• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সাম্প্রদায়িক ষড়যন্ত্রের শিকার আ.লীগ সাংসদ মোকতাদির!


হাসান শান্তনু জানুয়ারি ৬, ২০১৭, ০১:১৯ এএম
সাম্প্রদায়িক ষড়যন্ত্রের শিকার আ.লীগ সাংসদ মোকতাদির!

গেল শতাব্দিতে সমাজতন্ত্রের ‘পতন’ ঘটাতে সাম্রাজ্যবাদীরা ইসলামকে আফগানিস্তানের মাদক ব্যবসায়ী আর তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের বর্বর মওদুদীদের মাধ্যমে এ অঞ্চলে ভয়ানকভাবে বিকৃত করে। পশ্চিমা পুঁজিবাদীরা এ ধর্মকে বিকৃত করে উগ্র রুপ দিতে দাঁড় করায় পুরোপুরি ‘সুপারলেটিভ ডিগ্রি’র ওপর। 

মৌলবাদীদের মগজে ধর্মকে গেঁথে দেয়া হয় অন্য ধর্মের মানুষকে হত্যা ও তাদের সম্পদ লুটের ‘জিহাদি’ হাতিয়ার হিসেবে। জন্ম ইতিহাসে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পয়তাল্লিশ বছর পরও এখানে ‘জিহাদের’ পরম্পরা চলছে। 

রাষ্ট্রপিতা, সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর থেকে কথিত ধর্ম রক্ষার নামে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর হামলা চলছে রাষ্ট্রের সনাতন, খ্রিষ্ট, বৌদ্ধসহ অন্য ধর্মের নাগরিকদের ওপর। সনাতন ধর্মের অনুসারীদের উপর হামলা, তাদের মন্দির, প্রতিমা ভাঙচুরের ধারাবাহিকতার সবশেষ ‘আলোচিত’, নিন্দিত ঘটনাটি ঘটে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে গেল বছরের ৩০ অক্টোবর।

ওই মৌলবাদী তাণ্ডবের পর ‘মধ্যমেধার সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর তৃতীয় শ্রেণি মার্কা ষড়যন্ত্রের শিকার’ হন ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের সাংসদ, রাজনীতিতে পরিচ্ছন্নতার অন্যতম পথিকৃৎ র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী। অথচ আক্রান্ত এলাকাও তার সংসদীয় আসনের সীমানার বাইরে। অপশক্তির পাড়া থেকে রমরমা সংবাদের অনুকরণে রটানো হয়-হামলার পেছনে নাকি তার ‘সমর্থকরা’ জড়িত! 

‘পুলকিত বোধ করার’ দিক হচ্ছে, অন্ধকার শক্তি এবারই প্রথম সাম্প্রদায়িক হামলার জন্য মোকতাদিরের মতো আজন্ম অসাম্প্রদায়িক এক রাজনীতিকের বিরুদ্ধে কুৎসা রটাতে যথারীতি যৌন উদ্দীপক শব্দ বা গল্পের আশ্রয় নিচ্ছে, যৌনতা সম্পর্কে যদিও এভাবে প্রকাশ্যে বলা মৌলবাদীরা 'হারাম' বলেই হরহামেশা ফতোয়া দেয়!

যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা মোকতাদিরের জন্য চরম লজ্জার বিষয় হচ্ছে, বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে তার বিরুদ্ধে দেশের জাতীয় একটা ইংরেজি দৈনিকে রসালো ভাষায় ভয়ংকর বানোয়াট গল্প ছাপা হয়েছে। যৌন পত্রিকার প্রতিবেদকরা এ দেশের কোনো সাংসদকে নিয়ে এমন উদ্ভট গল্প এর আগে লিখেছেন বলে কোনো উদাহরণ আমাদের জানা নেই। 

নাসিরনগরে হামলার পর সুশীল সমাজ, প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল, একাত্তরের ঘাতকদের বিচারের দাবিতে লড়াইরত বুদ্ধিজীবীদের সংগঠন ইতোমধ্যে আলাদা সরেজমিন তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে গণমাধ্যমের কাছে। সেসব প্রতিবেদনের কোথাও উঠে আসেনি যে, ওই হামলার পেছনে মোকতাদিরের ‘সমর্থকরা’ জড়িত ছিলেন! 

