• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

“প্রধান বিচারপতির পক্ষে বিএনপির অবস্থান নীতিগত নয়, কৌশল মাত্র”


ব্যারিস্টার এবিএম আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার অক্টোবর ১৯, ২০১৭, ০৯:৩১ পিএম
“প্রধান বিচারপতির পক্ষে বিএনপির অবস্থান নীতিগত নয়, কৌশল মাত্র”

ঢাকা: ইংরেজি ভাষায় প্রাচীন প্রবাদ আছে: "The enemy of my enemy is my friend" “শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু” এ কারণেই বিএনপি’র প্রধান বিচারপতির প্রতি এত অস্বাভাবিক প্রীতি! প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য থাকতে পারে কিন্তু কোনো বিরোধ বা শত্রুতা নেই; যা থেকে বিএনপি লাভবান হতে পারে। তবুও উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে বিএনপি মরিয়া। যারা মনে করে বাঙালি জাতি খুব সহজে সব ভুলে যায় তারা বাঙালির স্বভাব চিনে নাই।

বাঙালি ভুলেনি ১৯৮২ সালের ১১ এপ্রিল তৎকালীন এরশাদের সামরিক সরকার চাকরির বয়স কমিয়ে বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেনকে প্রধান বিচারপতির পদ হতে জোরপূর্বক অপসারণ করে। তিনি এজলাসে আসলে পত্রপাঠে বিদায় জানানো হয়, অথচ তিনি এ বিষয়ে অবগতই ছিলেন না। বাঙালি আরো ভুলেনি মাত্র কয়েকদিন আগে যুদ্ধাপরাধীদের আপীল বিচারের রায় পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় মাননীয় প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে তাদের বিষোদাগার!

এমনকি আদালত অবমাননাকর বক্তব্যও তারা দিয়েছেন। তারা ফাঁসিরদণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে একদিকে এ আদালত প্রাঙ্গণকে কলুষিত করেছেন অন্যদিকে শুধু প্রধান বিচারপতিকেই নয় সমগ্র বিচার বিভাগকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। আমরা আরো ভুলিনি যে, বিএনপি সরকারের সময় প্রধান বিচারপতির বয়স ৬৫ থেকে ৬৭ বাড়িয়ে দেয়া হলো। যিনি সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত হয়েছেন, তিনিই হবেন প্রধান উপদেষ্টা।তাই বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক কে এম হাসানকে প্রধান উপদেষ্টা বানানোর চক্রান্ত করলো যাতে তিনি ভোট কারচুপির সুযোগ করে দেন।

বিএনপি শাসনাধীন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ আইনমন্ত্রী থাকাকালীন এজলাসে বিচারপতিকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছিল। এজলাস থেকে বিচারপতি নামতে বাধ্য হয়েছিলেন। যারা বারবার আদালতকে অসম্মান করেছে, আইন অমান্য করেছে তাদের মুখে বিচার বিভাগ নিয়ে কথা বলা ভূতের মুখে রাম রাম নাম ছাড়া কিছুই নয়।

আলোচ্য বিষয় সম্বন্ধে জানতে গেলে তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও পরিমণ্ডলের ওপর কিছুটা আলোকপাত করা প্রয়োজন। যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর চূড়ান্ত রায় প্রকাশের আগে দৈনিক জনকণ্ঠে স্বদেশ রায় একটি নিবন্ধে উল্লেখ করেন, ‘কিভাবে যারা বিচার করছেন সেই বিচারকদের একজনের সঙ্গে গিয়ে দেখা করে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পরিবারের লোকেরা?’ সাকা চৌধুরীর রায় ঘোষণার পর প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে জনকণ্ঠ সম্পাদক ও নিবন্ধের লেখকের বিরুদ্ধে রুল জারি করেন।

অত্র মামলার শুনানিতে জনকণ্ঠের আইনজীবী একটি অডিও রেকর্ডের শ্রুতিলিখন উপস্থাপন করেন, যা বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর যুদ্ধাপরাধ মামলা এবং মওদুদ আহমদের বাড়ি নিয়ে মামলার বিষয়ে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে অন্য এক বিচারকের কথোপকথন বলে দাবি করেন। উক্ত কথোপকথনে জানা যায়, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর যুদ্ধাপরাধ মামলা এবং মওদুদ আহমদের বাড়ি নিয়ে মামলায় বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক যেন না থাকেন সেই অনুরোধ করা হয় এবং পরবর্তীতে অনুরোধে ঢেকি গিলে প্রধান বিচারপতি তাকে বাদ দেন। প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে আপিল বেঞ্চ আলোচিত এই অবমাননা মামলায়ও বিচারপতি মানিক সাহেবকে না রাখে দুই সাংবাদিককে শাস্তিস্বরুপ সেখানে অবস্থান করতে বলেন এবং আর্থিক জরিমানাও করেন।

