টিকা গ্রহণে পুরুষরা এগিয়ে

বেড়েছে নারী মৃত্যুহার

  • বিশেষ প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: আগস্ট ২৬, ২০২১, ০৬:২৩ পিএম
ছবি : সংগৃহীত

ঢাকা : করোনা মহামারির শুরুতে পুরুষরা বেশি আক্রান্ত হলেও সম্প্রতি নারীদের আক্রান্তের হার বেড়েছে। সেইসাথে বেড়েছে নারীর মৃত্যুহারও।

এজন্য ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের প্রকোপ, টিকা গ্রহণে নারীদের পিছিয়ে থাকা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিসহ বিভিন্ন কারণ দায়ী বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এদিকে দেশে করোনা সংক্রমণের তীব্রতা কিছুটা কমায় ও সরকার লকডাউন শিথিল করায় সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা আবারো কমতে শুরু করেছে।

এমন পরিস্থিতিকে ভয়ানক মন্তব্য করে স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্টরা সবাইকে সতর্ক করে বলেছেন, মাস্ক ব্যবহারসহ স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে না মানলে আবারো মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে করোনা।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানান, প্রতিনিয়ত ধরন পাল্টাচ্ছে করোনা। এ কারণে ভাইরাসটির গতি প্রকৃতির বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে খুব বেশি বলতে পারছেন না বিশেষজ্ঞরা। তাই এক সময় এই ভাইরাসে পুরুষরা বেশি আক্রান্ত হলেও এখন সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার নারী-পুরুষের প্রায় সমান।

মহামারীর শুরুতে পুরুষদের মৃত্যুহার বেশি হওয়ার জন্য তাদের ঘরের বাইরে বেশি যাওয়াকে কারণ হিসেবে দেখছিলেন বিশেষজ্ঞরা। বিপরীতে নারীদের ঘরের বাইরে কম বের হওয়ার পাশাপাশি তাদের প্রাকৃতিকভাবে রোগ প্রতিরোধের শক্তি বেশি থাকার কথাও বলছিলেন তারা।

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত দেড় বছরে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দেশে যত পুরুষ মারা গেছে, নারী মারা গেছে অর্ধেকেরও কম। মোট সংখ্যার হিসেবে নারীর মৃত্যু কম হলেও ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিস্তারের পর চলতি আগস্ট মাসে দেখা গেছে ব্যাপক পরিবর্তন।

দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের ঠিক এক বছর পর গত ১ এপ্রিল পর্যন্ত মারা যাওয়া মানুষের মধ্যে পুরুষ ছিল ৭৫ দশমিক ২০ শতাংশ, নারী ছিল ২৪ দশমিক ৮০ শতাংশ।

আর গত দুই সপ্তাহে মৃত্যুর ক্ষেত্রে লিঙ্গভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১১ থেকে ২৪ আগস্ট পর্যন্ত এক হাজার ৯০ জন নারী এবং এক হাজার ২৬২ জন পুরুষ করোনাভাইরাসে মারা গেছেন।

শতকরা হিসাবে এই দুই সপ্তাহে নারীর মৃত্যুর হার ৪৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ। অথচ সামগ্রিক মৃত্যুহারে নারী ৩৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ, পুরুষ ৬৫ দশমিক ২৫ শতাংশ।

করোনায় নারীদের মৃত্যুহার বৃদ্ধির জন্য টিকা গ্রহণে তাদের পিছিয়ে পড়াকে অন্যতম কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। মহামারি নিয়ন্ত্রণে প্রায় এক বছর পর সরকার করোনাভাইরাসের টিকাদান শুরু করে গত ফেব্রুয়ারিতে। টিকা নেওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষরা এগিয়ে গেলেও নারীরা ঝুঁকিতে রয়ে গেছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, মঙ্গলবার (২৪ আগস্ট) পর্যন্ত দেশে প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছেন এক কোটি ৭২ লাখ ৪২ হাজার ৪৭৯ জন। যার মধ্যে পুরুষ ৯৯ লাখ ৬৮ হাজার ৯৩৪ জন, নারী ৭২ লাখ ৭৩ হাজার ৫৪৫ জন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উপদেষ্টা ডা. বে-নজির আহমেদ মনে করেন, হরমোনাল কারণে এতদিন নারীরা সুরক্ষা পাচ্ছিলেন। তবে টিকা নেওয়ার কারণে পুরুষরা এখন এগিয়ে গেছে।

তিনি  বলেন, যে পুরুষরা এক ডোজ বা দুই ডোজ টিকা নিয়ে আক্রান্ত হচ্ছে, তাদের মৃত্যুহারটা তুলনামূলক কম। পুরুষদের মৃত্যুটা হয়ত সে কারণে কম। আর নারীদের টিকাগ্রহণের হার কম।