রাজনীতির মাঠে শাসক দল আওয়ামী লীগের ‘প্রতিপক্ষ’ বা ‘শত্রুপক্ষ’ বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বের ২০ দলের জোটের কোনো নেতাও প্রকাশ্যে উচ্চারণ করেননি- মোকতাদিরের ‘লোকরাই কাজটা করেছেন’। অথচ, অশুভ শক্তির মদদে সংখ্যালঘুদের ওপর ওই হামলার পর প্রথমে বাংলা, পরে ইংরেজি খবরের কাগজে মোকতাদিরের বিরুদ্ধে নির্লজ্জ নোংরা সংবাদ ছড়ানো হচ্ছে!

গ্রামীণ বাংলার এক গ্রাম থেকে উঠে এলেও সংবাদকর্মী হওয়ার সুবাদে হোটেল রুপসী বাংলা, বস্তিপাড়া থেকে মন্ত্রীপাড়া, পতিতালয় থেকে সচিবালয়, ঘরের পাশের থানা থেকে শুরু করে আইন শৃঙ্খলা রক্ষার বিভিন্ন সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তার কার্যালয় পর্যন্ত আমাদের যাওয়া-আসা আছে। নাসিরনগরের ঘটনার পর গোয়েন্দা সংস্থাও আলাদা তিনটি প্রতিবেদন দিয়েছে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কাছে।

তাদের প্রতিবেদনের কোথাও উল্লেখ নেই, রাজনৈতিক ফায়দা লুটবার জন্য মোকতাদিরের কথিত সমর্থকরাই ওই হামলার আগে বা পেছনে ছিলেন। এরপরও একাত্তরের অপশক্তির সহযোগীরা কীসের ভিত্তিতে অপপ্রচার চালাচ্ছেন, এটা বেশ উদ্দীপক প্রশ্ন!

মৌলবাদীরা হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, মন্দির, প্রতিমা ভাঙচুরের মধ্যযুগীয় তাণ্ডব চালানোর পর নাসিরনগর এলাকার সাংসদ এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী ছায়েদুল হক স্থানীয় সংখ্যালঘু নেতাদের উদ্দেশ করে ‘মন্তব্য’ করেন- ‘মালাউনের বাচ্চারা বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি করছে। আর এ ঘটনাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে প্রচার করে অতিরঞ্জিত করেছে সাংবাদিকরা। অথচ ঘটনা কিছুই নয়'(তথ্যসূত্র: দৈনিক ভোরের কাগজ, ০৩.১১.'১৬ খ্রি.)। 

সংখ্যালঘুদের পাকি কায়দায় মন্ত্রীর গালি দেয়ার বিরুদ্ধে ফুসে ওঠে রাষ্ট্রের প্রগতিশীল সমাজ। ওই ‘বক্তব্যের’ কারণে তার বিরুদ্ধে ঢাকা ও কুমিল্লার আদালতে মানহানির দুটি মামলা হয় বলে ৯ নভেম্বরের পত্রিকার খবর। ছায়েদুল হকের পদতাগ আর ন্যক্কারজনক ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে শুভবোধের মানুষরা বিবেকের সব বোতাম খোলা রেখে যখন প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, ঠিক সেই সময়ই ঘটনার খেলারামরা শুরু করেন অন্য খেলা। তারা ঘটনার 'দায়' মোকতাদিরের ওপর চাপানোর নতুন ষড়যন্ত্র নিয়ে মাঠে নামেন! তাদের এ ষড়যন্ত্রে রসদ যোগায় কুসাংবাদিকতা।