প্রণিধানযোগ্য, যে দুইজনের নাম এখানে এসেছে তারা দুই জনই বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক। এখন আইনগত প্রশ্ন হলো যে, যার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে এবং অত্র মামলার যিনি অভিযোগকারী তিনিই বিচারকের আসনে বিচার করতে পারেন কিনা? "Nemo judex in causa sua (or nemo judex in sua causa) is a Latin phrase that means, literally, "no-one should be a judge in his own cause." It is a principle of natural justice that noperson can judge a case in which they have an interest." “কোনো ব্যক্তি নিজের বিচার নিজে করতে পারেন না” অর্থাৎ ‘ন্যায়বিচার সুরক্ষার্থে তিনি তা করতে পারেন না।’

বিচার বিভাগের মর্যাদা রক্ষাকারী বিএনপিপন্থীরা কেউই এ প্রশ্ন তোলেননি। বরং তামাশা দেখেছেন এই মনে করে যে সরকারের নিয়োগ করা প্রধান বিচারপতিই বুমেরাং হয়ে গেল। এরপরই একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আয়োজিত এক আলোচনায় খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির আদেশ পাওয়া মীর কাসেম আলীর আপিল মামলা পুনঃশুনানির দাবি জানান। একই অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মোজাম্মেল হকও প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে কিছু মন্তব্য করেন। আবারো স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি দুই মন্ত্রীকে আদালত অবমাননায় দোষী সাব্যস্ত করে আপীল বিভাগ ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করে। আর স্বাধীনতা বিরোধীরা এবার নিশ্চিত হলো যে স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তিদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চূড়ান্তে।

চলতি বছর ১ আগস্ট বহুল আলোচিত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে আপিল বিভাগ পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করে। এ রায়ে পর্যবেক্ষণ হিসেবে যেসব বিষয় আনা হয়েছে সেগুলো মামলার মূল বিষয়বস্তু থেকে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। এই রায়ে মাননীয় প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা নিজের পর্যবেক্ষণের অংশে দেশের রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি, সুশাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সমালোচনা করেন। প্রধান বিচারপতি রায়ে লিখেছেন: "No nation - no country is made of or by one person" “কোনো একক ব্যক্তি নিয়ে অথবা তার দ্বারা কোনো জাতি-দেশ গঠিত হয়নি।” তার এই বক্তব্যে সবাই মর্মাহত। ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাঙালির স্বাধীনতার লড়াইয়ে বঙ্গবন্ধুর অবদানের কথা সবার স্মরণ থাকা উচিত।

আজ স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর এই বাস্তব সত্যকে পুনরাবৃত্তি করতে হচ্ছে, সেটাই আমাদের জন্য অনেক কষ্টের এবং লজ্জার। ফলে সরকারের ভেতরে বাইরে ও দলীয় পর্যায়ে ক্ষোভ ও প্রতিবাদ অব্যাহত থাকে এবং আইনজীবীদের একটি বড় অংশ প্রধান বিচারপতির পদত্যাগে আন্দোলনে নামেন। এমতাবস্থায় প্রায় দেড়মাসের অবকাশ শেষে ৩ অক্টোবর সুপ্রিমকোর্ট খুলেছে এবং প্রথা অনুযায়ী মাননীয় প্রধান বিচারপতি বার ও বেঞ্চের মধ্যে সাক্ষাত অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন।

এ উপলক্ষে বিএনপি সমর্থিত বারের সাধারণ সম্পাদক (বিএনপির যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক) সাহেব অতি উৎসাহী হয়ে অতিরিক্ত খুদে বার্তা পাঠিয়ে অতিষ্ঠ করে তোলেন! কিন্ত আগের দিনই খবর আসে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা নিজেই ছুটিতে গিয়েছেন।

সরকারের চাপের মুখে প্রধান বিচারপতি ছুটিতে যেতে বাধ্য হয়েছেন বলে মনে করেন বিএনপিপন্থী আইনজীবী ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি (বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান)। অব্যাহত টানাপড়েনের মাঝে মাননীয় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বিবিসি বাংলাকে বলেন, “প্রেসিডেন্টকে লেখা চিঠিতে প্রধান বিচারপতি জানিয়েছেন তিনি ক্যান্সারের রোগী, আরো অন্যান্য রোগে তিনি আক্রান্ত। ফলে তার বিশ্রাম দরকার।” বিএনপি ঘোলাপানিতে মাছ শিকারের সুযোগ হাত ছাড়া করেনি। বিএনপির নালিশ সংস্কৃতির ধারাবাহিকতায় ১১ অক্টোবর হোটেল লেকশোরে ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে এক শালিস বৈঠক ডাকে।

বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রধান বিচারপতিকে জোর করে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। তিনি এখন সরকারের নিয়ন্ত্রণে। দেশের বাইরে পাঠাতে সরকার এখন নানাভাবে তার ওপর চাপ দিচ্ছে। সরকারের এ আচরণের কারণে অন্য বিচারপতিরাও স্বাধীনভাবে বিচারকার্য করতে পারবেন না। অরণ্যে রোদন, প্রধান বিচারপতির দুর্নীতি বিষয় উপস্থাপন না করায় সুইডিশ হাই কমিশনার Ms. Charlotta Schlyter তথ্য স্বল্পতার পাল্টা অভিযোগ করেন। ফলে পুরো অপচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, চীনসহ ২০টি দেশ ও তিনটি সংস্থার প্রতিনিধিরা অংশ নেন। অন্য দেশগুলো হচ্ছে- ডেনমার্ক, সুইডেন, নরওয়ে, মালদ্বীপ, নেপাল, কানাডা, জার্মানি, জাপান, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, শ্রীলংকা, সৌদি আরব, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও মরক্কো। সংস্থাগুলোর মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল (ডিআই) ও ইউএসএইড।

সর্বশেষ বাংলাদেশ ছাড়ার আগে বিচারপতি সিনহা সাংবাদিকদের কাছে বিলি করা এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, যেভাবে প্রধানমন্ত্রী থেকে মন্ত্রীরা তার সমালোচনা করে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে তিনি বিব্রত। তিনি একই সঙ্গে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়েও আশংকা প্রকাশ করেছিলেন। উল্লেখ্য, প্রধান বিচারপতি নিজ হাতে স্বাক্ষর করা চিঠিতে অসুস্থতার কথা বলেছেন। এখন বলছেন তিনি সুস্থ আছেন। আবার এটাও সত্যি যে চিঠি দু'টির স্বাক্ষরে সাদৃশ্য রয়েছে এবং হুবহু। তবে তিনি তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। যেমনটি করেনি বিএনপি!

এমতাবস্থায় সুপ্রিমকোর্ট রেজিস্টার জেনারেলের স্বাক্ষরযুক্ত একটি  বিবৃতি প্রদান করে, ‘গত ৩০ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা ছাড়া আপিল বিভাগের অন্য ৫ জন বিচারপতিকে বঙ্গভবনে আমন্ত্রণ জানান। দীর্ঘ আলোচনার এক পর্যায়ে রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বিরুদ্ধে ১১টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ সম্বলিত দালিলিক তথ্যাদি হস্তান্তর করেন। এর মধ্যে বিদেশে অর্থপাচার, আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি, নৈতিক স্খলনসহ আরও সুনির্দিষ্ট গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।

এ সিদ্ধান্তের পর ৫ জন বিচারপতি তাকে সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন যে, এমতাবস্থায় অভিযোগগুলোর সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত তার সঙ্গে একই বেঞ্চে বসে তাদের পক্ষে বিচারকার্য পরিচালনা করা সম্ভব হবে না। এ পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা সুষ্পষ্টভাবে বলেন যে, সেক্ষেত্রে তিনি পদত্যাগ করবেন। অতপর ২ অক্টোবর তিনি বিচারপতিদেরকে কোনো কিছু অবহিত না করেই রাষ্ট্রপতির কাছে একমাসের ছুটির দরখাস্ত দিলে রাষ্ট্রপতি তা অনুমোদন করেন।’ এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম বলেছেন, প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের পর সুপ্রিম কোর্ট বসে থাকলে দেশবাসী বিভ্রান্তিতে পড়ত। এ উদ্যোগে সকল বিতর্কের অবসান হবে।

যেহেতু এস কে সিনহার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোর নথি বিচারপতিদের হাতে দিয়েছেন খোদ রাষ্ট্রপতি, সুতরাং এর তদন্ত হবেই এবং মি. সিনহাকে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। তার দেয়া রায় অনুযায়ী সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করেই হয়তো তার বিচারের উদ্যোগ নেয়া হবে। আবার দুদকও এর তদন্ত করতে পারে বলে আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন। সুতরাং আগামী ৩১ জানুয়ারি এস কে সিনহার মেয়াদ শেষ হলেও এই ইস্যুটা এখানেই শেষ হচ্ছে না। আবার যদি তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো প্রমাণিত হয় এবং তিনি যদি শাস্তি পান, তাহলে এটি দেশের ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা হবে।