পুরুষরা আগে যে সুরক্ষাটা পেত না, তারা বেশি আক্রান্ত হত, বেশি মারা যেত, নারীরা হরমোন দিয়ে যে সুবিধা পেত, এখন পুরুষরা ভ্যাকসিন দিয়ে সমমানের একটা সুরক্ষা পাচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, হরমোনাল কারণে যে সুরক্ষা নারীরা এতদিন পেতেন, সেটা হয়তো ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে পাচ্ছেন না। যেমন শিশুরা এখন তুলনামূলক সংক্রমিত হচ্ছে বেশি। তবে পুরুষ কিংবা নারী কতজন আক্রান্ত হচ্ছেন এবং সেই আক্রান্তদের মধ্যে কতজন মারা যাচ্ছেন; এগুলো দেখা দরকার।

এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং আমাদের এ বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে যে, নারীরা বেশি ঝুঁকিতে থাকলে সেটার কারণ কী তাও বের করতে হবে।

আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেনও মনে করেন, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে নারীদের মধ্যে সংক্রমণ বাড়ছে, যা মৃত্যুহারও বাড়াচ্ছে।

তিনি বলেন, নারীরা বেশি সংক্রমিত হচ্ছেন বিধায় বেশি মারা যাচ্ছেন। আগে দেখা যেত, পরিবারের সবাই সংক্রমিত হচ্ছে না। এখন দেখা যাচ্ছে, একই পরিবারের সবাই সংক্রমিত হচ্ছে। সবাই আক্রান্ত হলে তার মধ্যে মেয়েরাও পড়ছেন। কাজেই নারীরা সংক্রমিত হচ্ছেন বেশি।

আবার টিকা নেওয়ার ক্ষেত্রে নারীদের পিছিয়ে পড়ার জন্য সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিকেও অনেকে চিহ্নিত করেছেন।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নারীরা আক্রান্ত হলেও পরীক্ষা করানো হচ্ছে না। ফলে তারা ঝুঁকিতে থেকে যাচ্ছেন।

এজন্য সামাজিক কারণকে দায়ী করে আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর বলেন, নারীরা সর্বংসহা, তাদের পরীক্ষা না করালেও চলবে-এ ধরনের স্টিগমার কারণে নারীরা পরীক্ষা করাচ্ছেন না।

তিনি বলেন, করোনাভাইরাস গ্রামাঞ্চলে ছড়ানোর পর নারীরা আক্রান্ত হচ্ছেন। আবার দেখা যাচ্ছে, নারীরা সময়মত ট্রিটমেন্ট নেন না। অনেক সময় তারা অসুস্থতার কথা বলেনও না। যখন শ্বাসকষ্ট শুরু হয়, তখন বোঝা যায়।

এদিকে গত কয়েকদিন ধরে করোনায় অব্যাহতভাবে সংক্রমণ ও মৃত্যু হ্রাসের খবর স্বস্তিদায়ক হলেও লকডাউন শিথিলের পর মাস্ক পরিধানসহ করোনা স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণে অধিকাংশ মানুষের মধ্যে অনীহা দেখা যাচ্ছে। আর তাতে করে ফের সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়ার আশঙ্কা ও ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

গত ১১ আগস্ট সরকার লকডাউন শিথিলের পর সারা দেশে অফিস-আদালত, গণপরিবহন, ছোট-বড় মার্কেট-শপিংমল ও বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্র পর্যায়ক্রমে খুলতে শুরু করেছে। জীবন ও জীবিকার তাগিদে প্রতিদিন লাখো মানুষ রাস্তাঘাটে চলাচল করছে।

স্বাস্থ্য ও রোগতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লকডাউনের সুফল ধরে রাখতে হলে ঘরের বাইরে মানুষকে মাস্ক পরিধান, ঘন ঘন সাবান বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধোয়া, নিরাপদ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং জনসমাগম এড়িয়ে চলার মতো বিষয়গুলো শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি সরকারের চলমান টিকাদান কর্মসূচিতে নিবন্ধন করে টিকা নিতে হবে।

তাদের মতে, দেশের ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনতে পারলে করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। কিন্তু যতদিন পর্যন্ত তা না হয়, ততদিন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাই প্রতিরোধের সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা।

দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে ১১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সংক্রমণ ধরা পড়েছে ৪ হাজার ৯৬৬ জনের দেহে। কমেছে শনাক্ত হার।

বুধবার (২৫ আগস্ট) স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরো জানানো, দেশে এ পর্যন্ত করোনার সংক্রমণ পাওয়া গেছে ১৪ লাখ ৭৭ হাজার ৯৩০ জনের দেহে। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ২৫ হাজার ৬২৭ জনের।

সোনালীনিউজ/এমটিআই