নাসিরনগরের আক্রান্তস্থল পরিদর্শন শেষে ঢাকায় ফিরে বিএনপির প্রতিনিধি দল ৫ নভেম্বর তাদের হাল আমলে বিশেষভাবে চর্চিত সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। ওই সম্মেলনে দলটির কেউ অভিযোগ করেননি যে, হামলার পেছনে মোকতাদিরের ‘হাত’ আছে। দলটির ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজ উদ্দিন আহমদ সংবাদ সম্মেলনে হামলা চলকালে পুলিশের কার্যকর ভূমিকা না থাকা বা প্রশাসনের ব্যর্থতার সমালোচনা করেন।

তাণ্ডরের বিষয়ে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সরেজমিন প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে গত ১১ ডিসেম্বর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন- ‘জমি দখলের উদ্দেশে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে ব্যবহার করে হিন্দুদের উপর হামলা হয়েছে। ...আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে কাজে লাগিয়ে বিএনপি-জামায়াত, হেফাজত ও মৌলবাদী গোষ্ঠী হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির ও বাড়ি-ঘর ভাংচুরসহ লুটপাটের মাধ্যমে বর্তমান সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়’ (দৈনিক ইত্তেফাক, ১২.১২.'১৬)।

৩ নভেম্বর নাসিরনগরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন সাবেক তত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল, নিজেরা করি’র সমন্বয়ক খুশী কবির, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি তারিক আলী, ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পংকজ ভট্টাচার্য, সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী মঞ্চের নূর মোহাম্মদ প্রমুখ। একই দিন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কর্মকর্তা, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের কয়েক নেতা আর সিপিবি'র কয়েক নেতা ঘটনাস্থলে যান। 

তারা অনেক আক্রান্ত ও তাদের স্বজনের সঙ্গে কথা বলেন। এ বিষয়ে তারা ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে, বা পরে ঢাকায় ফিরে গণমাধ্যমের কাছে বক্তব্য দেন। তাদের কারো বক্তব্যে উল্লেখ নেই, মোকতাদিরের কথিত লোকরাই ওই তাণ্ডবের সঙ্গে জড়িত।

১০ নভেম্বর নাসিরনগরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যায় জাতীয় পার্টির মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদারের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল। ওই সময় তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের দল থেকেও হামলার জন্য আরেক আসনের সাংসদ মোকতাদিরকে দায়ী করে কোনো বক্তব্য দেয়া হয়নি।

শিক্ষা, সংস্কৃতিসহ সমাজের প্রতিটি বিনির্মাণে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় মোকতাদির চৌধুরী এগিয়ে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধুর আর্দশ সামনে রেখে। তার বিরুদ্ধে শুধু মধ্য কেন, অতি উচু মেধার কোনোও ষড়যন্ত্রও সফল হবে না। অপসাংবাদিকতার মাধ্যমে সাহসী, মানবিক মনের এ রাজনীতিবিদের অর্জনে একটা আচড় লাগানোও অসম্ভব। পাঠকরাও বুঝে গেছেন, তাদের বিভ্রান্ত করতেই এসব উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপসংবাদ। 

তিতাসপাড়ের উন্নয়নের রূপকার মোকতাদির ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘পাক্ষিক মত ও পথ’ নামে চিন্তাশীল কাগজের সম্পাদক। পরম সাংবাদিকবান্ধব তিনি। জাতীয় দৈনিক, টিভি চ্যানেলের অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ সাংবাদিকের সঙ্গে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। আছে স্নেহ, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার সম্পর্ক। তাকে নিয়ে যে কয়েকটা প্রচারমাধ্যমে উদ্ভট গল্প ছাপানো হয়েছে, সেগুলোতে তিনি অন্তত সম্পর্কের জায়গা থেকেও কোনো প্রতিবাদপত্র পাঠাননি। এ যেন তার- ‘সত্যবদ্ধ অভিমান’। জয় হোক সত্যের।

লেখক: সাংবাদিক, গণমাধ্যম গবেষক।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!