চলমান উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিএনপি প্রধান বিচারপতির পক্ষে সরব অবস্থান নিলেও তাদের অন্যতম রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতে ইসলামী নিরব পর্যবেক্ষকের ভুমিকা পালন করছে। জামায়াত মনে করে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তাদের শীর্ষ নেতাদের যে ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে, সেখানে সরকারের সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার হাত দিয়েই। এই ঘটনায় বিএনপি উল্লসিত হলেও জামায়াত মনে করছে, এখানে সন্তুষ্ট হওয়ার কিছু নেই।

বিএনপি যে এত খুশি হয়ে রায়টিকে যে তারা স্বাগত জানাচ্ছে, তারা কি ভালো করে পড়ে দেখেছে বিচারপতি সিনহা সামরিক শাসনামলের সমালোচনা করে বলেছেন: “এসব অগণতান্ত্রিক শাসনামলের নোংরা রাজনীতি চর্চা আমাদের সার্বিক জনরাজনীতির মারাত্মক ক্ষতি করেছে।” রায়ের এই অংশের সঙ্গে কি তারা সহমত পোষণ করে? যদি করে তাহলে প্রশ্ন হল, অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে, ধোঁকাবাজির রাজনীতির প্রবর্তক হয়ে আজ এত বড় গলায় কথা বলছে কোন নীতি-নৈতিকতা মান্য করে? বর্তমানে বিচার বিভাগের সম্মান রক্ষার্থে বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের মায়াকান্না দেখে মনে হচ্ছে ‘ভক্ষকই যখন রক্ষক’!

একথা অনস্বীকার্য যে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার দেশকে স্থিতিশীল রেখে উন্নতির অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে ঠিক সেই সময় এই বিতর্কিত রায় অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করেছে। গত সাড়ে আট বছরে বিএনপি-জামায়াত যে ইস্যু তৈরি করতে পারে নাই, এই রায় তাদের হাতে মোক্ষম অস্ত্র তুলে দিয়েছে। এমনকি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এই রাজনৈতিক দলটি একরাতে চাঙা হয়ে মাঠ পর্যায়ে কর্মমুখী করে তোলে। প্রধান বিচারপতি সিনহা একজন প্রচারমুখী ও বিনোদন ব্যক্তিত্ব রূপে নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তুলেন। অর্থহীন অনুষ্ঠানে নিজের উপস্থিতি ও আদালতের প্রাসঙ্গিক বিষয়াদি পাবলিকলি বলা।

সর্বোপরি পবিত্র আদালতের এজলাসে বসে ও মিডিয়ায় একের পর এক রাজনৈতিক বক্তব্য প্রদান করে আসছিলেন। সরকারকে প্রায়শই বিব্রতকর অবস্থায় ফেললেও সংশ্লিষ্ট মহল সর্বদায় নিরব থেকেছে, যদি প্রথমেই তাকে তার সীমাবদ্ধতা স্মরণ করিয়ে দেয়া হতো তাহলে আজ এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হতো না, আর বিএনপির মত অর্থব দল পরের মাথায় কাঁঠাল ভাঙার সুযোগও পেত না।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি আছে। এই বিপক্ষ শক্তি মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান স্বীকার করতে চান না। কারণ, জিয়াউর রহমান তাহলে বিলীন হয়ে যায়। প্রধান বিচারপতির বক্তব্য এদের উৎসাহিত করেছে। এতদিন বিএনপি মিথ্যা কথা বলে আসছিল যে, একক ব্যক্তি দ্বারা জাতি-দেশ গঠিত হয়নি; এই রায়ের সূত্র ধরে বিএনপি তাদের হাতে শক্ত হাতিয়ার পেল। এই হলো বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ও তাঁর সত্য উচ্চারণ ও সাহসী ভূমিকা, যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ভিত আলগা করে দেওয়ার পথ তৈরি করেছে।

এই রায়ে সরকারের সমালোচনা করায় আওয়ামী লীগের যদি সুনাম ক্ষুণ্ণ হয়, তাহলে বিএনপির রাজনীতিতে থাকাই উচিত নয়। কারণ বিচারপতি সিনহা রায়ে উল্লেখ করেছেন, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা দেশটা ‘ব্যানানা রিপাবলিক’ করেছেন, ধোঁকাবাজির রাজনীতি করেছেন। বাংলা ভাষায় একটি প্রবাদ আছে, ‘পাগলের সুখ মনে মনে’। বিএনপির খুশি ও সুখ-সুখ ভাব দেখে তাই মনে পড়ছে। আসলে বিএনপি প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার যে পক্ষ অবলম্বন করছে তা নৈতিক নয় রাজনৈতিক, নীতিগত নয় কৌশল মাত্র!

লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট

সোনালীনিউজ/এমএইচএম

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!