাহিত্য প্রতিযোগিতায় বহুবার প্রথম পুরস্কার লাভ করেন। কথাসাহিত্য রচনায় প্রথম পুরস্কার লাভ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল থেকেও।


ড. রিটা আশরাফ বর্তমানে বেসরকারি এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের (এইউবি) বাঙলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং একই সঙ্গে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন দীর্ঘদিন থেকেই। তাঁরই সম্পাদনায় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য পত্রিকা। পেয়েছেন ভারতের বিশ্ববঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন সম্মাননা (২০১৪), ভিন্নমাত্রা সাহিত্য সম্মাননা (২০১০), গঙ্গা-গোবিন্দ সাহিত্য সম্মাননা (২০১৫), এশিয়ান ইউনিভার্সিটি সহিত্য পত্রিকা সম্মাননাসহ বেশ কয়েকটি পুরস্কার ও সন্মাননা।


রিটা আশরাফের প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে বালুচরে বসতি (উপন্যাস), নৈবেদ্যর নারী (উপন্যাস), বিবর্ণ স্বাধীনতা (উপন্যাস), একটু ভুলের অনুভূতি (উপন্যাস), তুতুলের খড়গোশ শিকার (শিশুতোষ গল্প), মামদোভূতের পুত (শিশুতোষ গল্প সংকলন) বাংলাদেশের স্বাধীনতা আনলো যাঁরা (গবেষণা), নজরুল সাহিত্যে তৎকালীন বিশ্ব (গবেষণা), নজরুলের কুহেলিকা : একটি সার্বিক পর্যালোচনা (গবেষণা), নজরুল সাহিত্যে উপমা (গবেষণা) ইত্যাদি।

মধ্য রাতের নদী (পর্ব-০৭)


সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি

Wordbridge School
Link copied!